কর্দমাক্ত মেঠোপথ পেরিয়ে হাওরঘেরা নিদনপুর গ্রামে পৌঁছাতে হয় শহীদ তারেক আহমদের বাড়িতে। আধা কিলোমিটার পথজুড়ে কাদা, কষ্ট, আর হতাশা।
স্থানীয়রা ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ অন্যদের বাড়ির রাস্তা পাকা হলেও তারেকের বেলায় হয়েছে বৈষম্য। প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বাড়িতে গেলেও কোনো পরিবর্তন আসেনি।
তারেক আহমদ, সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার নিদনপুর গ্রামের মৃত রফিক উদ্দিনের ছেলে। পরিবারটির নিজস্ব কোনো জমি নেই। বাবার মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন চাচার বাড়িতে আশ্রয়ে ছিলেন তারেকের মা ইনরুন বেগম ও ভাই-বোনরা।
এক সময়ের ভরসা হয়ে ওঠা তারেককে হারিয়ে এখনও শোকে বিহ্বল মা ইনরুন বেগম। বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপচারিতায় ছেলে হারানোর নিদারুণ কষ্টের বর্ণনা দেন তিনি।
ইনরুন বেগম বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় আছিল তারেক। গত বছরর ৫ আগস্ট আন্দোলনে গেছিল। এরপর দুপুরে বিয়ানীবাজারো পুলিশের লগে মারামারি অইসিল ছাত্র-জনতার। অউ সময় পুলিশ তারেককে দরে থানা কম্পাউন্ডো নিয়া গেসিলো।
তারেক থানায় আছেন, রাত ১০টায় এ খবর ইনরুন বেগম পান লোক মারফতে। ছেলের খোঁজে যান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। পরে থানায় গিয়েও কাউকে পাননি। রাতভর তাকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজাখুঁজি করেন। কোতোয়ালি থানায় যান। কেউ কোনো খবর দিতে পারছিল না। অথচ মোবাইল লোকেশন দেখাচ্ছিল থানা চত্বরে। অবশেষে ভোরে থানার ভেতরে ঝোপে তার নিথর দেহ পাওয়া যায়। কপালে ও দুই পায়ে গুলির চিহ্ন, শরীরজুড়ে আঘাতের দাগ— সবই ছিল স্পষ্ট। ছেলের লাশ পেয়ে বার বার জ্ঞান হারিয়েছিলেন জানান ইনারুন বেগম।
তিনি বলেন, ছেলেরে মারা পর প্রতারণার শিকার অইসি। লোকাল নেতারা সরকারি সাহায্য দেওয়ার খতা খইয়া আমরার সই লইয়া হত্যা মামলা দায়ের করসইন। এরলাগি অসহায় মানুষরে আসামি বানাইসইন। অথচ তারেকরে থানাত নিয়া গুলি খরিয়া মারসইন। এখন বিচার তো ফাইরামইনা, উল্টা মামলা ঝামেলাত পরসি। এ গটনার ফর ঘরোর কেউই বালা আসিলাম না। এই সুযোগ কাজো লাগাইসে স্বার্থফর মানুষজন। তারা নিরপরাধ মানুষরেও আসামি বানাইসে। আসামির তালিকায় আমরার আত্মীয়-স্বজনরাও আসে।
শহীদ তারেকের মা জানান, এসব মামলার কারণে যারা নিরপরাধ, তাদের বাড়ির লোকজন এসে বলেন, আমরা তোমাদের কী ক্ষতি করেছি? অসংখ্য মানুষ আসেন তাদের বাড়িতে। ফলে প্রতিনিয়ত তারেকের পরিবারকে বিব্রত হতে হয়। মামলার বিষয়টি নিয়ে ইনরুন বেগম কোথাও কোনো সঠিক পরামর্শ পাচ্ছেন না। যাদের বিশ্বাস করেন, তারাই ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠেন। যে কারণে ছেলের হত্যার বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। বলেন, আমার বয়স অইসে, কতদিন বাসমু জানি না। শরীলো অসুক লইয়া আর ফাররাম না।
শহীদ তারেক ছিলেন তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তৃতীয়। বড় ভাই লায়েক আহমদ, ছোট ভাইয়ের নাম ফায়েক আহমদ। বড় বোন মর্জিনার বিয়ে হয়েছে আগেই। ছোট বোন তান্নি অনার্স শেষ করেছেন ম্যানেজমেন্টে।
তারেক হত্যাকাণ্ডের ৪০ দিনের মাথায় তার স্ত্রী সামিয়া সন্তানসহ বাবার বাড়ি চলে গেছে। সঙ্গে দিয়ে গেছেন, সরকার থেকে প্রাপ্ত ভাতার ৮০ ভাগ। এ নিয়ে আফসোস আছে ইনারুন বেগমের।
তারেকের বড় ভাই বলেন, ৫ আগস্ট বিয়ানীবাজার পৌর শহরে পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। তারেকও সে আন্দোলনে সক্রিয় ছিল। পরিচিত কয়েকজনের কাছ থেকে আমি জানতে পারি, ওইদিন দুপুরের কোনো এক সময় পুলিশ তার ভাইকে ধরে নিয়ে যায়। সন্ধ্যার দিকে পুলিশ আর আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষে রায়হান ও ময়নুল নামে দুজন নিহত হন। এ খবর সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের মনেও আশঙ্কা দেখা দেয়। পরিবারের সবাই তারেকের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।
লায়েক বলেন, রাতের দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তারেকের খোঁজে আত্মীয়-স্বজন সবাই বেরিয়ে পড়ি। অনেক জায়গায় খোঁজাখুজির পর ৬ আগস্ট ভোরে বিয়ানীবাজার থানার সীমানা দেয়ালের কাছে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তারেকের দেহ পাওয় যায়। তারেকের কপালে একটি, দুই পায়ে গুলির চিহ্ন ছাড়াও শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। পরে তাকে উদ্ধার করে বিয়ানীবাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। একই দিন মোল্লাপুর জামে মসজিদে জানাজার পর নিধনপুর পারিবারিক কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়।
ভাই হত্যার বিচার চেয়ে তিনি বলেন, আমরা চাই তারেক হত্যায় জড়িত প্রকৃত দোষীরা শাস্তি পাক। কিন্তু কতিপয় স্বার্থান্বেষীরা মামলাটি ঘোলাটে করে দিয়েছে। যে কারণে বিচার পাওয়া নিয়ে আমরা শঙ্কায় আছি। এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তিনি।
এনইউ/এমজে