খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজির লাগাম টানা সম্ভব হচ্ছে না। দুর্বৃত্তরা প্রকাশ্যে রাস্তার ধারে বর্বরতা চালিয়ে জ্যান্ত মানুষকে হত্যা করতে দ্বিধা করছে না।
কারণ অভিযোগ করলেই প্রাণ হারাতে হতে পারে চাঁদাবাজচক্রের কাছে। বিভিন্ন স্থানে জিম্মি থাকা মানুষ তাই আতঙ্কের সঙ্গে বসবাস করছে। ‘সমন্বয়ক’ পরিচয় দিয়ে মব সৃষ্টি করেও চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। গত ২৭ জুলাই রাতে রাজধানীর গুলশানে সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদার বাকি অংশ নিতে আসা তরুণরা পুলিশি ফাঁদে ধরা পড়েন।
এ চাঁদাবাজির ঘটনার পর নতুন নতুন তথ্য বের হয়ে আসছে। কালের কণ্ঠের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, নরসিংদী, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন জেলায় অনেক ক্ষেত্রে চাঁদা না পেয়েও হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে।
চাঁদাবাজির প্রতিবাদে ভুক্তভোগীরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছে বিভিন্ন স্থানে। চাঁদাবাজদের কাছে জিম্মি অনেকে বিক্ষোভ, মানববন্ধন ও বিভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে। সম্প্রতি রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে শুরু করে সাভার, ঝিনাইদহ, মিরসরাই, ময়মনসিংহ, আশুলিয়া, এমনকি চট্টগ্রাম পর্যন্ত চাঁদাবাজিবিরোধী আন্দোলনে মানুষ রাস্তায় নেমেছে। কেউ শিক্ষক, কেউ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, কেউ বা পরিবহনচালক—তাদের একটাই অভিযোগ, সর্বত্র চাঁদাবাজি ও নিরাপত্তার অভাব।
পরিসংখ্যানে হত্যাকাণ্ড : গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের গত জুন পর্যন্ত এক বছরে দেশের বিভিন্ন থানায় তিন হাজার ৮৫৭টি হত্যা মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে আগের (২০০৯ সাল থেকে গত ৫ আগস্ট) ৪১০টি মামলা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। মোট মামলার হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে ৩২১টির হত্যা মামলা করা হয়।
এর মধ্যে এই সময়ে মহানগর পুলিশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি, ৪৮০টি মামলা করা হয়েছে। পুলিশের রেঞ্জগুলোর মধ্যে ঢাকা পুলিশ রেঞ্জে সবচেয়ে বেশি, ৯০৩টি হত্যা মামলা করা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের মাসিক অপরাধমূলক পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় এই তথ্য পাওয়া গেছে। সূত্র বলছে, আগের অন্তর্ভুক্ত মামলা বাদ দিয়েও আগের ছয় মাসের (২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুন) তুলনায় গত এক বছরে খুনের মামলা বেড়েছে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মোট এক হাজার ৫৩৩টি মামলা করা হয়, গড়ে প্রতি মাসে ২৫৬টি মামলা করা হয়। গত এক বছরে আগের মামলা বাদ দিয়ে (জুলাই ২০২৪ থেকে জুন ২০২৫) গড়ে ২৮৮টি হত্যা মামলা করা হয়েছে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, হত্যা মামলার এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কতটা অবনতি হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীগুলো এখনো পুরোপুরি আগের মতো অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে পারছে না, ফলে দিন দিন হত্যাসহ প্রায় সব ধরনের অপরাধ বেড়েছে।
ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, হত্যাসহ সব ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী তৎপর রয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) ইনামুল হক বলেন, পুলিশ প্রতিটি হত্যার ঘটনার তদন্ত করছে। অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে প্রতিনিয়ত আইনের আওতায় আনছে।
জানা গেছে, স্বার্থসংশ্লিষ্ট দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক, পারিবারিক ও সামাজিক বিরোধ, জমিসংক্রান্ত বিরোধ, মাদক কারবার ও চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে হত্যাকাণ্ড বাড়ছে।
গত ৯ জুলাই পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল সংলগ্ন সড়কে প্রকাশ্যে দুর্বৃত্তরা মো. সোহাগ ওরফে লাল চাঁদ নামের এক ব্যবসায়ীকে বর্বরতা চালিয়ে হত্যা করে। ওই হত্যাকাণ্ডে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়নের সৃষ্টি হয়। এর আগে গত ২৮ মে ঢাকার মিরপুরে নাজমুল হাসান পাপ্পু ও দোলনা নামের এক দম্পতিকে ছুরি মেরে হত্যা করা হয়। গত ৮ মে রাজধানীর বাড্ডায় ঠিকাদার আনোয়ার হোসেন, গত ১৫ মে একই থানার গুদারাঘাট এলাকায় বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুল আহসান সাধনকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিটি হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট পরিবারের যে ক্ষতি হয় তা পূরণ হওয়ার নয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী আরো তৎপর হলে হত্যার ঘটনা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তা না হলে এভাবে হত্যার ঘটনা বাড়তেই থাকবে।
রাজধানীতে সংঘটিত গত ছয় মাসের ২১৭টি হত্যাকাণ্ড বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এর বেশির ভাগ রাজনৈতিক কারণে ঘটেছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। পুলিশ এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি সক্রিয়। গত রবিবার সচিবালয়ে আইন-শৃঙ্খলাসংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের এ কথা বলেন।
বিভিন্ন স্থানে ক্ষোভে ফুঁসছে সাধারণ মানুষ : গত মঙ্গলবার ঢাকার মোহাম্মদপুর-আদাবরে চাঁদাবাজির প্রতিবাদে মানববন্ধন ও মিছিল করে স্থানীয় শিক্ষক সমাজ। ‘মোহাম্মদপুর-আদাবরের সম্মিলিত শিক্ষক সমাজ’ ব্যানারে আয়োজিত এ কর্মসূচিতে অংশ নেন ৭০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। তাঁরা বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছেও নিয়মিত চাঁদা দাবি করা হচ্ছে। প্রতিবাদ করলে সন্ত্রাসীরা হুমকি দিচ্ছে। এর এক দিন আগে গত সোমবার সাভার-বিরুলিয়া আঞ্চলিক সড়কে মানববন্ধন করেন চার শতাধিক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। জাতীয় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সংস্থা শপিং কমপ্লেক্সের (অন্ধ মার্কেট) আয়োজনে এই কর্মসূচিতে তাঁরা অভিযোগ করেন, দোকান মালিকদের চাঁদা না দিলে দোকান দখলের ভয় দেখানো হয়। অনেকেই এরই মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) এনামুল হক সাগর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছে সরকার। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাও এ বিষয়ে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। চাঁদাবাজি বা সন্ত্রাসীমূলক কর্মকাণ্ডে যে বা যারাই জড়িত থাকবে, তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। জননিরাপত্তায় পুলিশ আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। ’
একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা কালের কণ্ঠকে জানায়, সারা দেশে একযোগে চিহ্নিত চাঁদাবাজদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত এই তালিকায় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তালিকাটি দ্রুতই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে গ্রেপ্তার অভিযান চালানো হবে।
গত ১২ জুলাই ঝিনাইদহ-যশোর মহাসড়কের বাইপাস মোড়ে কয়েক শ সাধারণ মানুষ মানববন্ধনে অংশ নেয়। তারা জানায়, এখন এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে চাঁদাবাজরা বাড়িতে গিয়ে চাঁদা চায়। না দিলে শুরু হয় হুমকি ও হয়রানি। চট্টগ্রামের বাঁশখালীর মুহুরী প্রজেক্ট এলাকায় দেশের অন্যতম বৃহৎ মৎস্য প্রকল্পটি এখন চাঁদাবাজদের কবলে। গত ২১ জুন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত চাষি ও এলাকাবাসী মানববন্ধন করে বলে, ৫ আগস্টের পর থেকে তারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। নিয়মিত চাঁদা দিতে না পারলে মাছ চাষে বাধা দেওয়া হয়, এমনকি মাছ চুরি বা পুকুরে বিষ প্রয়োগের ঘটনাও ঘটেছে। ময়মনসিংহেও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশে মানববন্ধন করেছে ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। গত ১৭ জুন শহরের চরপাড়া মোড়ে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে সংগঠনের সহসভাপতি শামসুদ্দোহা মাসুম জানান, সন্ত্রাসীরা নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের মালিকের কাছে চাঁদা দাবি করে। চাঁদা না দেওয়ায় তাঁকে মারধর করে এবং হাসপাতালের ভেতরে ভাঙচুর চালায়।
চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরাও রাস্তায় নেমেছেন। গত ২৩ জুন আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় সাধারণ ব্যবসায়ী ও পরিবহন শ্রমিকরা মানববন্ধন করেন। চিহ্নিত চাঁদাবাজদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানান তাঁরা। একই রকম মানববন্ধন করা হয় ১৮ মে চট্টগ্রামের শাহ আমানত সেতু এলাকায়। পরিবহন শ্রমিকরা বলেন, ‘অটোটেম্পো থেকে প্রতিদিন জোর করে চাঁদা আদায় করা হয়। না দিলে চালকদের মারধর করা হয়। ’
সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ