ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৪ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৯ জুলাই ২০২৫, ০৩ সফর ১৪৪৭

জাতীয়

সাদা তাপসের কালো টাকা-চতুর্থ পর্ব

সুপ্রিম কোর্টের চাবি ছিল তাপসের হাতে

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮:৫৫, জুলাই ২৯, ২০২৫
সুপ্রিম কোর্টের চাবি ছিল তাপসের হাতে শেখ ফজলে নূর তাপস।

তাপসের দুর্নীতির আরেক ক্ষেত্র ছিল বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত। সুপ্রিম কোর্টের মামলা, বিচারপতি নিয়োগ, জামিন বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন শেখ ফজলে নূর তাপস।

আইনজীবী হিসেবে ছিলেন জুনিয়র, কিন্তু পারিবারিক পরিচয় এবং ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণ কর্তৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন এই মাফিয়া তরুণ। তার সবুজ সংকেত ছাড়া কেউ বিচারপতি হতে পারতেন না। এমনকি প্রধান বিচারপতিকে তিনি চিরকুট পাঠিয়ে নির্দেশনা দিতেন, কোন বিচারপতিকে কোন বেঞ্চ দিতে হবে সুপ্রিম কোর্টে। ২০০৯ সালে এমপি হওয়ার পর সুপ্রিম এবং আপিল বিভাগে প্রাকটিস করেছেন তাপস। এ সময় তার মামলাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, সবই ছিল জামিনের মামলা। বিপুল পরিমাণ টাকার বিনিময়ে এই কুখ্যাত সন্ত্রাসী, অপরাধী এবং ব্যাংক লুটেরাদের জামিন করাই হয়েছিল তাপসের আইন পেশার প্রধান দিক। সুপ্রিম কোর্টের পেশাদারিত্ব চরম ভাবে ক্ষুণ্ন করেছিলেন তাপস। বিভিন্ন অপরাধীদের মামলা গ্রহণ করে হাই কোর্টে এবং আপিল বিভাগে প্রভাব খাটিয়ে তাদেরকে জামিন করিয়ে তিনি আদালত ও বিচার ব্যবস্থাকে করেছিলেন কলুষিত। এরকম অনেকগুলো উদাহরণ দেখা যায়, যেখানে তাপস তার অবৈধ হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বিচারককে প্রভাবিত করে কুখ্যাত আসামিদের এবং অর্থ পাচারকারীদের জামিন করিয়ে দিয়েছেন। আর এ কারণেই সুপ্রিম কোর্টে একটি অঘোষিত নিয়ম ছিল যদি কেউ জামিন পেতে চায়, তাহলে তাপসের চেম্বারে যেতে হবে। তাপসের চেম্বারে গেলেই নিশ্চিত জামিন হয়ে যাবে।

এ প্রসঙ্গে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যায়। হলমার্ক কেলেঙ্কারি ঘটনার পর শেখ ফজলে নূর তাপস হয়েছিলেন হলমার্কের আইনজীবী। আইনজীবী হয়ে তিনি হলমার্কের চেয়ারম্যান জেসমিনের জামিন করিয়েছিলেন আদালত থেকে। এ সময় তার জামিন নিয়ে দেশজুড়ে হইচই শুরু হয়। এরকম বহু অর্থ পাচারকারী এবং শীর্ষ সন্ত্রাসীদের জামিন আদালত থেকে করিয়েছিলেন শেখ ফজলে নূর তাপস। দেশের প্রধান বিচারপতি কে হবেন সেটিও নির্ধারণ করতেন শেখ ফজলে নূর তাপস। মূলত সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার সঙ্গে জামিন বিষয়ে বিরোধ হয় শেখ ফজলে নূর তাপসের। এই বিরোধের কারণে বিচারপতি সিনহাকে সরানোর জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে উসকে দেন তাপস। এরপর বিচারপতিদের অপসারণ সম্পর্কিত সংবিধান সংশোধনীর মামলার রায় এবং অন্যান্য প্রেক্ষাপটের মাধ্যমে এস কে সিনহাকে বিদায় নিতে হয়।

বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞার প্রধান বিচারপতি হওয়াটা নিশ্চিত ছিল। সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠতা রীতি অনুযায়ী তিনি হবেন প্রধান বিচারপতি- এটা সবাই জানত। বিশেষ করে বিচারপতি সিনহাকে নিয়ে সরকারের ন্যক্কারজনক কাণ্ডের পর সর্বোচ্চ আদালতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বিচারপতি ওয়াহহাবের বিকল্প ছিল না। তাকেই করা হয়েছিল ভারপ্রাপ্ত বিচারপতি। কিন্তু তাপসের জন্য তিনি প্রধান বিচারপতি হতে পারেননি। তাপস তার জামিন বাণিজ্য এবং মামলা বাণিজ্যের জন্য চাননি যে ওয়াহহাব মিঞা সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হোক। কারণ ওয়াহহাব মিঞা ছিলেন নীতিবান এবং একজন সৎ বিচারপতি। তিনি তাপসের কথায় বেঞ্চ গঠন করতেন না। তাপসের সমস্ত মামলার জন্য জামিনের ব্যবস্থা করে দিতেন না। আর এ কারণেই সেই সময় প্রধান বিচারপতি হিসেবে ওয়াহহাব মিঞার বিরোধিতা করেন এবং তাপসের পছন্দের ব্যক্তিকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে করার জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে প্ররোচিত করেন। শুধু তাই নয়, বিচারপতি নিয়োগের জন্য তাপসের কাছে তদবির আসত। কে বিচারপতি হবে, না হবে ইত্যাদির নিয়ন্ত্রণ করতেন তাপস। তার ইচ্ছা অনিচ্ছাতেই হাই কোর্টের বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হতো। পরবর্তীতে এটি হয়ে গিয়েছিল একটি ঘুষ বাণিজ্য। তাপসকে যিনি অর্থ দিয়ে সন্তুষ্ট করতে পারতেন, তার নাম আইন মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব করা হতো। দেওয়া হতো হাই কোর্টের বিচারপতি হিসেবে। তিনি পরবর্তীতে হাই কোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেতেন।

২০১০ সাল থেকে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারব্যবস্থা যে কলুষিত হয়েছে বলে যে অভিযোগ উঠছে এবং বিচারপতিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে তার একটি বড় কারণ হলো শেখ ফজলে নূর তাপসের বিচারক নিয়োগের দুর্নীতি। বিচারক নিয়োগের সীমাহীন দুর্নীতির মাধ্যমে তাপস দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে কলুষিত করেছিলেন। আর এ কারণেই যারা সৎ বিচারপতি, তারা তাপসকে অপছন্দ করতেন, রীতিমতো ঘৃণা করতেন। তাপসের কারণেই মেধাবী বিচারপতিদের আপিল বিভাগে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। সৎ বিচারপতিদের কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল দিনের পর দিন।

এ সময় তাপস আইনজীবীদের মধ্যেও বিভাজন তৈরি করেছিলেন। তিনি সুপ্রিম কোর্টের আওয়ামীপন্থি আইনজীবী দলের নেতা ছিলেন না, কিন্তু সব কর্মকাণ্ড তার দ্বারাই পরিচালিত হতো। আওয়ামীপন্থি আইনজীবীদের বিভক্ত করে তার নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য যা যা করা দরকার, সবকিছু করেছিলেন শেখ ফজলে নূর তাপস। একদিকে যেমন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি, বার কাউন্সিলের নিয়ন্ত্রণ, অন্যদিকে বিচারপতিদের নিয়োগ, তারা কে কোন বেঞ্চে বসবেন তা নির্ধারণ করা এবং জামিন বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাই কোর্ট থেকে লুণ্ঠন করেছেন শেখ ফজলে নূর তাপস।

সুপ্রিম কোর্টের একাধিক সিনিয়র আইনজীবীর সঙ্গে আলাপ করলে জানা যায় যে, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের যে অধঃপতন এবং সর্বোচ্চ আদালতের প্রতি যে অনাস্থা তৈরি হয়েছে, তার অন্যতম কারণ ছিলেন শেখ ফজলে নূর তাপস। কারণ তিনি এমনভাবে বিচার ব্যবস্থার ওপর হস্তক্ষেপ করেছিলেন যা নজিরবিহীন। আইনের শাসনের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তি এটা মেনে নিতে পারেননি।

একজন আইনজীবী বলেছেন, ‘আইনজীবী হিসেবে তাপস অত্যন্ত জুনিয়র। কিন্তু তিনি ক্ষমতাবান হয়ে যাওয়ার পর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদেরকে পাত্তা দিতেন না। তাদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করতেন। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের আইন পেশাকে জটিল এবং দুর্বিষহ করে তুলেছিলেন। অনেক আওয়ামীপন্থি আইনজীবীও তার কারণে আদালতে ন্যায়বিচার পেতেন না। ’ যে কোনো মামলার ব্যাপারে যদি তাপস হস্তক্ষেপ করতেন, তাহলে তিনি বিচারপতিদের যেভাবে নির্দেশ দিতেন, বিচারপতিরা সেভাবেই রায় প্রদান করতেন বলেও অভিযোগ আছে। যে সব বিচারপতিরা তাপসের কথা শুনতেন না, তাদেরকে অগুরুত্বপূর্ণ বেঞ্চ দেওয়া হতো। যে সমস্ত বেঞ্চে তাদের কোনো কাজ থাকত না বা করণীয় কিছুই থাকত না। এরকমভাবে তাপস পুরো বিচার ব্যবস্থাকে একটি কলঙ্কজনক জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন। আর তার এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলারও সাহস পেত না। কেউ কথা বললেই তাকে নানা ভাবে হয়রানি করা হতো। এরকম বহু আইনজীবী আছেন, যারা শেখ ফজলে নূর তাপসের এসব বাড়াবাড়ি এবং অপকর্মের প্রতিবাদ করার কারণে শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টে আইন পেশায় থাকতে পারেননি। আদালতে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন অনেকে। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সিনিয়র আইনজীবীরা শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। তাপসের বিরুদ্ধে অভিযোগও করেছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনা এসব অভিযোগ পাত্তা দিতেন না।

প্রয়াত অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তাপসের এসব কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে শেখ হাসিনার কাছে গিয়েছিলেন অভিযোগ করার জন্য। সে সময় শেখ হাসিনা তাকে বলেছিলেন যে, ‘তুমি তাপসকে একটু মানিয়ে চল। ও বাবা-মা মরা এতিম বাচ্চা। কাজেই ও যেটা চায় সেটা করতে হবে। ’ এসব কারণে শেখ ফজলে নূর তাপস হয়ে উঠেছিলেন চরম বেপরোয়া, ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর এই সুযোগে তিনি বিচার ব্যবস্থাকে দুর্নীতির আখড়া বানিয়েছেন, তছনছ করেছেন। যে কোনো অপরাধীরা জানত যে, তাপস যদি জামিনের আবেদন করে তাহলে, তা নিশ্চিত।

সাধারণত সুপ্রিম কোর্টে একটা জামিনের আবেদনের শুনানির জন্য একজন আইনজীবী সর্বোচ্চ ২ থেকে ৫ লাখ টাকা নেন। এমনকি ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের মতো সিনিয়র আইনজীবীরা এ ধরনের জামিনের আবেদনে কখনোই ১০ লাখ বা ১৫ লাখ টাকার বেশি নেন না। কিন্তু শেখ ফজলে নূর তাপস কোনো কোনো জামিনের জন্য ৫ কোটি টাকাও নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এভাবে টাকা দিয়ে জামিন কেনাবেচার যে নোংরা খেলা তাপস শুরু করেছিলেন, সেই খেলার কারণে একদিকে যেমন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি, অন্যদিকে সর্বোচ্চ বিচারব্যবস্থা কলঙ্কিত হয়েছে। শেখ ফজলে নূর তাপস যখন মেয়র নির্বাচিত হন, তারপর তিনি নিজে আদালতে যেতেন না বটে, কিন্তু তার ল ফার্ম আদালতে যেত এবং এই ল ফার্মেই সবাইকে জামিনের জন্য ধরনা দিতে বলা হতো। যারা তাপসের চাহিদা মতো অর্থ দিতে পারত, তাদের জামিনের জন্য বিচারকদের নির্দেশনা দিতেন তাপস এবং সেভাবেই আদেশ হতো। অর্থাৎ পুরো সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছিলেন তাপস। আর তার এই নিয়ন্ত্রণের কারণেই দেশের সর্বোচ্চ আদালতে একদিকে যেমন মেধাবী বিচারপতিদের আগমনের পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টে যে নিয়ম, রীতিনীতি এগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছিল।

সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।