ঢাকা, রবিবার, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২৫ মে ২০২৫, ২৭ জিলকদ ১৪৪৬

জাতীয়

সৌদির কফিলকে বশে আনতে গিয়ে ‘জিনের বাদশার’ খপ্পরে প্রবাসীর স্ত্রী

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮:৩৬, মে ২৫, ২০২৫
সৌদির কফিলকে বশে আনতে গিয়ে ‘জিনের বাদশার’ খপ্পরে প্রবাসীর স্ত্রী গ্রেপ্তার তিন প্রতারক

প্রতারণার মাধ্যমে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া একটি চক্রের ৩ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। গ্রেপ্তাররা হলেন - মো. রাকিব (২০), মো. রাকিব মোল্লা (২৯), মো. আলাউদ্দিন (৩০)।

ভোলা জেলার বোরহানউদ্দিন থানা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। তারা ‘জিনের মাধ্যমে জৈনপুরী মা ফাতেমার সকল সমস্যার সমাধান চক্রে’র সদস্য।  

জিজ্ঞাসাবাদে প্রতারকচক্রের তিন সদস্য স্বীকার করেন, বাংলাদেশির ভিসার জন্য সৌদির কফিলকে বশে আনার কথা বলে এক প্রবাসীর স্ত্রীর কাছ থেকে তারা ১০ লাখ ২০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন।

রোববার (২৫ মে) রাজধানীর পশ্চিম আগারগাঁওয়ে পিবিআই কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান অতিরিক্ত উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক মো. এনায়েত হোসেন মান্নান।  

তিনি জানান, ১৭ জন বাংলাদেশির ভিসার জন্য সৌদির কফিলকে ৩৫ লাখ টাকা দিয়েও ভিসা এবং টাকাও না পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন প্রবাসী। স্বামীর এ সমস্যা সমাধানে ‘জিনের বাদশা তান্ত্রিক, শাস্ত্রিক জৈনপুরী মা ফাতেমা’র দরবারের সকল সমস্যার সমাধানের চটকদার বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হন প্রবাসীর স্ত্রী। সমস্যা সমাধানের জন্য জিনের বাদশা খ্যাত প্রতারকচক্রের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি।  

পিবিআই কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন

শুরুতে কোনো টাকা লাগবে না বলে জানানো হলেও সৌদি কফিলকে বশে আনতে তার কাছে জিন-পরীকে পবিত্র করে পাঠানো হবে বলা হয়। এজন্য ভুটানি গরুর ২১ কেজি দুধ দিয়ে ধুয়ে জিন-পরীকে পবিত্র করতে হবে জানিয়ে দুধ কেনা বাবদ টাকা চাওয়া হয়। একইভাবে বিভিন্ন অযুহাতে ধাপে ধাপে হাতিয়ে নেওয়া হয় ১০ লাখ ২০ হাজার টাকা।  

ভুক্তভোগী হলেন - রাজধানীর তেজগাঁওয়ের তেজকুনিপাড়ার গৃহবধূ রহিমা বেগম (৩৪)।  

অতিরিক্ত উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক জানান, ভুক্তভোগী নারী অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানার একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার বাদী প্রতারকের খপ্পরে পড়ে ১০ লাখ ২০ হাজার টাকা খোয়ানোর কথা উল্লেখ করেছেন। তবে মামলা তদন্তকালে ও আসামিদের গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, শুধু ওই নারীই নয়; ইউটিউব ও বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণার ফাঁদ পেতে হাজার হাজার লোককে বোকা বানিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই প্রতারকচক্র।  

পুলিশ কর্মকর্তা এনায়েত হোসেন মান্নান বলেন, জিনের বাদশাহখ্যাত প্রতারকচক্রটি বিভিন্ন চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে বিপদগ্রস্ত মানুষকে সব সমস্যার সমাধানের প্রলোভন দেখায়। বিজ্ঞাপন দেখে প্রলুব্ধ হয়ে তাদের দেওয়া নম্বরে ফোন করলে তারা তখন জানায়, তারা জিনের মাধ্যমে পাওনা টাকা আদায়, স্বামীর সঙ্গে মিল, প্রেমিকাকে পাইয়ে দেওয়া, ঝগড়া-বিবাদ মিট করা, মামলা মোকদ্দমায় জয়ী করা, গুপ্তধন পাইয়ে দেওয়া, লটারিতে বিজয়ী করা, কোটি কোটি টাকার মালিক বানিয়ে দেওয়া, কঠিন রোগ হতে আরোগ্য লাভ করা, পাওনা টাকা আদায় করা, আকামা লাগিয়ে দেওয়া, ভিসা পাইয়ে দেওয়াসহ ভাগ্য পরিবর্তন করে দিতে পারেন।

তিনি বলেন, সৌদি কফিলকে বাধ্য করার জন্য প্রাথমিকভাবে আগরবাতি, মোমবাতি, গোলাপজল, কাপ সিন লাগবে জানিয়ে ওই নারী থেকে টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতারকচক্র। পরে আবার জিন-পরীকে পবিত্র করতে হবে জানিয়ে ভুটানি গরুর ২১ কেজি দুধ লাগবে জানিয়ে বিপুল টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। কফিলকে বাধ্য করতে বাদীকে রতাময়ী শ্রী আংটি পড়তে হবে। জিনেরা আংটি বাদীর কাছে পৌঁছে দেবে। তাই জিনদের মিষ্টি খাওয়াতে জন্য টাকা লাগবে। পরীদের বাদীর কাছে যেতে মানুষের রূপ ধারণ করতে হবে। সেজন্য আগুনে মোড়ানো শাড়ি লাগবে এবং তাতে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা লাগবে। পরবর্তীতে জিনেরা বাদীর কাছে যাওয়ার সময় পথে খবিশ জিনদের আক্রমণের শিকার হয়েছে। তাদের ওপর প্রস্রাব করে দেওয়ায় ভালো জিনেরা পথে আটকে গেছে এবং সেখান থেকে তাদের ছাড়াতে হলে পাঠা বলি দিতে হবে জানিয়ে নানা কৌশলে ধাপে ধাপে প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ায় এই জিনের বাদশার কাজ।

তিনি আরও বলেন, হতাশাগ্রস্ত লোকদেরকে বাধ্য করতে ইউটিউব থেকে ডাউনলোড করা জিন-পরীর বীভৎস ছবি পাঠিয়ে ভয় দেখায় প্রতারকচক্র এবং কাউকে কিছু বললে রক্তবমি হয়ে সন্তান মারা যাবে ও পরিবারের অন্য সদস্যদের মারাত্মক ক্ষতিসহ অঙ্গহানি হবে জানিয়ে ভয়ভীতি দেখায় তারা।

জিনের কণ্ঠও নকল করে কথা বলেন প্রতারকচক্রের সদস্যরা।  

এ বিষয়ে অতিরিক্ত উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক জানান, অ্যাপসের মাধ্যমে কণ্ঠস্বরকে বিকৃত করে জিনের বাদশার কণ্ঠ বলে চালিয়ে মানুষের মাঝে ভয়, আতঙ্ক ছড়ানো হতো।

গ্রেপ্তারদের কাছ থেকে মোবাইলফোন ৪টি, বিজ্ঞাপনের ভিডিও ৩টি, বিভিন্ন ভিকটিমের কথা বলার ভয়েস রেকর্ড ১০টি, বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের ছবি ৭টি, বিকাশ স্টেটমেন্ট ১৫০ পাতা ও কোটি কোটি টাকার লেনদেনের ৫টি বিকাশ অ্যাকাউন্ট শনাক্ত করা হয়।

চক্রটির বিকাশ ও নগদের তথ্য জানিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, অন্যের নামে রেজিস্ট্রেশন করে ভুয়া সিম তুলে বিকাশ ও নগদ অ্যাকাউন্ট খুলে লেনদেন ও টাকা নিয়েছে মর্মে স্বীকার করে। তদন্তে বিকাশ স্টেটমেন্ট পাওয়া গেছে। যেখানে বিভিন্নজনের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার তথ্য পাওয়া যায়।

গ্রেপ্তার আসামিদের জবানবন্দিতে ভয়াবহ, লোমহর্ষক, চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে জানিয়ে এনায়েত বলেন, আসামিদের সঙ্গে তাদের প্রতারণার কাজে আরো একাধিক আসামি জড়িত রয়েছে। গ্রেপ্তার আসামিসহ প্রতারকচক্র গত ২০১৯ সাল থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত ৭ বছর প্রতারণা করে হাজার হাজার মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

এমএমআই/এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।