ঢাকা: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আমরা একটি ন্যায্যতার ভিত্তিতে গঠিত, বৈষম্যমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণের স্বপ্ন দেখছি। আমরা ‘দ্বিতীয় বাংলাদেশ’ গঠনের স্বপ্ন দেখছি।
মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) সকালে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ‘পুলিশ সপ্তাহ ২০২৫’-এর উদ্বোধন ও পদক প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ এখন একটি শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে এবং তা বজায় রাখবে। এই স্বপ্ন পূরণে আপনাদের—বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর—ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুলিশের কর্মকাণ্ড ও জনগণের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক দেখেই সারা দুনিয়া আমাদের সভ্যতার মাত্রা বিচার করে। আমরা চাই, সভ্যতার সর্বোচ্চ স্তরে যেতে। এই লক্ষ্য অর্জনে আপনারা মূল চালিকাশক্তি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ পুলিশের প্রতি আমার প্রত্যাশা—আপনারা যেন দেশের মানুষের কাছে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও প্রশংসিত হন।
পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে পুলিশ সদস্যদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে বাঙালি পুলিশ সদস্যরাই প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এটি আমাদের ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পুলিশ সদস্যদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে তিনি বলেন, মানুষের অধিকার, মর্যাদা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে—এটাই যুগ যুগ ধরে আমাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল। সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বড় ভূমিকা রয়েছে।
তিনি বলেন, স্বৈরাচারী শাসনামলের ১৫ বছরে পুলিশ বাহিনীকে দলীয় বাহিনীতে পরিণত করা হয়েছিল, যার ফলে গোটা ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়েছিল। অবৈধ, অন্যায় আদেশ পালন করতে গিয়ে পুলিশ ব্যাপক জনরোষের মুখে পড়ে। অনেক সৎ সদস্যকেও এর মাশুল দিতে হয়।
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, গত আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল ভঙ্গুর। পুলিশ ও জনগণের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। সরকার সে পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য সর্বাত্মক ব্যবস্থা নিয়েছে। সড়ক-মহাসড়কে বিশৃঙ্খলা নিরসন, বিশেষ অভিযান পরিচালনা, অংশীজনদের সঙ্গে পুলিশের আন্তঃসম্পর্ক জোরদারসহ মনোবল বৃদ্ধিতে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সদস্যদের নিরলস পরিশ্রমে শান্তিপূর্ণভাবে দুর্গাপূজা, বিশ্ব ইজতেমা, ঈদুল ফিতর, বাংলা নববর্ষসহ নানা উৎসব উদযাপিত হয়েছে। অপরাধ সংঘটনের পর তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রেও পুলিশের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এজন্য আমি সবাইকে ধন্যবাদ জানাই।
তিনি বলেন, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে পুলিশ বাহিনীর শক্তিশালী ভূমিকা দরকার। আমি আহ্বান জানাই—আপনারা যেন সর্বোচ্চ সংবেদনশীলতা নিয়ে কাজ করেন। সকল শ্রেণি-পেশার নারীরা যেন পুলিশের হটলাইনে ফোন করে দ্রুত সহায়তা পান—এটি নিশ্চিত করতে হবে। নারী-শিশু নিরাপদ হলে বুঝবো, দেশ নিরাপত্তায় অনেক দূর এগিয়েছে।
পুলিশ বাহিনীর চ্যালেঞ্জের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অপর্যাপ্ত জনবল, সরঞ্জামের অভাব ও বাজেট সীমাবদ্ধতা থাকলেও সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো—বিগত ১৬ বছরে পুলিশ-জনগণের মধ্যে তৈরি হওয়া দূরত্ব ঘোচানো এবং পুলিশের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনা। আমি বলবো, এটা কঠিন নয়। আন্তরিক পরিবেশ তৈরি হলেই এই বন্ধন দৃঢ় হবে।
সমাজকে সুশৃঙ্খল সমাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পুলিশ ও জনগণের সম্পর্ক মজবুত করা জরুরি। মানুষ যেন পুলিশকে বন্ধু হিসেবে দেখার সুযোগ পায়।
তিনি বলেন, মাঠপর্যায় থেকে শুরু করে সব স্তরে জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য পুলিশ বাহিনীকে কাজ করতে হবে। সরকারের দায়িত্ব—সেই পথ সুগম করা, যা আমরা করছি। পুলিশ সংস্কারের লক্ষ্যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের কল্যাণে কিছু বিষয়েও দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার একাধিক ভাষণে বলেছি, চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচন যেন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়, তা নিশ্চিত করা আপনাদের দায়িত্ব। প্রতিটি প্রার্থী যেন সমান আচরণ পান এবং ভোটাররা যেন নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন, সে পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি।
মনে রাখবেন, কেউ যদি অন্যায় বা অনিয়মের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়, তার দ্বারা ন্যায় প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাই কোনো পক্ষ যেন আপনাদের ব্যবহার করতে না পারে।
তিনি বলেন, ভবিষ্যতে যেন পুলিশ বাহিনীকে আর কখনো দলীয় বাহিনী হিসেবে বা অন্যায় কাজে ব্যবহার করা না যায়, তার জন্য একটি নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অত্যন্ত প্রয়োজন। নির্বাচনের আগে সময়টা খুবই স্পর্শকাতর। পরাজিত শক্তি যেন দেশকে অস্থিতিশীল করতে না পারে, সেদিকে আপনাদের সতর্ক নজর রাখতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন ন্যায্য ও অন্যায্য দাবিতে মানুষকে রাজপথে দেখা গেছে। এসব পরিস্থিতিতে আপনারা ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। আশা করি, ভবিষ্যতেও একই ধৈর্য ও নিষ্ঠা নিয়ে কাজ করে যাবেন। ‘পুলিশ জনগণের বন্ধু’—এই ইমেজ গড়ে তুলতেই হবে। এটা কঠিন, কিন্তু ন্যায্য এবং অবশ্যই প্রয়োজনীয়।
তিনি আরও বলেন, প্রথমবারের মতো এবারের পুলিশ সপ্তাহে ধর্মীয় নেতা, সাংবাদিক ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে বলে জানতে পেরেছি। এতে জনসাধারণের মধ্যে পুলিশের প্রতি প্রত্যাশা নিয়ে আলোচনা হবে। আমার প্রত্যাশা—এই বৈঠক যেন ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে। শুধু পুলিশ সপ্তাহে নয়, নিয়মিতভাবেও এমন বৈঠকের প্রয়োজন রয়েছে। এতে পারস্পরিক বোঝাপড়া স্পষ্ট হয় এবং জনগণ-পুলিশের দূরত্ব কমে আসে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মো. খোদা বখস চৌধুরী, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. বাহারুল আলম এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
এসসি/এসআইএস