ইসরায়েলে বন্দিজীবন থেকে মুক্তি পাওয়া ফিলিস্তিনিরা নিজ নিজ ঘরে ফিরছেন। গাজায় ফেরার পর নিজেদের পরিবার-পরিজনদের দেখে তারা আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ছেন।
ইসরায়েলি কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া ফিলিস্তিনিদের মুখে ভয়াবহ নির্যাতন ও মানবেতর অবস্থার চিত্র লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরেছে আল জাজিরা। তাদের প্রতিবেদক দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে মুক্তিপ্রাপ্তদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। ফিরে আসা ফিলিস্তিনিরা জানিয়েছেন, ইসরায়েলি জেলগুলো ‘মানবসভ্যতার সীমা ছাড়ানো নির্যাতনের কেন্দ্র। ’
আবদাল্লাহ আবু রাফি নামে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত এক ফিলিস্তিনি নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, আমরা কোনো কারাগারে ছিলাম না, বরং এক কসাইখানায় ছিলাম। দুঃখজনকভাবে সেই কসাইখানার নাম ওফের কারাগার। সেখানে অনেক তরুণ এখনও বন্দি। পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ। কোনো তোশক নেই, তারা সবসময় তোশকগুলো কেড়ে নেয়। খাবারের অবস্থা করুণ, প্রতিদিনই নতুন যন্ত্রণা। আমরা ছিলাম এক জীবন্ত নরকে।
ইয়াসিন আবু আমরা নামে আরেক বন্দি ইসরায়েলি কারাগারের পরিস্থিতিকে বর্ণনা করেন ‘অত্যন্ত ভয়ানক’ বলে। তিনি বলেন, খাবার, নির্যাতন, মারধর—সবকিছুই অমানবিক ছিল। খাওয়ার বা পান করার মতো কিছুই ছিল না। আমি টানা চার দিন কিছু খেতে পারিনি। মুক্তির পর আমাকে দুটি মিষ্টি দেওয়া হয়, আর আমি সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো খেয়ে ফেলি।
সোমবার মুক্তি পাওয়া আরেক ফিলিস্তিনি সাঈদ শুবাইর জানান, তার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। শুবাইর বলেন, এই অনুভূতি বর্ণনাতীত। জেলের বারের ফাঁক ছাড়া সূর্য দেখা, অমূল্য অনুভূতি। হাতের শিকল খুলে গেছে। স্বাধীনতার মূল্য কোনো কিছুর সঙ্গে তুলনীয় নয়।
দীর্ঘ ১৯ মাস বিনা অভিযোগে ইসরায়েলি কারাগারে আটক থাকার পর মুক্তি পেয়েছেন সাংবাদিক ইব্রাহিম আল-খালিলির ভাই মোহাম্মদ আল-খালিলি। মুক্তির পর নিজের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে মোহাম্মদ বলেন, এটা ছিল এক ভয়াবহ সংগ্রাম। আমাদের মারধর করা হয়েছে, অপমান করা হয়েছে। আমরা অসীম কষ্ট সহ্য করেছি। কিন্তু আল্লাহর অশেষ কৃপায় সবকিছু এখন শেষ হয়েছে।
তিনি জানান, বন্দিত্বের পুরো সময়জুড়ে কারাগারের পরিস্থিতি ছিল অমানবিক। তাকে ও অন্য বন্দিদের নিয়মিত শারীরিক নির্যাতন ও মানসিক অপমানের মুখে থাকতে হয়েছে।
আল-খালিলি ১৯ মাস ধরে কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ছাড়াই ইসরায়েলি হেফাজতে ছিলেন, যা আন্তর্জাতিক আইনের চোখে ‘অবৈধ প্রশাসনিক আটক’ হিসেবে বিবেচিত।
মুক্তিপ্রাপ্ত ইয়াসির আবু তুরকি আল জাজিরাকে বলেন, এটা যেন নরক থেকে স্বর্গে ফেরা। আমি আমার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না—এতে ব্যথা আছে, আনন্দ আছে, আর আছে এক অদ্ভুত কাঁপুনি।
১৯ বছর পর ইসরায়েলি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন ফিলিস্তিনি ঔপন্যাসিক ও সাহিত্যিক বাসিম খানদাকজি। মুক্তি মিললেও ফিরে যেতে পারেননি নিজের মাতৃভূমি ফিলিস্তিনে। ইসরায়েল তাকে নির্বাসিত করেছে মিসরে। ৪১ বছর বয়সী এই লেখক মঙ্গলবার মিসরে পৌঁছান। ফিলিস্তিনি ইনফরমেশন সেন্টার প্রকাশিত এক ভিডিওতে দেখা যায়, শুকনো মুখের ক্লান্ত খানদাকজি ঐতিহ্যবাহী কেফিয়াহ পরে মিসরে পৌঁছালে সমর্থকরা তাকে ফুল ও আলিঙ্গনে বরণ করে নেন।
২০০৪ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে তেলআবিবে এক বোমা হামলার ঘটনায় সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে তাকে আটক করে ইসরায়েল। পরে আদালত তাকে তিন মামলায় আজীবন কারাদণ্ড দেয়। কারাগারা থাকলেও তার কলম থেকে থাকেনি। বন্দিদশায় তিনি লিখেছেন একাধিক উপন্যাস, প্রবন্ধ ও কবিতা। ২০২৪ সালে তার উপন্যাস ‘ অ্যা মাস্ক, দা কালার অব দ্যা স্কাই’ আরব বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ সাহিত্য সম্মাননা আন্তর্জাতিক আরবি সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করে।
ইসরায়েলি কারাগার থেকে সোমবার মুক্তি পাওয়া ফিলিস্তিনিদের তালিকায় ছিলেন অন্তত ৫৫ জন স্বাস্থ্যকর্মী, যাদের মধ্যে ২৪ জন নার্স, সাতজন চিকিৎসক এবং দুইজন প্যারামেডিক রয়েছেন। মানবাধিকার সংস্থা হেলথকেয়ার ওয়ার্কার্স ওয়াচ জানিয়েছে, এই স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে অন্তত ৪৪ জনকে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী গাজা উপত্যকার হাসপাতালগুলো থেকেই অপহরণ করেছিল, যখন তারা কর্তব্যরত ছিলেন। সংস্থাটি আরও জানিয়েছে, এখনো অন্তত ১১৫ জন ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্যকর্মী ইসরায়েলি হেফাজতে রয়েছেন।
হেলথকেয়ার ওয়ার্কার্স ওয়াচের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক ডা. মুয়াথ আলসের বলেন, ইসরায়েলের স্বাস্থ্যকর্মীদের বিরুদ্ধে এই ধারাবাহিক অপহরণ যুদ্ধাপরাধের শামিল। এতে একদিকে দক্ষ চিকিৎসক ও নার্সদের অবৈধভাবে আটক রাখা হচ্ছে, অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।
তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ইসরায়েল যেন অবিলম্বে ও নিঃশর্তভাবে সব স্বাস্থ্যকর্মীকে মুক্তি দেয়। এমনকি যারা নির্যাতনের ফলে বন্দিদশায় নিহত হয়েছেন, তাদের মরদেহও ফেরত দিতে হবে।
আল জাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরায়েল সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় ২৫০ জন আজীবন সাজাপ্রাপ্ত ও দীর্ঘমেয়াদি সাজাভোগকারী ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দিয়েছে। পাশাপাশি গাজা যুদ্ধ চলাকালীন যাদের আটক করা হয়েছিল, সেই ১ হাজার ৭১৮ জনকেও মুক্তি দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘ এই আটক ব্যক্তিদের ‘জোরপূর্বক নিখোঁজ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।
এমজে