ঢাকা, রবিবার, ২৯ ভাদ্র ১৪৩২, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২১ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

ভারত

পদ্মার ইলিশ, দুই বাংলার সম্পর্কের সেতুবন্ধন

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট   | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:১৮, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২৫
পদ্মার ইলিশ, দুই বাংলার সম্পর্কের সেতুবন্ধন

ইলিশ পদ্মার, নাকি গঙ্গার—এই বিতর্ক বহুদিনের। দুই বাংলার মানুষের আবেগ, সংস্কৃতি ও ভোজনরসিকতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই মাছ।

তবু কলকাতার একাংশের অভিযোগ, গঙ্গার ইলিশকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয় না। প্রশ্ন উঠছে—কেন পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের মতো ইলিশ ধরার নীতি গড়ে তোলা হয়নি? 

গঙ্গার ইলিশ কি তবে কেবল ভিআইপিদের জন্য? সাধারণ গঙ্গাপাড়ের মানুষ কেন এর স্বাদ পাবেন না? কলকাতার হোটেল-রেস্তোরাঁয় গঙ্গার ইলিশের কিছুটা ভাগ হয়তো ভিআইপি টেবিলে ওঠে, কিন্তু স্থানীয় বাজারে তার দেখা মেলে খুব কমই।

তবে ভোজনরসিক বাঙালির কাছে ইলিশ কেবল একটি মাছ নয়—এটি আবেগ, ঐতিহ্য এবং দুই বাংলার সম্পর্কের সেতুবন্ধন। পদ্মা হোক বা গঙ্গা, ইলিশের স্বাদ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এই মাছকে ঘিরে আবেগ দুই বাংলার মানুষকে এক সুতোয় বাঁধা।

রপ্তানি নীতি ও ভারতের বাজার

বাংলাদেশ ২০১৫ সালে জাতীয় রপ্তানি নীতিতে শর্তসাপেক্ষে ইলিশকে রপ্তানিযোগ্য তালিকায় রাখে। এরপর ২০১৯ সালে প্রথমবার পূজার মৌসুমে ৫০০ টন ইলিশ রপ্তানি করা হয় কলকাতায়। ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৮৫০ টনে।

২০২১ সালে রপ্তানির অনুমতি ছিল চার হাজার ৬০০ টন, তবে কলকাতা পায় এক হাজার ২০০ টন। ২০২২ সালে অনুমোদিত ছিল দুই হাজার ৯০০ টন, এদিকে ভারতে আসে এক হাজার ৩০০ টন। ২০২৩ সালে তিন হাজার ৯৫০ টন অনুমোদনের বিপরীতে পৌঁছায় মাত্র ৫৮৭ টন। ২০২৪ সালে অনুমতি ছিল দুই হাজার ৪২০ টন, এসেছে মাত্র ৫৭৭ টন।

চলতি বছর বাংলাদেশেই ইলিশ ধরা কম হয়েছে। তারপরও অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভারতের জন্য এক হাজার ২০০ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০ সেপ্টেম্বর থেকে কলকাতার খুচরা বাজারে পৌঁছাবে পদ্মার ইলিশ।  

কলকাতায় বাংলাদেশি ও ইলিশ নিয়ে মতামত

ভারতে নিত্য বাড়ছে বাংলাদেশির সংখ্যা। বেশিরভাগ আসছেন চিকিৎসা ভিসায়, অল্প কয়েকজন ভ্রমণ ভিসায়। কলকাতার নিউমার্কেট এলাকায় দেখা মিলছে তাদের। তবে ইলিশ প্রসঙ্গে বেশিরভাগের মত—দেশের স্বার্থ আগে।

ঢাকার যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা মো. আব্দুল করিমের মন্তব্য, ভারতে যেমন পেঁয়াজের সংকট হলে রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়া হয়, তেমনি বাংলাদেশেরও উচিত আগে নিজেদের চাহিদা মেটানো। তিনি প্রশ্ন তোলেন, “দেশে এক কেজি ইলিশ ২৪০০ টাকা, আর রপ্তানিতে দুই কেজির ইলিশ এক হাজার টাকায় কেজিপ্রতি দেওয়া হচ্ছে কেন?” তার মতে, রপ্তানি-আমদানি চলুক, তবে দেশের স্বার্থ অনুযায়ী।

যশোরের শামিম সরদারের অভিমত, প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে গেলে কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দিতে হয়। “এক বিষয়ে ক্ষতি হলে যদি দশ বিষয়ে লাভ হয়, তাহলে তাতে সমস্যা দেখি না। ”

ঢাকার বদরুজ্জামান বলেন, ব্যবসায়ীরা মুনাফার চিন্তা করে, সাধারণ মানুষের নয়। ইলিশ সংরক্ষণযোগ্য নয়, তাই সরবরাহ নির্ভর করে মৌসুমে কতটা ওঠে তার ওপর। “ভারতে ইলিশ এলেও যে দামে খেতে হয়, না এলেও একই দামে খেতে হয়,” মন্তব্য তার।

বাংলায় জালে ওঠেনি ইলিশ, বর্তমান ভরসা গুজরাটের ইলিশ

মোদীর রাজ্য গুজরাট আর দিদির (মমতা) বাংলা। রাজনৈতিক ভাবে চরম বিরোধিতা থাকলেও এই মুহূর্তে ভোজনরসিক বাঙালির রসনা মেটাচ্ছে গুজরাটের ইলিশ। কারণ বাংলার সমুদ্র এবার নিরাশ করেছে। পশ্চিমবঙ্গের জালে জড়ায়নি ইলিশ। ফলে বর্তমান ভরসা গুজরাটের ইলিশ।

তথ্য মতে, গত দুমাসে গড়ে সাড়ে ৪ হাজার মেট্রিক টন, গুজরাটি ইলিশ এসেছে কলকাতায়। স্বাদ মোটামুটি হলেও, চাহিদা থাকার কারণে দাম ছিল সাধ্যের মধ্যে। ফলে  নিম্নআয়ের মানুষ এবার খেতে পারছে ইলিশ। এমনটাই জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গের ফিস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি সৈয়দ আনোয়ার মাকসুদ।

তিনি নিজেও চরম মোদী বিরোধী। তার অভিমত, রাজনীতি ভিন্ন আর ব্যবসা ভিন্ন। ফলে মোদির রাজ্যের ইলিশ বাঙালির পাতে তুলে দিতে দ্বিধা করছেন না মাকসুদ।

বাংলাদেশের আমদানি হওয়া ইলিশ প্রসঙ্গে

তবে বাংলাদেশের আমদানি হওয়া ইলিশের বিষয়ে মাকসুদ বলেছেন, ইলিশ শুধু ব্যবসায়িক কারনে নয়, দুই দেশের সম্পর্কের নিরিখে সেতুবন্ধনের কাজ করে। ধন্যবাদ জানিয়েছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে।

তার অভিমত সাধারণ মানুষ দেশের সঙ্গে ইলিশের যে তুলনা টানছে, তা ঠিক নয়। তারা যেটা দেখছেন তা হলো, একটা খুচরা বাজারের দর, অপরটি পাইকারি দর। পাইকারি আমরা বাংলাদেশের ইলিশ পাব সাড়ে ১২ ডলারে। যা রুপিতে যার পড়ছে এক হাজারের কিছু বেশি। অর্থাৎ বাংলাদেশের দেড় হাজার টাকা। পাইকারি বাজারে বিক্রি হবে ১৫-১৭ ডলারে। খুচরায় তা আরও বাড়বে।

তিনি আরও বলেছেন, তবে সবটাই নির্ভর করছে এ বছর কতটা পাচ্ছি। কম পেলে দাম আরও বেশি বাড়বে, আর বেশি পেলে কমবে। তবে আমার জানা মতে, বাংলাদেশে ইলিশ বেশি ওঠেনি। আর সময়ও কম। সব ঠিক থাকলে কলকাতায় আসতে পারে ১৭-১৮ সেপ্টেম্বর। আবার বন্ধ হয়ে যাবে ৮ অক্টোবরের আগে। ফলে এবার পুরোটা পাবো না এই ভেবেই এগোচ্ছি। তবে যতটা পাব, তাতেই বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞ আমরা। অর্থাৎ ব্যবসা আর রাজনীতি এক নয়।

কলকাতায় বাংলাদেশি ইলিশের দাম হবে আকাশ ছোঁয়া

বাংলাদেশে ইলিশ এলেই ভারতের বাজার চাঙ্গা হয়ে ওঠে। তাতে লক্ষীলাভ হয়, খুচরা থেকে পাইকারি ব্যবসায়ী সবার। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বেশি দাম দিয়ে হলেও বাংলাদেশের ইলিশ একবার কিনে খেতে চান সবাই। সেটাই অর্থ লাভের প্রাপ্তি।

ব্যবসায়ীরা এও জানাচ্ছেন, পূজার মৌসুমে ইলিশের চাহিদা থাকায় ভারতের খুচরা বাজারে কেজি প্রতি, বাংলাদেশের ইলিশ বিক্রি হবে দুই হাজার ২০০ থেকে আড়াই হাজার রুপিতে। বিগত বছরে অনেকক্ষেত্রে এই দামও ছাপিয়ে গিয়েছে। তবে তাতেও বাজার সামাল দেওয়া মুশকিল হয়ে ওঠে।

ফলে দাম আকাশছোঁয়া হলেও, এই মুহূর্তে সবাই এখন চাতকের মতো চেয়ে আছেন বাংলাদেশের ইলিশের দিকে।

এনডি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।