ঢাকা, সোমবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩২, ২১ এপ্রিল ২০২৫, ২২ শাওয়াল ১৪৪৬

ফিচার

মোসাদের সবচেয়ে ক্ষমতাবান নারী আলিজা ম্যাগেন সম্পর্কে আমরা কী জানি

মহিউদ্দীন মোহাম্মদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০২৫
মোসাদের সবচেয়ে ক্ষমতাবান নারী  আলিজা ম্যাগেন সম্পর্কে আমরা কী জানি

ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের ইতিহাসে সবচেয়ে পদোন্নতিপ্রাপ্ত নারী আলিজা ম্যাগেন গত ১৪ এপ্রিল ৮৮ বছর বয়সে মারা গেছেন। তার মৃত্যুর পর, মোসাদ একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে।

সেখানে বলা হয়েছে, আলিজার মৃত্যুতে মোসাদ পরিবার গভীর শোকে মাথা নত করছে। তিনি ছিলেন একজন সম্মানিত পথপ্রদর্শক ও নিবেদিতপ্রাণ কমান্ডার, যিনি ইসরায়েল ও এর নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। আলিজা ছিলেন মোসাদের অন্যতম স্তম্ভ। তিনি এজেন্সি কর্মীদের প্রজন্মের ওপর গভীর ছাপ রেখে গেছেন। এসব কর্মী তার উত্তরাধিকার ও মূল্যবোধ অনুসারে প্রশিক্ষিত ছিলেন।
 
কে এই আলিজা ম্যাগেন
আলিজা ম্যাগেনের পুরোনাম আলিজা ম্যাগেন-হালেভি। তিনি ১৯৫৮ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ইসরায়েলের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি অপারেশন ড্যামোক্লেস, অপারেশন ডায়মন্ড ও অপারেশন র‌্যাথ অফ গড সহ শত শত গোপন অভিযানে অংশ নেন ।

১৯৯০ সালে তাকে মোসাদের উপ-পরিচালক করা হয়। যেটা একটা ইতিহাস। এর আগে সংস্থায় সর্বোচ্চ পদমর্যাদার কোনো নারী অভিসিক্ত হননি। ১৯৯৯ সালে অবসর গ্রহণের আগ পর্যন্ত তিনি তিনজন মোসাদ পরিচালকের অধীনে এই পদে দায়িত্ব পালন করেন।

আলিজা ম্যাগেন ‘দ্য শ্যাডো ওম্যান’ উপাধি অর্জন করেছিলেন। সংস্থায় তিনি তার ৪০ বছরের কর্মজীবনের তথ্য গোপন রেখেছিলেন।

ম্যাগেনের মৃত্যু ঘোষণার পর হিব্রু গণমাধ্যম তার জীবন ও কর্ম সম্পর্কে কিছু বিবরণ উন্মোচন করার চেষ্টা করে। ইসরায়েলি গণমাধ্যম হারেৎজ জানিয়েছে, ম্যাগেন ২৩ বছর বয়সে মোসাদে যোগ দেন।

জীবনের প্রথমভাগ
ম্যাগেন ১৯৩৭ সালে ব্রিটিশ শাসিত প্যালেস্টাইনে জার্মান অভিবাসীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। বেড়ে ওঠেন জেরুজালেমের রেহাভিয়া পাড়ায়। তার বিয়ে হয়েছিল আব্রাহাম ম্যাগেনের সাথে। ২০১১ সালে আব্রাহাম মারা যান। এই দম্পতির কোনো সন্তান ছিল না।

ক্যারিয়ার
আমরা আগেই জেনেছি ১৯৫৮ সালে মোসাদে যোগদানের পর তিনি ইসরায়েল ও বিদেশে শত শত গোপন অভিযানে জড়িত হন। এর মধ্যে আলোচিত কয়েকটি অপারেশন হচ্ছে- 
১৯৬০-এর দশকে পরিচালিত অপারেশন ড্যামোক্লেস। এতে অংশ নিতে তাকে ১৯৬২ সালে অস্ট্রিয়ার সালজবার্গে পাঠানো হয়, যেখানে তিনি একজন জার্মান বিজ্ঞানীকে নিয়োগ করেন। ওই বিজ্ঞানী মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসেরের জন্য কাজ করছিলেন। পরে তিনি জার্মানির মোসাদ স্টেশনে কাজ করেন। ম্যাগেন ইরাকি পাইলট মুনির রেদফাকে নিয়োগের জন্য মোসাদের অপারেশন ডায়মন্ডেও অংশ নেন।

ম্যাগেন-হালেভির মতে, তার প্রতিবেদনগুলি তৎকালীন পরিচালক ইসার হারেলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। হারেল ম্যাগেন-হালেভি ও মোসাদ অফিসার ইয়েহুদিত নেসিয়াহুকে ইয়োসেল শুমাখরকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব দেন, যাকে তার হারেদি অর্থোডক্স ইহুদি দাদা-দাদি অপহরণ করেছিলেন। শুমাখরকে ইসরায়েল থেকে পাচার করেছিলেন মূলত রুথ বেন ডেভিড। তাকে শুমাখরের অবস্থান প্রকাশ করতে রাজি করান। তিনি ১৯৭২ সালের মিউনিখ হত্যাযজ্ঞের পর মোসাদের প্রতিশোধমূলক অভিযান- ‘অপারেশন র‌্যাথ অফ গড’ এ জড়িত ছিলেন।

১৯৮০ সালে ম্যাগেনকে জোমেট শাখার উপ-প্রধান নিযুক্ত করা হয়। তারপর ১৯৮৪ সালে প্রশাসন শাখার প্রধান হন। আলিজা ম্যাগেন ১৯৯০ সালে মোসাদের উপ-পরিচালক নিযুক্ত হন। শাবতাই শাভিট, ড্যানি ইয়াতোম, এফ্রেইম হালেভি- এই তিন মোসাদ পরিচালকের অধীনে কাজ করেছেন।  উপ-পরিচালক হিসেবে ম্যাগেন হামাস নেতা খালেদ মাশালের ব্যর্থ হত্যার পরিকল্পনায় অংশ নেন এবং হিজবুল্লাহ তহবিল সংগ্রহকারী আবদুল্লাহ জেইনের সুইজারল্যান্ডের অ্যাপার্টমেন্টে বাগিং ডিভাইস স্থাপনের অপারেশন অনুমোদন করেন।

১৯৯০-এর দশকে ইসরায়েলের সংবাদপত্র যুদ্ধের অংশ হিসেবে ইয়েদিওত আহরোনোট পরিচালিত একটি প্রোফাইলে তার নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে তাকে জনসমক্ষে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ১৯৯৮ সালের মার্চ মাসে এফ্রেইম হ্যালেভিকে পরিচালক নিযুক্ত করা হলে তাকে উপ-পরিচালক হিসেবে থাকতে বলা হয়েছিল। পরের বছর তিনি অবসর নেন।  

ইসরায়েলি সাংবাদিক মাইকেল বার-জোহার ও নিসিম মিশাল তাদের ২০২১ সালের বই ‘দ্য মোসাদ অ্যামাজনস’- এ যেসব নারী মোসাদ কর্মীর প্রোফাইল তুলে ধরেছিলেন, ম্যাগেন তাদের মধ্যে ছিলেন । এই বইটিতে মোসাদের নারী কমান্ডারদের দুর্ধর্ষ জীবন ও অনেক অজানা কথা প্রকাশ করা হয়েছে। জীবনের পরতে পরতে তাদের সুখ-দুঃখ বর্ণিত হয়েছে বইটিতে।

অপারেশন ড্যামোক্লেস
অপারেশন ড্যামোক্লেস হচ্ছে ১৯৬২ সালের আগস্টে পরিচালিত ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের একটি গোপন অভিযান। এই অভিযানের লক্ষ্য ছিল মিশরের জন্য রকেট তৈরি করা জার্মান বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের লক্ষ্যবস্তু বানানো। এই বিজ্ঞানীরা পূর্বে নাৎসি জার্মানির রকেট প্রোগ্রামে কাজ করতেন এবং মিশরের একটি সামরিক ফ্যাক্টরি ৩৩৩-এ রকেট তৈরি করছিলেন।

ওই বছর জুলাই মাসে মিশরের রকেট কর্মসূচি সফলভাবে একটি রকেট পরীক্ষা চালানোর মাধ্যমে বিশ্বের নজরে আসে। তারপর কায়রোর রাস্তায় দুটি নতুন ধরনের রকেট প্রদর্শন করে, যা বিশ্বব্যাপী আগ্রহ ও বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। ইসরায়েল এই কর্মসূচি নিয়ে ক্রমশ উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে মোসাদ জার্মান বিজ্ঞানী উলফগ্যাং পিলজের লেখা একটি নথি পেতে সক্ষম হন। নথিতে ফ্যাক্টরি ৩৩৩ এর কিছু দিক বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছিল।

ওই বছর ২৭ নভেম্বর রকেট বিজ্ঞানী উলফগ্যাং পিলজের কাছে পাঠানো একটি পার্সেল তার অফিস খোলার সময় বিস্ফোরিত হয়, এতে পাঁচজন নিহত ও তার সচিব আহত হন। অন্যদিকে হেলিওপোলিস রকেট কারখানায় পাঠানো একটি পার্সেলে পাঁচজন মিশরীয় শ্রমিক নিহত হন।  

অপারেশন ড্যামোক্লেস-এ আলিজা ম্যাগেনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই অপারেশনের মূল উদ্দেশ্য ছিল মিশরের রকেট কর্মসূচির সাথে যুক্ত জার্মান বিজ্ঞানীদের কার্যক্রম ব্যাহত করা। আলিজা ম্যাগেনকে অস্ট্রিয়ার সালজবার্গে পাঠানো হয়েছিল। তার দায়িত্ব ছিল সেই জার্মান বিজ্ঞানীদের মধ্যে একজনকে নিয়োগ করা, যিনি মিশরের রাষ্ট্রপতি জামাল আবদেল নাসেরের অধীনে কাজ করছিলেন।

আলিজা ম্যাগেন তার দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে সেই বিজ্ঞানীকে মোসাদের পক্ষে কাজ করতে রাজি করান। এই নিয়োগ অপারেশন ড্যামোক্লেসের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ এর মাধ্যমে মোসাদ মিশরের রকেট কর্মসূচি সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন এবং বিজ্ঞানীদের কার্যক্রমকে দুর্বল করতে সক্ষম হয়েছিল।

তিনি একজন মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা হিসেবে সরাসরি এই অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন এবং মোসাদের লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলেন। তার এই কাজের মাধ্যমেই মোসাদের ইতিহাসে তিনি একজন প্রভাবশালী নারী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত হন।

অপারেশন ডায়মন্ড
মুনির রেদফা ছিলেন একজন ইরাকি ফাইটার পাইলট। তিনি ১৯৬৬ সালে ‘অপারেশন ডায়মন্ড’ নামক একটি মোসাদের অভিযানে ইরাকি বিমান বাহিনীর একটি মিগ-২১ ফাইটার জেট নিয়ে ইসরায়েলে পালিয়ে যান।

ইসরায়েলি মোসাদের নজর ছিল মিগ-২১ যখন মধ্যপ্রাচ্যে প্রথমবারের মতো যুদ্ধে প্রবেশ করেছিল তখন থেকেই। এটি ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে উন্নত সোভিয়েত যুদ্ধবিমান। তাদের এটি থাকা জরুরি ছিল, তাই তারা মিগ-২১ চুরি করার লক্ষ্যে অপারেশন ডায়মন্ড শুরু করে।

অপারেশন ডায়মন্ড ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ-এর একটি উল্লেখযোগ্য মিশন, যা এই সংস্থাটিকে বিশ্বের সামনে আরো ভয়ংকর করে তুলেছে।

আগেই বলেছি, এই মিশনের মূল লক্ষ্য ছিলো সোভিয়েতের তৈরি মিগ-২১ অর্জন করা, কারণ তৎকালীন সময়ে সবচেয়ে অত্যাধুনিক জেট ফাইটার এটা।  

একজন ইরাকি খ্রিস্টান পাইলট মুনির রেদফা বিমানবাহিনী কর্তৃপক্ষের ওপর নাখোশ ছিলেন। কারণ তিনি জানেন জন্মসূত্রে খ্রিষ্টান হওয়ায় তার পদোন্নতি আটকে রয়েছে, এ ছাড়া আরও কিছু বিষয়ে ক্ষুব্ধ ছিলেন। কারণ তাকে ইরাকি কুর্দীদের আক্রমণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো।  

তখন একজন নারী মোসাদ এজেন্টকে লেলিয়ে দেওয়া হয়। তার নাম আলিজা ম্যাগেন। মুনীরকে এক মিলিয়ন ডলার সাথে ইসরায়েলি নাগরিকত্ব প্রদানের প্রস্তাব হয়। একইভাবে তার পরিবারকেও ইসরায়েলে সরিয়ে নিতে রাজি হয় মোসাদ।

প্লেন চুরির সোনালি সুযোগ আসে ১৯৬৬ সালের ১৬ আগস্টে। ট্রেনিংয়ের বাহানায় বিমান নিয়ে তিনি পাড়ি জমান ইসরায়েলে। ইসরায়েলে পৌছানোর পরপরই বিমানটির রং চেঞ্জ করে নাম্বার দেওয়া হয় ০০৭।  

মোসাদ এজেন্টরা তাকে ইসরায়েলে মিগ-২১ নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করে। এর বিনিময়ে তাকে ১ মিলিয়ন ডলার, ইসরায়েলি নাগরিকত্ব এবং পূর্ণ-সময়ের চাকরির প্রস্তাব দেওয়া হয়।

মোসাদ তার স্ত্রী, দুই সন্তান, বাবা-মা এবং অন্যান্য আত্মীয়দের নিরাপদে ইরাক থেকে ইসরায়েলে পাচার করে।

এই মিগ-২১ ইসরায়েল এবং পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পরীক্ষা করা হয়। এর প্রযুক্তি সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এই জ্ঞান ভবিষ্যতে আরব মিগ-২১ এর সাথে ইসরায়েলের বিমান বাহিনীর মোকাবিলায় সহায়ক ছিল।

অপারেশন র‌্যাথ অব গড 
এটি ছিল ১৯৭২ সালের মিউনিখ অলিম্পিকে ১১ জন ইসরায়েলি ক্রীড়াবিদের হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মোসাদের একটি গোপন অভিযান। এই অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ নামক স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা করা, যারা মিউনিখ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে জড়িত ছিল বলে ইসরায়েল দাবি করে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার এই অভিযানের অনুমোদন দেন।  

অপারেশন র‌্যাথ অব গডের সময়কাল বেশ কয়েক বছর ধরে বিস্তৃত ছিল এবং এর মধ্যে বিভিন্ন দেশে বেশ কয়েকটি গুপ্তহত্যা সংঘটিত হয়।  

অপারেশন র‌্যাথ অব গড ইসরায়েলের একটি বিতর্কিত পদক্ষেপ ছিল। সমালোচকরা এটিকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ এবং বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হিসেবে গণ্য করেন।  

আইখম্যান পাকড়াও অভিযান
অ্যাডলফ আইখম্যান ছিলেন একজন জার্মান লেফটেন্যান্ট কর্নেল ও হলোকস্টের অন্যতম প্রধান সংগঠক। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান-অধিকৃত পূর্ব ইউরোপের গেটো এবং এক্সারমিনেশন ক্যাম্পে লাখ লাখ ইহুদিকে নির্বাসনের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন।

যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর, আইখম্যান আর্জেন্টিনা পালিয়ে যান এবং ‘রিকার্ডো ক্লেমেন্ট’ ছদ্মনামে বসবাস করতে থাকেন। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ১৯৬০ সালের মে মাসে তাকে বুয়েনস আইরেস থেকে অপহরণ করে ইসরায়েলে নিয়ে আসে।

জেরুজালেমে তার বিচার হয় এবং ১৯৬২ সালে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ এবং ‘ইহুদি জনগণের বিরুদ্ধে অপরাধ’-এর জন্য তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আইখম্যানকে শেষ পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় এবং তার দেহাবশেষ পুড়িয়ে সমুদ্রে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। আইখম্যান পাকড়াও অভিযানে বিশেষ ভূমিকা রাখেন আলিজা ম্যাগেন।

অ্যাডলফ আইখম্যানের বিচার বিশ্বব্যাপী মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং হলোকস্টের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করে।

আলিজার ক্যারিয়ারে ব্যর্থতা
আলিজা ম্যাগেন তার ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ পদমর্যাদার সময়কালে কিছু চূড়ান্ত ব্যর্থতার সাথেও জড়িত ছিলেন। বিশেষ করে ১৯৯৭ সালে জর্ডানে খালেদ মাশাল হত্যা চেষ্টা। ঘটনাটি জনসম্মুখে উন্মোচিত হয়েছিল। আর এটি গুরুতর কূটনৈতিক সংকটের দিকে পরিচালিত করেছিল।

খালেদ মাশাল হত্যা চেষ্টা
১৯৯৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তার নিরাপত্তা মন্ত্রিসভার নির্দেশে মোসাদের এজেন্টরা খালেদ মাশালকে হত্যার চেষ্টা করে। এজেন্টরা ভুয়া কানাডিয়ান পাসপোর্টে ও পর্যটকের ছদ্মবেশে জর্ডানে প্রবেশ করে। তাদের মধ্যে দুজন জর্ডানের রাজধানী আম্মানে হামাসের অফিসের প্রবেশদ্বারে অপেক্ষা করতে থাকে। মাশাল যখন তার অফিসে প্রবেশ করতে যাবে, তখন তাদের মধ্যে একজন পেছন থেকে এসে মাশালের বাম কানে একটি ডিভাইস দিয়ে অভিনব বিষ প্রয়োগ করে। হামলার আগে মাশালের দেহরক্ষীর কাছে তাদের গতিবিধি সন্দেহজনক ছিল এবং এজেন্টদের তাড়া করতে ও তাদের ধরতে সক্ষম হয়। এক সাক্ষাৎকারে তিনি এই হামলা সম্পর্কে বলেন, আমার কানে প্রচণ্ড আওয়াজ হয়... যা দড়াম শব্দ ও বৈদ্যুতিক শকের মতো বলে বর্ণনা করেছেন।  

প্রাথমিকভাবে, মাশাল ভেবেছিলেন এজেন্টরা তাকে আঘাত করতে ব্যর্থ হয়েছে, তবে পরে তিনি তীব্র মাথা ব্যথা অনুভব ও বমি করতে শুরু করেন। তাকে জর্ডানের একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়; যেখানে তার অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে।

ঘটনার পরপরই জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় হুসেইন নেতানিয়াহুকে বিষের প্রতিষেধক হস্তান্তরের দাবি জানান, কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার এবং আটক মোসাদের এজেন্টদের বিচারের হুমকি দেন। বাদশাহ হুসেইন আশঙ্কা করেছিলেন যে হামাসের একজন নেতার মৃত্যু তার দেশে দাঙ্গা সৃষ্টি করবে, এমনকি গৃহযুদ্ধও। নেতানিয়াহু সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করে এবং ঘটনাটি দ্রুত রাজনৈতিক সংকট তৈরি করে। ইসরায়েল-জর্ডান সম্পর্কের দ্রুত অবনতির সাথে সাথে বাদশাহ হুসেইন হুমকি দিয়েছিলেন মাশাল মারা গেলে দুই দেশের মধ্যে ১৯৯৪ সালের ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি বাতিল করা হবে। এ ঘটনায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন হস্তক্ষেপ করে ও নেতানিয়াহুকে প্রতিষেধক ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করেন।

মোসাদের প্রধান ড্যানি ইয়াটম নেতানিয়াহুর সম্মতি নিয়ে জর্ডানে উড়ে যান ও মাশালের চিকিৎসার প্রতিষেধক নিয়ে আসেন। যেখানে মাশাল কোমায় ছিলেন সেই কিং হুসেন মেডিকেল সেন্টারের চিকিৎকরা, মাশালের লক্ষণগুলো ওপিওয়েড ওভারডোজের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে পর্যবেক্ষণ করেন। ডাক্তারদের প্রতিষেধক প্রয়োগ করার ফলে মাশালের জীবন বেঁচে যায়।

অভ্যন্তরীণ আইডিএফ সূত্রের ভিত্তিতে রোনেন বার্গম্যানের বলেন যে, মাশালের প্রতিষেধক কেবল মাত্র মোসাদ কিডন (স্পেশাল এলিট) এজেন্টকে মুক্তি দিয়েছে, যারা হত্যার চেষ্টা করেছিল। অভিযানে জড়িত মোসাদের আরও অন্তত ছয় জন এজেন্ট ইসরাইল দূতাবাসে লুকিয়ে ছিলেন। ইসরায়েল আহমেদ ইয়াসিন এবং অন্যান্য বিপুল সংখ্যক ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দিলেই বাদশাহ হুসেইন তাদের মুক্তি দেবেন।

ইসরায়েল এই দাবির প্রতি সাড়া দেয় এবং হামাসের আধ্যাত্মিক নেতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনকে মুক্তি দেয়। যদিও সাত বছর পর গাজায় তাকে হত্যা করা হয়েছিল।

২০০৮ সালের একটি সাক্ষাৎকারে, মাশাল তার জীবনের হত্যা প্রচেষ্টা সম্পর্কে বলেছিলেন, এই ঘটনা আমাকে জীবন সম্পর্কে আরও ইতিবাচক করে তুলেছে। মৃত্যুর মুখে আমি আরও সাহসী হয়ে উঠেছি। আমার বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়েছে যে একজন মানুষ তার সময় না আসা পর্যন্ত মারা যায় না। অর্থাৎ আল্লাহ যখন সিদ্ধান্ত নেবেন, তখন আমি মরব, মোসাদ যখন সিদ্ধান্ত নেবে তখন নয়। এটি আমাকে আমার দায়িত্ব পালনে আরও দৃঢ় করে তুলেছে।

মাশালের ওপর ব্যর্থ হত্যাচেষ্টার এক বছর পর অর্থাৎ ১৯৯৮ সালে মোসাদ এজেন্টরা সুইজারল্যান্ডের বার্নের কাছে সন্দেহভাজন হিজবুল্লাহ সদস্যের দখলে থাকা একটি অ্যাপার্টমেন্টে আড়িপাতার ডিভাইস স্থাপনের চেষ্টা করার সময় ধরা পড়ে। সেই ঘটনার এক বছর পর ম্যাগেন অবসর নেন।

ক্লায়েন্ট শিকার নিয়ে স্বীকারোক্তি 
ছয় বছর আগে কান ১১-তে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে, ম্যাগেন মোসাদে তার কার্যকলাপ সম্পর্কে কথা বলেছিলেন। তার কাজ সম্পর্কে বলতে গিয়ে দাবি করেন, আমরা আরব এজেন্ট নিয়োগের জন্য ইসরায়েলি নারীদের যৌন সম্পর্কে বাধ্য করিনি। আমি অন্য উপায় ব্যবহার করেছি, আমি আমার মস্তিষ্ক ব্যবহার করেছি। মোসাদের জন্য কর্মরত একজন মহিলা কীভাবে একজন ক্লায়েন্টকে নিয়োগ করেন জানতে চাইলে তিনি উত্তর দেন, আপনি তাকে একজন আকর্ষণীয় ব্যক্তি হিসেবে মূল্যায়ন করেন, তাকে অধ্যয়ন করেন এবং তার দুর্বলতাগুলি পরীক্ষা করেন। আর এগুলো হচ্ছে- আর্থিক অনটন, ব্যক্তিগত হতাশা, অথবা তার স্ত্রী বা স্বামীর সাথে সমস্যা। আপনি একটি ক্যাফে বা হোটেলে তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন, তার সাথে একটু কথা বলেন, তাকে যোগাযোগ করতে বলেন এবং তারপর তার সাথে সংযোগ স্থাপন করেন।

ম্যাগেন সেই সময় উল্লেখ করেছিলেন, ক্লায়েন্ট নিয়োগে তাকে যা দক্ষ করে তুলেছিল তা হলো তার সহানুভূতিশীল হওয়ার ও রাজি করানোর ক্ষমতা।

সংস্থার করা ভুল সম্পর্কে তিনি বলেন, আমাদের সংস্থা তার ভুলের জন্য বিখ্যাত, তবে সাফল্যের জন্য নয়। তিনি আরও উল্লেখ করেন, এই হত্যাকাণ্ডগুলো মোসাদের কার্যকলাপের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র।

[ আল-শারক আল-আওসাতসহ কয়েকটি আরবি গণমাধ্যম ও অন্তর্জাল ঘেঁটে লেখাটি প্রস্তুত করা]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।