ঢাকা, বুধবার, ৮ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৩ জুলাই ২০২৫, ২৭ মহররম ১৪৪৭

ফিচার

শরৎ-এ চলনবিলের তাড়াশ

লিয়াকত হোসেন খোকন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪:৩৮, আগস্ট ২৭, ২০১২
শরৎ-এ চলনবিলের তাড়াশ

ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। এই বাংলায় ভাদ্র-আশ্বিন দুই মাস নিয়ে শরৎকাল।

এই শরৎ-এ বিল অঞ্চলে বেড়াতে গিয়ে বেশ আনন্দ মেলে। বিল অঞ্চলের একটু উঁচু অনাবাদী জমিতে কাশফুল দিনভর শুধু দুলতে থাকে।

এই কাশ বনের পাশ দিয়ে যদি রেলগাড়ি চলতে থাকে তাহলে তো কথাই নেই। তখন মনের কোণে এসে জেগে উঠবে ‘কাশের বনে ঢেউ খেলিয়ে তুফান মেল যায়, তুফান মেল যায়’ গানের কথাগুলো। এই শরৎ-এ   বেড়ানোর জন্য চলনবিলের তাড়াশ, গুরুদাসপুর কিংবা এর আশপাশের এলাকা বেছে নিতে পারেন।

শরৎ-এ চলনবিলের তাড়াশের রূপের কোন তুলনা নেই। গাছে গাছে কত না ফুল। কামিনী, কদম, শিউলি, হাসনাহেনা ফুটে সুগন্ধ ছড়াচ্ছে দিনে-রাতে সমানে। শরৎ-এ ছায়াঢাকা মায়ামাখা তাড়াশ যেন একখানি ছবি।

ছবির মতো রূপ দেখে আপনার মনে জেগে উঠবে-  ‘হেরিনু শারদ প্রভাতে / হে মাত বঙ্গ! শ্যামল অঙ্গ / ঝলিছে অমল শোভাতে / পারে না বহিতে নদী জল ভার / মাঠে মাঠে ধান ধরে নাক আর / ডাকিছে দোয়েল গাহিছে কোয়েল / তোমার কানন সভাতে’ কবিতার এই চরণগুলো।

বেড়াবেন : তাড়াশের আশপাশে রয়েছে নদনদী, খালবিল। এ সবকিছুই বয়ে গেছে চলনবিলের ওপর দিয়ে। শরৎ-এ বিল অঞ্চল জলে থৈ-থৈ করে। আকাশ কখনও সাদা রং ধারণ করে। আত্রাই, গুড় নদী, বরনাই নদী, বড়াল নদী, তুলসী নদী, চেঁচুয়া নদী, ভাদাই নদী এসব তো বয়ে গেছে চলনবিলের ওপর দিয়ে। মেঘ গর্জন করলেই অঝোর ধারায় নেমে আসে বর্ষণধারা। তখন নৌকা ভাড়া করে দূরে, বহু দূরে চলে যেতে পারেন।

এভাবে বেড়াতে চাইলে কয়েক বন্ধু মিলে গেলে ভালো হয়। চলনবিলে নৌকায় ৩ থেকে ৪ রাত কাটিয়ে দারুণ আনন্দ উপভোগ করা যায়। নৌকা যখন কোনো তীরে এসে ভিড়বে, তখন দেখবেন সাদা কাশফুল। সুযোগ পেয়েছে কাশেরা, পুরো এলাকা জুড়েই বসতি গেড়েছে। কাশবনে পাখিরা সকাল-বিকাল আড্ডা দেয়। মন তখন আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠবে।

মনে জেগে উঠবে,     বর্ষার জল সরিয়া গিয়াছে জাগিয়া উঠেছে চর / গাঙ-শালিকেরা গর্ত খুঁড়িয়া বাঁধিতেছে সবে ঘর / গহিন নদীর দুই পার দিয়া আঁখি যায় যত দূরে / আকাশের মেঘ অতিথি যেন গো তাহার আঙিনা জুড়ে‘ কবিতার এই চরণগুলো।

তিন  থেকে ৪ দিনের জন্য নৌকা ভাড়া নেবে ২ হাজার টাকা। রান্নাবান্না হবে নৌকাতেই। সে কি আনন্দ! শরৎ-এ আকাশ মেঘলা হয়ে উঠলে তো বৃষ্টি নেমে আসবেই। তখন বিলের রূপ আরো অপরূপ হয়ে ওঠে।

কোনো তীরে নেমে মাটিতে পা রেখে কাছ থেকে দেখা হবে শিউলি ফুল। আহা! তখন তো মনে পড়বেই, ‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা, নবীন ধানের মঞ্জরি দিয়ে সাজায়ে এনেছি বরণডালা...’ কবিতার এই চরণগুলো।

বারুহাস : তাড়াশের কাছেপিঠে বারুহাস গাঁওখানি প্রাচীন ও জমিদারপ্রসিদ্ধ গ্রাম। এখানে গিয়ে একটি ইমামবাড়ার ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাবেন। শুনবেন, এটি শাহ সুজার আমলে নির্মিত হয়েছিল। এখানে একজন দরবেশের মাজার আছে বলে অনেকেই বিশ্বাস করেন। তিনি এখানে বসে উপাসনা করতেন।

পঙ্খিরাজ ঘোড়ার পিঠে তরবারি হাতে মানুষের ছবি বাংলোটির গায়ে থাকায় এটি মুসলিম কীর্তির নিদর্শন বলে অনেকে মনে করেন। মোগল আমলে ইমাম-মোয়াজ্জেমের হুজরাখানার জন্য এরূপ বাংলো নির্মিত হয়েছিল বলে জানা যায়। চৈত্র মাসের উদিত চাঁদের পূর্ণিমার দিন বারুহাস গ্রামে বিরাট মেলাও বসে।

বারুহাস গাঁয়ে ঘুরতে ঘুরতে যদি শেফালি গাছের তলে আসেন, তখন ঝকমকে আকাশ, ঝলমলে রোদ খুঁজে পেলে তো কথা নেই। আকাশে তাকিয়ে দেখুন না। হয়তো দেখবেন, শরতে সারা আকাশে শুভ্র পেজা তুলার মতো বারিহারা মেঘের অবিরাম ছোটাছুটি চলছে।

 যা দেখবেন : তাড়াশে দর্শনীয় স্থানের অভাব নেই। এখানকার অন্যতম আকর্ষণ রাধা গোবিন্দ মন্দির, রশিক মন্দির, শিব মন্দির, বড় কুঞ্জবন দীঘি, উলিপুর দীঘি, মথুরা দীঘি, মাকরসন দীঘি।

এসব ঘুরে ঘুরে দেখুন। শরৎ-এর শেষ দিকে শুরু হয় দুর্গাপুজো। তখন তো এখানকার গোবিন্দ মন্দিরে বাজে ঢোল-বাদ্য, আকাশে ওড়ে ফানুশ।

কীর্তন গানে মুখরিত হয় তাড়াশের আকাশ-বাতাস। আর তাড়াশের চারদিকে ফুটে থাকে কত না কাশফুল! তাড়াশে বেড়াতে গিয়ে জানবেন, এখানকার কপিলেশ্বর শিব মন্দির, কালিকা দেবীর মন্দির, বাসুদেব ও গোপীনাথ বিগ্রহের মন্দির বিখ্যাত।

তাড়াশ রাজবংশের পূর্বপুরুষ বলরাম রায় প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি মন্দির, কুঞ্জবন নামক সর্ববৃহৎ জলাশয় এবং তাড়াশের রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ  প্রাচীন কীর্তির নিদর্শন।

তাড়াশের ভগ্নপ্রায় জোড় বাঙ্গালার গায়ে ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দের খোদিত লিপি থেকে জানা যায়, এখানকার গোপীনাথ বিগ্রহের সেবায়েত ছিলেন নাগবংশীয় কায়স্থ।

এই তাড়াশে বিনোদ রায়, গোবিন্দজী, রশিক রায়, কপিলেশ্বর শিব প্রভৃতি যে কয়টি বিগ্রহের মন্দির আছে, এর মধ্যে কপিলেশ্বর শিব মন্দির অন্যতম। এসব দেখতে দেখতে ফিরে যাবেন অতীত যুগে। অতীত যুগে ফিরে যাওয়া মানেই নস্টালজিয়ায় ভোগা।

তখন স্মৃতিতে ভেসে উঠবে হয়তোবা পুজো পার্বণের সেই দিনগুলোর কথা। দেখবেন, এখানকার প্রতিটি মন্দিরের গায়ে রয়েছে অপরূপ কারুকাজ। প্রাচীনকালে ক্ষুদ্র ইট দিয়ে এসব মন্দির তৈরি হয়েছিল।

তাড়াশে গিয়ে এর নামকরণ কীভাবে হলো এ নিয়েও কৌতূহল জাগবে! একদা তাড়াশের নাম শুনেই মনে ত্রাস বা তরাসের সৃষ্টি হতো। অনেকেই অনুমান করেন, ‘তরাস’ শব্দ থেকেই তাড়াশ নামের উৎপত্তি হয়েছে। তাড়াশের কাছে পিঠে বিনসারা গাঁও। রিকশা নিয়ে বিনসারায় যেতে পারেন।

জানবেন, কিংবদন্তির বেহুলা সুন্দরীর বাবা বাছো বানিয়া ওরফে সায় সওদাগরের বাস ছিল এখানে। বিনসারায় গিয়ে কয়েকটি কূপ দেখবেন। একটি কূপের নাম ‘জীয়ন কূপ’। এই কূপটি বড় অদ্ভুত ধরনের। বড় বড় আগলা ইটের গাঁথুনি দিয়ে এটি নির্মিত। ওখানে গিয়ে লোকমুখে আরও জানবেন, বাছো বানিয়া মনসা পূজারী ছিলেন।

‘দুধপুকুর’ নামে তার একটি পুকুর ছিল। পুকুরটি সাপদের জন্য নাকি দুধে ভর্তি থাকত। এখনও আছে দুধপুকুর, তবে সেখানে দুধ নেই, সাপও নেই। দুধপুকুর দেখার সময় তবুও কেন জানি ভয় ভয় লাগবে। সাপ না দেখলেও এখানকার জঙ্গলে দিনে লুকিয়ে থাকে কত না সাপ, যা কিনা রাতের বেলা বের হয়ে আসে।

এখানে বেড়াতে এসে চারদিকের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে পড়বেন। তখন হৃদয়ে জেগে উঠবে কবির লেখা, ‘শরৎ, তোমার শিশির-ধোয়া কুলে / বনের পথে লুটিয়ে পড়া অঞ্চলে / আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি...’ কবিতার এই চরণগুলো।

যেখানে থাকবেন : তাড়াশে রাতযাপন করার জন্য ডাকবাংলো রয়েছে। এক কক্ষে ২টি সিটে দৈনিক ভাড়া ১০০ টাকা। তাড়াশ থানার কাছেই ডাকবাংলো। এ ছাড়া গণকল্যাণ সংস্থা এবং সরকারি বিভিন্ন বিভাগের ভিআইপি রুম রয়েছে।

যেভাবে যাবেন : ঢাকা থেকে সড়কপথে বাসে তাড়াশ যেতে হবে। রাজশাহীগামী এনপি এলিগেন্স কিংবা ন্যাশনাল পরিবহনে উঠে মহিষলুপিতে নামুন। মহিষলুপি থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে তাড়াশ। ভ্যানগাড়িতে ৪ যাত্রী ওঠানো হয়। জনপ্রতি ভাড়া নেয়া হয় ১০ টাকা। আর ঢাকা থেকে বাসে মহিষলুপি পর্যন্ত ভাড়া নেয়া হয় ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা।

যেখানে খাবেন : খাওয়া-দাওয়ার জন্য তাড়াশে ভালো রেস্টুরেন্ট হলো শুভ হোটেল। রুই কিংবা কাতল মাছ দিয়ে একবেলা খেতে খরচ পড়বে ৭০ থেকে ৮০ টাকা। এতে পাবেন ২ প্লেট ভাত, ১টা ডাল ও এক টুকরা রুই মাছ, সঙ্গে থাকবে যে কোনো একটা তরকারি।

যদিওবা তখন কেউ শেফালি ফুলের মালা নিয়ে এসে দাঁড়ান, তবে তো ভ্রমণ হয়ে উঠবে আরও সার্থক। তখন কি মনে পড়বে না, ‘শিশিরসিক্ত শেফালি ফুল ঘন সৌরভে মাতি / শরৎ প্রভাতে সখিগণ সাথে আনিয়াছি মালা গাঁথি’ কবিতার ওই চরণদুটি।

খরচ : তাড়াশ এবং এর পাশে বেড়ানোর জন্য এক সপ্তাহ সময় হাতে নিয়ে যাবেন। এ ভ্রমণে জনপ্রতি ২ হাজার টাকা করে নিয়ে গেলেই চলবে। তবে একত্রে ৪ থেকে ৫ জন বন্ধু মিলে গেলে ভালো হয়। তাহলে শরৎ ঋতুতে চলনবিলের তাড়াশে গিয়ে ভ্রমণের দিনগুলো বড়ই আনন্দে কাটবে।

বাংলাদেশ সময় : ১২৩৩ ঘণ্টা, আগষ্ট ২৭, ২০১২
সম্পাদনা : সুকুমার সরকার, কো-অর্ডিনেশন এডিটর  
kumar.sarkerbd@gmail.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।