ইরানের ফার্স প্রদেশের মোরগাব সমভূমি। চারপাশে বিস্তৃত নীরবতা, দূরে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রেখা,আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সাদামাটা অথচ মহিমান্বিত এক সমাধি।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে নির্মিত পাসারগাদ ছিল পারস্যের আকেমেনীয় সাম্রাজ্যের প্রথম রাজধানী—যা ‘কুরুশ’ বা ‘সাইরাস’-এর নির্দেশে তৈরি করা হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে সাইরাস নিহত হওয়ার এর নির্মাণকাজ থেমে যায়। বর্তমানে পাসারগাদে অবস্থিত সাইরাসের সমাধি— এই অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন।
শিরাজ-ইসফাহান মহাসড়ক থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার পশ্চিমে সমাধিটি অবস্থিত। চুনাপাথর ও মাটি দিয়ে নির্মিত এই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানকে ২০০৪ সালে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করা হয়।
সাইরাসের গুণে মুগ্ধ ছিলেন স্বয়ং আলেকজান্ডার!
সাইরাসের স্বপ্ন ও রাজধানীর যাত্রা
পাসারগাদ প্রতিষ্ঠার গল্প আসলে ‘সাইরাস দ্য গ্রেট’-এর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার কাহিনীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। তিনি যখন মিডিয়া, লিডিয়া ও ব্যাবিলনের মতো শক্তিশালী সাম্রাজ্য জয় করে বিশাল ভূখণ্ডকে একত্রিত করেন, তখন একটি কেন্দ্রীয় রাজধানীর প্রয়োজন অনুভব করেন। সেই রাজধানী শুধু প্রশাসনিক কেন্দ্রই হবে না, বরং এক নতুন সভ্যতার প্রতীক হবে— এমন স্বপ্ন থেকেই পাসারগাদের জন্ম।
শহরের পরিকল্পনায় দেখা যায় নিখুঁত স্থাপত্যশৈলী ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার ছাপ। সুবিশাল রাজপ্রাসাদ, মনোমুগ্ধকর বাগান, প্রশাসনিক ভবন ও সামরিক স্থাপনা দিয়ে সজ্জিত ছিল পাসারগাদ। এখানেই প্রথম দেখা যায় সেই অনন্য পার্সিয়ান বাগান নকশা, যা পরে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং মুঘল ভারতের শালিমার বাগান থেকে শুরু করে স্পেনের আলহাম্ব্রা পর্যন্ত ছাপ রেখে গেছে।
সেই সাম্রাজ্যই প্রথম বহুসাংস্কৃতিক বিশ্বশক্তি, যার সীমান্ত বিস্তৃত ছিল ভূমধ্যসাগর থেকে মিশর হয়ে ভারতের সিন্ধু নদ পর্যন্ত। এই রাজধানীই ছিল সেই বিশাল সাম্রাজ্যের হৃদস্পন্দন।
সুবিশাল সাম্রাজ্য রেখে যান সাইরাস দ্য গ্রেট
সাইরাসের সমাধি: নীরব রক্ষক
পাসারগাদের সবচেয়ে বিখ্যাত স্থাপনা হলো ‘সাইরাস দ্য গ্রেট’-এর সমাধি। এটি সাধারণ চুনাপাথরের তৈরি হলেও, তার স্থাপত্যশৈলীতে অদ্ভুত মর্যাদার ছাপ রয়েছে। ছয় ধাপবিশিষ্ট সোপান বা প্ল্যাটফর্মের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা আয়তাকার সমাধিটি দূর থেকেই নজর কাড়ে। ইতিহাসবিদদের মতে, সমাধির ভেতরে সাইরাসের সোনার পালঙ্ক ও রাজকীয় সামগ্রী রাখা ছিল। যদিও কালের প্রবাহে অনেক কিছু হারিয়ে গেছে, তবু সমাধি আজও এক মহাজাগতিক শান্তি ও শ্রদ্ধার বার্তা বহন করে।
গ্রিক ইতিহাসবিদ অ্যারিয়ান লিখেছেন, ‘আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট’ যখন পারস্য জয় করেন, তিনি সাইরাসের সমাধি দেখে গভীর শ্রদ্ধায় নত হন এবং নির্দেশ দেন যেন এর কোনো ক্ষতি না করা হয়। সেই মুহূর্ত থেকেই বোঝা যায় সাইরাস কেবল পারস্যের নয়, সমগ্র মানবজাতির ইতিহাসে কীভাবে এক বিশ্বনেতায় পরিণত হয়েছিলেন।
সর্বোচ্চ সৌন্দর্য দিয়ে সাজানো হয়েছিল রাজধানী পাসারগাদকে
স্থাপত্য ও প্রকৌশল
পাসারগাদের স্থাপত্যে একটি মিশ্র রূপ লক্ষ্য করা যায়। এখানে পারস্যের নিজস্ব ঐতিহ্যের পাশাপাশি আনাতোলিয়া ও মেসোপটেমিয়ার প্রভাব বিদ্যমান। বিশাল প্রাসাদগুলোর স্তম্ভ, খোদাই করা পাথর ও বাগানের পরিকল্পনা থেকে বোঝা যায় যে, প্রকৌশলীরা কতটা অগ্রসর ছিলেন। বিশেষ করে জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছিল বিস্ময়কর, যা পারস্যের শুষ্ক জলবায়ুতে এক টুকরো সবুজ স্বর্গ রচনা করেছিল।
রাজপ্রাসাদ ও চহরবাগ
তিন হাজার ৪০০ বর্গমিটারেরও বেশি আয়তনের এই প্রাসাদের ভেতরে ছিল পাথরের নালা ও ছোট ছোট পুকুর। প্রবেশপথে সাইরাসের নাম খোদাই করা ফলক এবং ত্রিভাষিক (প্রাচীন ফারসি, এলামি ও ব্যাবিলনীয়) শিলালিপি পাওয়া গেছে—যেখানে লেখা: “আমি সাইরাস, আকেমেনীয় শাসক। ”
পাসারগাদের প্রাসাদসমূহ ও ‘চহরবাগ’ বা চারভাগে বিভক্ত উদ্যান আজও প্রত্নতত্ত্ববিদদের মুগ্ধ করে। স্রোতবাহী জলপথ ও পথচারী রাস্তা দিয়ে চারদিকে ভাগ করা এ নকশাই পরবর্তীতে ‘পারস্য উদ্যান’-এর আদর্শ হয়ে ওঠে।
রাজকীয় কমপ্লেক্সে ছিল ফটক, দরবার হল, আবাসিক প্রাসাদ এবং উদ্যান। সেই নকশার সরলতা ও শৌর্য মিশে গেছে সূক্ষ্ম শৈল্পিক কারুকাজে। পূর্বদিকের একটি দেয়ালে খোদাই করা আছে ডানাওয়ালা এক মানুষের ছবি, যা আকেমেনীয় শিল্পকলার প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে ধরা হয়। এটি শুধু একটি রাজধানী ছিল না, বরং ছিল স্থাপত্য ও প্রকৃতির এক অনন্য সংলাপ।
ধর্মীয় ক্ষেত্রে বিস্ময়কর উদারতা দেখান সাইরাস
তাল-এ তাখত: সোলায়মানের সিংহাসন
পাসারগাদের পশ্চিম ঢালে অবস্থিত ‘টাল-এ তাখত’ বা ‘সোলায়মানের সিংহাসন’ নামে একটি বিশাল পাথরের প্ল্যাটফর্ম, যা সাইরাস দ্য গ্রেটের আমলে নির্মাণ শুরু হলেও অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। ধারণা করা হয়, এটি পরবর্তী পার্সেপোলিসের প্রাসাদ নির্মাণে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। পরে দারিউসের শাসনামলে এখানে কাদামাটির ইটের দুর্গ তৈরি হয়, যা আকেমেনীয় যুগ থেকে শুরু করে সেলিউকাসদের শাসনামল পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়েছিল।
গবেষকরা মনে করেন, এটি ছিল পাসারগাদের ভাণ্ডারঘর, যা ৩৩০ খ্রিস্টপূর্বে অ্যালেকজান্ডারের হাতে অক্ষত অবস্থায় আত্মসমর্পণ করে। সেলিউকাস সাম্রাজ্যের পতনের পর স্থানীয় বিদ্রোহ ও স্বল্পকালীন ফ্রাটাদারা শাসনকালে এটি আবার ব্যবহৃত হয়। পাহাড়ের চূড়ায় সীমিত বসতির চিহ্ন থেকে ধারণা করা হয়, এখানে একটি প্রাচীন সুরক্ষিত ইসলামি বসতি গড়ে উঠেছিল, যা সম্ভবত সপ্তম ও অষ্টম খ্রিস্টাব্দে সমৃদ্ধ হয়েছিল। দুর্গনগরীর কাদামাটির ইটের প্রাচীর আজ ক্ষয়ে গেলেও ইতিহাসের প্রতিধ্বনি ধরে রেখেছে।
বহুসাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যের প্রতিচ্ছবি
সাইরাস যে সাম্রাজ্য গড়েছিলেন, সেখানে জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সম্মান করা হয়েছিল। সেই সম্মানই প্রতিফলিত হয় পাসারগাদের স্থাপত্যে। গ্রিক, মিশরীয়, লিডীয়—বিভিন্ন সংস্কৃতির ছাপ মিশেছে পারস্য নকশায়। যেন এক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল বিশ্বজনীন শিল্পের মিলনমঞ্চ।
সময়ের ক্ষয় ও সংরক্ষণের প্রচেষ্টা
তবে সময়ের নির্মমতা এখানেও কাজ করেছে। প্রবল বাতাস, দহনকারী রোদ, মাঝে মাঝে বন্যার জল এবং মানুষের অসতর্ক হস্তক্ষেপ ক্ষতবিক্ষত করেছে এই প্রাচীন শহরকে। তবু ইউনেস্কো ২০০৪ সালে পাসারগাদকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে, যাতে এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষিত থাকে।
কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে—এই শহর কেবল আকেমেনীয় সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক কেন্দ্রই নয়, বরং সাংস্কৃতিক সহাবস্থান, প্রশাসনিক দক্ষতা ও মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রার প্রতীক।
আজও সাইটে প্রবেশ করলে দেখা যায় সাইরাসের সমাধি একাকী দাঁড়িয়ে আছে; মনে হয় যেন ইতিহাসের অমর সাক্ষী হয়ে তিনি পাহারা দিচ্ছেন নিজের রাজধানীকে।
সাইরাস দিবসের প্রাক্কালে পাসারগাদে দর্শনার্থীদের ভিড়
ভ্রমণকারীর অনুভূতি
পাসারগাদ একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান দেখা নয়—এ যেন ফিরে যাওয়া প্রাচীনকালের এক মহানগরে, যেখানে প্রতিটি পাথর, প্রতিটি ধ্বংসস্তূপ নিঃশব্দে বলে যায় এক সাম্রাজ্যের গল্প।
যখন সন্ধ্যার আলো মোরগাব সমভূমিতে ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসে, সাইরাসের সমাধির সামনে দাঁড়ালে মনে হয়—এখানে কেবল রাজা নন, সমাহিত আছে এক সাম্রাজ্যের আত্মা, যার উত্তরাধিকার টিকে আছে বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তরে।
আরএইচ