নাটোর: সারিসারি গাছে ঝাঁকেঝাঁকে পরিযায়ী পাখি এসে বাসা বেঁধেছে। পাতি ও বালি হাঁস, পানকৌড়ি, শামুকখোলসহ অন্তত ১০ প্রজাতির পাখির আগমনে মুখরিত হয়ে উঠেছে নাটোরের রানি ভবানীর রাজবাড়ি।
প্রতিদিনই নানা জাতের এসব পাখি দেখতে ভিড় করছেন পাখিপ্রেমীরা। আর পাখির এমন মনোমুগ্ধকর দৃশ্য যেন মন কাড়ছে পাখিপ্রেমীদের। শহর বা দূর-দূরান্ত থেকে অনেকে আসছেন এসব পাখি দেখতে। পাখি দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষ।
তবে পাখির মলমূত্র নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়ছেন দর্শনার্থীরা। রাজবাড়ির প্রবেশ পথ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় পাখির মলমূত্রে শরীর বা কাপড় নষ্ট হচ্ছে প্রতিদিন। এসব এড়াতে কেউ দিচ্ছেন দৌড়, কেউ বা অটোরিকশা ভাড়া করছেন আবার অনেক দর্শনার্থী ছাতা নিয়ে প্রবেশ করছেন রাজবাড়িতে। পাখির মলমূত্রে দুর্গন্ধ আর চলাফেরায় ভোগান্তি জেনেও ছুটে আসছেন তারা পাখি দেখতে।
স্থানীয়দের দাবি, পাখি আছে এবং থাকবে, তবে পাখির আবাসস্থল এলাকায় চলাচলকারী সড়কে এ সময়টিতে পাখির মলমূত্র থেকে রক্ষায় সেড বা ছাউনি নির্মাণসহ প্রতিকার চান তারা।
রাজবাড়ির আশপাশের মানুষজন জানান, পাখিদের কলকাকলী আর কিচিরমিচির শব্দে প্রতিদিন সকাল হয়, ঘুম ভাঙে আবার সন্ধ্যা নামে। আর সকালেই শত শত এসব পাখি ঝাঁক বেধে খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে যায়, বিকেলে আবার ফিরে আসে আপন নীড়ে। এরপর শুরু হয় কলকাকলী। এতে কেউ বিরক্তি হন কেউ বা আনন্দ পান।
রাজবাড়িতে আসা শিশু মরিয়ম খাতুন জানায়, পাখি দেখতে তার খুব ভালো লাগে, তাই বাবা-মায়ের সঙ্গে রাজবাড়িতে পাখি দেখতে এসেছে।
শিক্ষার্থী রুহী আফজা ও তামান্না খাতুন জানান, আগে পাখি দেখতে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হতো। এখন বাড়ির পাশে রাজবাড়িতেই পাখি দেখছেন।
ষাটোর্ধ্ব বয়সী আমজাদ হোসেন বলেন, এসব পাখি সাধারণত বিলে, গ্রামাঞ্চলে আসে এবং অবাধে বিচরণ করে। এখন লোকালয়ে আসছে পাখিগুলো।
পাখিদের সৌন্দর্যের এ উৎসবের মাঝেও আশঙ্কার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে অবৈধভাবে পাখি শিকারের চেষ্টা। সন্ধ্যার পর নির্জন পরিবেশ হলেই সুযোগ নিয়ে পাখি শিকারের চেষ্টা করেন কিছু অসাধু শিকারি। বিভিন্ন ফাঁদের মাধ্যমে তারা পাখি শিকারের চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ করছেন অনেকেই। তবে স্থানীয় বাধা আর প্রশাসনের হস্তক্ষেপের কারণে অনেকটাই বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন তারা।
স্থানীয় বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমান, ফিরোজ মাহমুদ, মনিরুজ্জাম জানান, পাখির মলমূত্রে নোংরা পরিবেশ হওয়ায় অনেকেই ছাতা ব্যবহার করছেন, সেই সঙ্গে দর্শনার্থীদের আনা-গোনা কমেছে। এছাড়া পাখির মলের দুর্গন্ধে পরিবেশ বিষিয়ে উঠেছে। প্রতিরক্ষা প্রাচীর, গাছপালা, লাইট থেকে শুরু করে সড়কে মলমূত্র ত্যাগের কারণে নোংরা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। তারপরও পাখি থাকুক, পাখির সৌন্দর্য সবাই উপভোগ করুক এমনটি সবাই চায়। তবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ রজায় রাখতে হবে। যাতে রাজবাড়িতে আসা দর্শনার্থীরা দুর্ভোগে না পড়েন।
জানা যায়, নাটোর রাজবাড়ির পরিবেশ পরিযায়ী পাখির বসবাসের জন্য উপযুক্ত নয়। এটি মূলত একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। এর চারপাশ দিয়ে রয়েছে বড় বড় দিঘি বা পুকুর আর সঙ্গে রয়েছে সারিসারি পুরোনো গাছ। সেখানেই সুদূর সাইবেরিয়া ও অন্যান্য শীতপ্রবণ অঞ্চল থেকে উড়ে এসে পাখিরা বাসা বেঁধেছে। স্থানীয়দের মতে, গত পাঁচ বছর ধরে রাজবাড়ির এসব গাছে পাখিদের অবাধ বিচরণ শুরু হয়। রাজবাড়িতে পাখির আগমনে প্রকৃতির রূপকে আরও সৌন্দর্য করে তুলছে।
তাইতো হাজার হাজার মানুষ আসছেন পাখি দেখতে, অনেকে পাখি তাড়ানো বা শিকারেরও চেষ্টা করছেন। কিন্তু স্থানীয় পাহারার কারণে তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। পাখিরা চায় নিরাপদ আশ্রয়, তাই যেখানে লোকালয় তার আশে পাশেই আশ্রয়স্থল খোঁজে পাখিরা। কারণ লোকালয় এলাকায় কেউ পাখি শিকার করতে পারে না এমন অভিজ্ঞতার কথা জানান অনেকে।
নাটোরের জেলা প্রশাসক (রুটিন দায়িত্ব) ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. আরিফ হোসেন বাংলানিউজকে জানান, পরিযায়ী পাখিদের সুরক্ষা, রাজবাড়ির পরিবেশ-প্রতিবেশ বজায় রাখাসহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে জেলা প্রশাসন সর্বদা প্রস্তুত রয়েছে। ইতোমধ্যে কিছু অংশে পাখির মলমূত্র রোধে তৈরি করেছে ছাউনি। পাখিদের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য শব্দদূষণ রোধে আশে পাশে হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ করা আর পাখিদের কারণে যাতে দর্শনার্থীদের আগমনে বিঘ্ন না ঘটে, সেজন্য নানা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে জেলা প্রশাসন।
এদিকে পাখি, মানুষ এবং পরিবেশ একে অপরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পাখির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ মানুষের কার্যকলাপ, বন উজাড়, দূষণ এবং নগরায়ণ, পাখির আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে। ফলে পাখিদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষও।
আরআইএস