ঢাকা, সোমবার, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৮ জুলাই ২০২৫, ০২ সফর ১৪৪৭

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

ফুঁসে উঠছেন এলাকাবাসী-

সিলেটে বালু সন্ত্রাসের তাণ্ডবে ধসের ঝুঁকিতে ধলাই সেতু 

নাসির উদ্দিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬:২৩, জুলাই ২৭, ২০২৫
সিলেটে বালু সন্ত্রাসের তাণ্ডবে ধসের ঝুঁকিতে ধলাই সেতু  ধলাই সেতুর নিচে স্থানীয়দের নাগরিক সমাবেশ ও মানববন্ধন।

সিলেট: বালুখেকোদের তাণ্ডবে হুমকির মুখে পড়েছে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের দ্বিতীয় দীর্ঘতম ধলাই সেতু।  প্রভাবশালী মহল বিশেষ নির্দিষ্ট একটি এলাকা ইজারা নিয়ে বালু তুলছে সেতুর নিচ থেকে।

নিয়ম না মেনে দিনে-রাতে ড্রেজিং করে লাখো ঘন ফুট বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এই কারণে সেতুটির পিলারের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়ে ঝুঁকিরপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।  

সেতুটি রক্ষায় এলাকার লোকজনও ফুঁসে উঠেছেন। ইতোমধ্যে স্থানীয় লোকজন ধলাই সেতুতে যান চলাচল বন্ধ রেখে আন্দোলন সমাবেশ করেছেন। কিন্তু বালু সন্ত্রাসীদের সঙ্গে পেরে ওঠছেন না তারা।  
আন্দোলনকারীরা জানান, ধলাই নদীর দুই তীরের ছয় লক্ষাধিক মানুষের একমাত্র যাতায়াত ধলাই সেতু দিয়ে। একটি মহল নদীর কিছু অংশ ইজারা নিলেও ইজারাভুক্ত এলাকার ছেড়ে ধলাই সেতুর পিলারের পাশে থেকেও বালু তুলছে।

স্থানীয়রা জানান, দিনে আন্দোলনের কারণে বালুখেকোরা উত্তোলন বন্ধ রাখলেও রাতের আঁধারে সক্রিয় হয়ে ওঠে। হামলার ভয়ে রাতে কেউ প্রতিবাদ করতে আসে না। আর এই সুযোগে সরকারের ১৩ কোটি টাকায় নির্মিত সেতুটি এখন ধসের দ্বারপ্রান্তে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ধলাই নদী থেকে বালু উত্তোলনে ১৮ জুন টেন্ডার আহ্বান করা হয়। ইজারা করা এলাকা ধলাই নদীর দক্ষিণ তীর কালাসাদক/৫৭, তৈমুন নগর/৬২ এলাকা। ধলাই নদীর ২১৭ দশমিক ৭০ একর জায়গা সরকারি মূল্য চার কোটি ৫৭ লাখ ৮৫ হাজার টাকায় জেলা প্রশাসন থেকে ইজারা নেয় স্থানীয় একটি প্রভাবশালী চক্র। কাগজে কলমে সাড়ে চার কোটি টাকা ইজারামূল্য হলেও ট্যাক্স ও ম্যানেজ প্রক্রিয়াসহ ১০ কোটিতে গিয়ে দাঁড়ায় সাকুল্য খরচ। এই ম্যানেজ প্রক্রিয়ায় ওপর মহল, রাজনৈতিক নেতা, স্থানীয় প্রশাসন থেকে সাংবাদিকদেরও সুবিধাভোগী একটি অংশে রয়েছে।  

সূত্র জানায়, ইজারা প্রক্রিয়া চলাকালেই ধলাই সেতু সংলগ্ন নদী থেকে বালু তোলা শুরু করে দেয় প্রভাবশালী চক্রটি। ইজারা নীতিমালায় স্পষ্ট ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ। সনাতন পদ্ধতিতে বালু তোলার কথা বলা হলেও ইজারাদাররা তা মানছেন না। প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ৩শ ভলগেট দিয়ে উত্তোলনকৃত বালু টানা হয়। এর রয়েলটি বাবদ ফুট প্রতি ১০ টাকা করে আদায় করছেন ইজারাদাররা। সে হিসাবে প্রতিদিন রয়েলটি আদায় হচ্ছে ৯০ লাখ, যা মাসে ২৭ কোটি টাকা বালু থেকে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। যে কারণে নামে বালু মহাল হলেও স্থানীয়দের ভাষ্যমতে এটি টাকার খনি। তাই টাকার জন্য সেতু ধসেও তোয়াক্কা করছেন ইজারাদাররা।

সেতুর গুরুত্ব: ২০০৫ সালে ১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৪৩৪ দশমিক ৩৫ মিটার দীর্ঘ ও ৯ দশমিক ৫ মিটার প্রস্থের ধলাই সেতুটি সিলেট বিভাগের দ্বিতীয় দীর্ঘতম সেতু। এটি কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পূর্ব ইসলামপুর ও উত্তর রণিখাই ইউনিয়নের অর্ধশতাধিক গ্রামের ছয় লক্ষাধিক মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সড়ক যোগাযোগের মাধ্যম।

বালু উত্তোলনের প্রভাব: গত কয়েক মাস ধরে সেতুর নিচ থেকে অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলন চলছে। অবৈধ কার্যক্রমের ফলে সেতুর পিলারগুলোর চারপাশে গভীর গর্ত তৈরি হয়েছে। যা সেতুর স্থায়িত্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে।

এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক ওয়াটারকিপার অ্যালায়েন্সের ‘সুরমা রিভার ওয়াটারকিপার’ ও পরিবেশবাদী সংগঠন ‘ধরিত্রী রক্ষায় আমরা’ (ধরা) বলছে, সিলেট অঞ্চলের দীর্ঘতম সেতু ধলাই। এ সেতুর পাশ থেকে বালু ও পাথর আহরণের নামে গত এক বছর ধরে নজিরবিহীন অন্যায়-অনাচার চলেছে।  

ওয়াটার কিপার আব্দুল করিম কিম বলেন, পাথর ও বালুমহালে বিগত এক বছর ধরে নজিরবিহীন অন্যায়-অনাচার চলছে। আইন-কানুনের কোনো তোয়াক্কা নেই। বালু-পাথর লুট করতে করতে পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, নিজের পায়ে কুড়াল মেরে ধলাই সেতু ধসের আয়োজন চলছে। অবিলম্বে বালুখেকোদের হাত থেকে ধলাই সেতু রক্ষায় উদ্যোগ নেওয়া না হলে, বালু সন্ত্রাসে ধলাই সেতু ধ্বংস হলে, এর দায় স্থানীয় প্রশাসনের। রাষ্টীয় সম্পদ রক্ষা করতে ব্যর্থতার জন্য প্রশাসনকে আসামি করে মামলা করা হবে। ’ 

শনিবার (২৬ জুলাই) বিকেলে সিলেটের অন্যতম সীমান্ত নদী ধলাই সেতুর নিচে আয়োজিত নাগরিক সমাবেশ ও মানববন্ধনে তিনি এ কথা বলেন।  

ধলাই সেতু রক্ষায় পরিবেশবাদী সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) সিলেট শাখা ও আন্তর্জাতিক পানি ও নদী অধিকারবিষয়ক সংগঠন সুরমা রিভার ওয়াটার কিপারের উদ্যোগে মানববন্ধন ও সমাবেশ হয়। এতে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার নদী তীরবর্তী সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশ নেন।  

ধলাই সেতুর পূর্বপাড়ে অনুষ্ঠিত এ কর্মসূচি থেকে বালু লুটতরাজ বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে শেষবারের মতো সতর্ক করে দেওয়া হয়। স্থানীয় বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন সেতু রক্ষার দাবিতে ব্যানার-ফেস্টুনসহ মানববন্ধনে একাত্ম হয়।

কর্মসূচি থেকে জানানো হয়, ২০০৫ সালে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪৩৪ দশমিক ৩৫ মিটার দীর্ঘ ও ৯ দশমিক ৫ মিটার প্রস্থের ধলাই সেতু নির্মিত হয়। ’

২০০৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর তৎকালীন অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম সাইফুর রহমান সেতুটি উদ্বোধন করেন। উপজেলা সদরের সঙ্গে ভারত সীমান্তঘেঁষা তিনটি ইউনিয়নের প্রায় লক্ষাধিক মানুষের সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করেছে ধলাই সেতু। সিলেটের অন্যতম পর্যটন এলাকা উৎমাছড়ায় যাতায়াতের মাধ্যম এই সেতু। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে প্রশাসনের শিথিলতায় ধলাই নদীতে শুরু হয় নির্বিচারে বালু ও পাথর লুটপাট।  

মানববন্ধন ও সমাবেশ থেকে বলা হয়, বালুখেকোরা প্রশাসনিক কোনো বাধা না পাওয়ায় এতই বেপরোয়া হয় যে, ধলাই সেতুর নিচ থেকে বালু উত্তোলন করা শুরু করে। বিগত কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও প্রশাসনের টনক নড়েনি। স্থানীয় জনগণের পক্ষ থেকে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে পরিবেশবাদী সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) সিলেট শাখার পক্ষ থেকে এই বালু লুটতরাজ বন্ধে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। তবুও বন্ধ হয়নি বালুখেকোদের বালু উত্তোলন। এভাবে বালু উত্তোলন চলতে থাকলে ধলাই সেতু যেকোনো সময়ে ধসে যেতে পারে। ফলে রাষ্ট্রের সম্পদ বিনষ্টের পাশাপাশি ওই এলাকার মানুষের জীবনযাত্রায় বিঘ্ন ঘটবে।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ এমদাদুল হকের সভাপতিত্বে মানববন্ধনে স্থানীয় স্কুলশিক্ষক নিজাম উদ্দিন মাস্টারের সঞ্চালনায় সমাবেশ হয়।  
সমাবেশে ধরা সিলেটের সংগঠক ও ধলাই তীরের বাসিন্দা ফয়জুর রহমান, ধরার সংগঠক ও আইনজীবী অরুপ শ্যাম বাপ্পী, সোহাগ তাজুল আমিন, নাট্যকর্মী আহমেদ হোসেন চৌধুরী প্রমুখ বক্তব্য দেন।  

সভাপতির বক্তব্যে ড. মোহাম্মদ এমদাদুল হক বলেন, ধলাই সেতুর নিচে বালু লুটতরাজ বন্ধে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০), বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০, পানি উন্নয়ন বোর্ড আইন, ২০০০, ফৌজদারি দণ্ডবিধি ১৮৬০, সন্ত্রাসবিরোধী আইন বা বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রয়োগের অবকাশ রয়েছে। এসব আইন প্রয়োগের মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসন উদ্যোগ না নিলে জনগণ এ আইনের মাধ্যমে প্রশাসনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে।

 এনইউ/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।