জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বিভক্তি প্রশ্নে কর্মকর্তারা ক্ষুব্ধ। তারা বলছেন, তারাও সংস্কার চান, এমনকি এনবিআর ভেঙে দুটি বিভাগের ব্যাপারেও তাদের কোনো দ্বিমত নেই।
এনবিআরের বর্তমান অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন একজন সিনিয়র সচিব। তিনি অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব। তিনি আসেন অ্যাডমিন ক্যাডার থেকে। এর নিচে ১৫ জন সদস্য আছেন। এর মধ্যে আটজন ট্যাক্স ক্যাডার থেকে এবং সাতজন শুল্ক ও আবগারি ক্যাডার থেকে হয়ে থাকেন। ট্যাক্স ক্যাডারের আটজনের মধ্যে তিনজন গ্রেড–১ পদমর্যাদার। এনবিআর বোর্ড প্রশাসনে একজন সদস্য রয়েছেন, তিনি অ্যাডমিন ক্যাডার থেকে আসা, গ্রেড-২ পদমর্যাদার কর্মকর্তা।
এনবিআর বিভক্ত হলে দুজন সচিবের অধীনে দুটি ডিভিশন থাকবে। এনবিআর-এর কর্মকর্তারা ধরেই নিয়েছেন নিশ্চিতভাবেই তারা অ্যাডমিন থেকে আসবেন। কিন্তু এই দুই ডিভিশনের অর্গানোগ্রামে বিন্যাস কীভাবে হবে, রাজস্ব সম্পর্কিত ক্যাডাররা প্রাধান্য হারাবে কি না, অবস্থানই বা কেমন হবে; কর ক্যাডার ও শুল্ক-আবগারি ক্যাডারের স্বাতন্ত্র থাকবে তো? প্রজ্ঞাপনে এ বিষয়ে কোনো স্পষ্ট বার্তাও নেই। আর এখানেই এনবিআর কর্মকর্তাদের বিচলিত হওয়ার কারণ। এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে।
এ বিষয়ে বিষয়ে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের অন্যতম নেতা অতিরিক্ত কমিশনার (কাস্টমস ও ভ্যাট) সাধন কুমার কুন্ডু বলেন, আমরা চাই কমিটির মূল প্রতিবেদন আলাপ-আলোচনা করে চূড়ান্ত করা হোক। সেই আলোচনায় অর্থনীতিবিদ, থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, ব্যবসায়ী মহল, গবেষক ও গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টরা আলোচনায় থাকুক। আলোচনার মাধ্যমে দেশের স্বার্থে যে সিদ্ধান্ত আসে, সেটা করা হোক। তাতে দ্বিমত নেই।
তিনি বলেন, এখন যেটা করা হয়েছে, সংস্কার কমিটির প্রতিবেদনের অংশবিশেষ এবং অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ছাড়াই প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। আমরা সংস্কার চাই, সংস্কার প্রয়োজন আছে। কিন্তু সেটা হতে হবে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে এবং অংশগ্রহণমূলক। অংশগ্রহণমূলক না হলে, স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে না হলে বৃহত্তর স্বার্থ উপেক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সাধন কুমার কুন্ডু আরও বলেন, কস্ট বেনিফিট অ্যানালাইসিস দেখার প্রয়োজন ছিল। অর্থাৎ আমি যে কাজটি করছি, সেটা আমি কতটুকু বেনিফিট পাব, কতটুকু লস হবে, সেটি করা হয়েছে কি না এবং বাস্তব কর বাড়বে কি না। এটা যদি লক্ষ্য হয় তাহলে সেটা কতটুকু অর্জন হবে? এ ধরনের বিশ্লেষণ করার সুযোগ আছে। এটা বিভিন্ন এক্সপার্ট, অংশীজনদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে করা যেত।
এত বছর ধরে কাজ করে যাওয়া একটি স্বতন্ত্র ক্যাডার সার্ভিসের পুনর্বিন্যাশ হবে অথচ তারা জানতে পারছে না কী হচ্ছে। সংগত কারণে কর্মকর্তাদের মাছে অসন্তোষ থাকবে। রাজস্ব বোর্ড সংস্কার হচ্ছে, কর সম্পর্কিত ব্যবস্থাপনার খোলনলচে বদলে যাচ্ছে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে কর্মকর্তারা অন্ধকারে রয়েছেন। আবার এনবিআর সম্পর্কিত কমিটি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারও পুরোপুরি প্রতিফলন ঘটেনি। আর এই চিন্তা থেকেই যত অস্বস্তি!
প্রজ্ঞাপন জারির বিষয়টিতে বেশ তাড়াহুড়া ছিল। তড়িঘড়ি করার পেছনে যতই যুক্তি থাক না কেন, তা এড়ানো যেত বলে মনে করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
তিনি বলেন, এখানে একটি উপাদান কাজ করতে পারে, তা হলো আইএমএফের পক্ষ থেকে একটা চাপ ছিল। এখানেও কথা আছে, আইএমএফ কি সুনির্দিষ্ট করে এনবিআর ভেঙে দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেছিল নাকি বাংলাদেশের কর জিডিপির হার বাড়ানোর জন্য চাপ দিয়েছিল? আর সেটা করার জন্য এটাই কি সমাধান, নাকি অন্য সমাধান আছে? এটা করা হয়েছে, এর মাধ্যমে দেশে যারা বড় বড় কর ফাঁকি দেয়, যোগসাজশ করে কর কর্মকর্তারা সুযোগ করে দেয়—এইসব সমস্যার সমাধান কি এনবিআরকে ভাগ করলেই হয়ে যাবে? যারা এটা করেছে তাদের আগে থেকে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর প্রস্তুত করে রাখার দরকার ছিল। তাহলে এই সমস্যাগুলো হতো না।
এখন যাদের মধ্যে টেনশনটা দেখা যাচ্ছে, কেউ এটাকে যৌক্তিক বলবে, কেউ অযৌক্তিক বলবে। সরকারি কর্মকর্তাদের মাঝে যে বিভাজন আছে—একদিকে প্রশাসন ক্যাডার, অন্যদিক থেকে অন্য ক্যাডার, সেটারও তো একটা প্রতিফলন এখানে দেখা যাচ্ছে। সার্বিকভাবে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে যেসব ঝুঁকি আছে, সেগুলো পর্যাপ্ত হয়নি বলে এমন প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, বলেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।
জেডএ/এমজেএফ