কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল বিজেপিকে নিশানা করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, 'বিজেপি হচ্ছে হিন্দু বিরোধী, সংখ্যালঘু বিরোধী ও সাম্প্রদায়িক দল। এই দল আগামী দিনে ক্ষমতায় আসবে না।
বৃহস্পতিবার (৪ সেপ্টেম্বর) পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় দাঁড়িয়ে মমতা আরও বলেছেন, 'আমি মনে করি বিজেপি আজ দেশের লজ্জা। বাংলা ভাষার ওপরে সন্ত্রাস করার জন্য, অত্যাচার করার জন্য আমি এদের তীব্র ধিক্কার জানাই। এমন একদিন আসবে, যেদিন বাংলার মানুষ বিজেপির একজন মানুষকেও দেখতে চাইবে না। বাংলার ওপর অত্যাচার করে এবার সব কটা আসনে হারবে। বাংলা ভাষার ওপরে অত্যাচার করে, সন্ত্রাস করে বাংলায় জেতা যায় না। এটা মনে রাখতে হবে। '
বাংলা ভাষার ওপর সন্ত্রাস ও ভিনরাজ্যে বাঙালিদের ওপর হেনস্থাবিরোধী প্রস্তাবের ওপর আলোচনা বক্তব্য রাখতে গিয়ে এদিন বিধানসভার বিশেষ অধিবেশনে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, 'ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু থেকে শুরু করে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু, প্রীতিলতা ওয়াদ্দার, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, ঋষি অরবিন্দ, মাতঙ্গিনী হাজরা সবারই ভাষা ছিল বাংলা, আজ সেই স্বাধীন দেশের সরকার বলছে বাংলা নাকি বিদেশি ভাষা? বাংলা গোটা বিশ্বে পঞ্চম স্থানে এবং এশিয়াতে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। এ ভাষা বিদেশি ভাষা নয়। '
এরপরই মমতা বলেছেন, 'বিজেপি হল সেই রাজনৈতিক দল, যাদের দেশের ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে কোনো অবদান ছিল না। ওরা আজকে দেশের সবচেয়ে বড় ডাকাত। ওরা আজ কোটি কোটি অর্থের বিনিময় দেশটাকে বিক্রি করে দিচ্ছে, মানুষকে বিক্রি করে দিচ্ছে। এরা সাম্প্রদায়িকতার সুরসুরি দেয়। এরা মানুষে মানুষে ভাগাভাগি করে। যখন স্বাধীনতা আন্দোলন হয়েছিল বাংলার মানুষ সবচেয়ে বেশি বলিদান দিয়েছিল, ফাঁসিতে গিয়েছিল। কিন্তু সেসময় বিজেপির যারা লেজুর তারা ইংরেজদের কাছে দ্বাসক্ষত দিয়ে জেল থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। মহাত্মা গান্ধী যখন বলেছিলেন 'করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে' তখন এই বিজেপির লোকেরা ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভারতের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। এই বিজেপি বিশ্বাসঘাতক, এরা প্রবঞ্চক। এরা মানুষকে কথা বলতে দেয় না। যারা আজকে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন, আগামী দিন বিজেপির কেউ নির্বাচিত হবেন না। '
এরপরই মোদীকে নিশানা করে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, 'আজকে রাশিয়ার পায়ে পড়ছে, কখনো চীনের পায়ে পড়ছে, কখনো যুক্তরাষ্ট্রের পায়ে পড়ছে, আবার কখনো ইসরায়েলের পায়ে পড়ছে। সবার পায়ে মাথা ঠেকাতে ঠেকাতে দেশের সম্মান বিকিয়ে দিয়েছে, মর্যাদা বিকিয়ে দিয়েছে। দেশটাকে বিক্রি করে দিচ্ছে। ঐক্যের মধ্যে বৈচিত্র্য যেটা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল, আজ সেই উদ্দেশ্যকে তারা পর্যদুস্ত করেছে। আপনারা দেশটাকে বিক্রি করে দিয়েছেন।
মমতার অভিযোগ, 'বিজেপি কি দেশ চালাবে? ওরা মানুষের সঙ্গে ঘৃণার রাজনীতি করে, এরা বিভেদের রাজনীতি করে, ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করে। এরা ইংরেজদের সঙ্গে চক্রান্ত করে সেদিন দেশকে ভাগ করে দিয়েছিল। ইংরেজদের সঙ্গে চক্রান্ত করে বাংলা থেকে রাজধানী তুলে নিয়ে গিয়েছিল।
মমতার বক্তব্যকে ঘিরে এদিন বিধানসভার বিশেষ অধিবেশনে কার্যত তুলকালাম কান্ড ঘটে যায়। বিজেপি বিধায়করা বিক্ষোভ শুরু করেন বিধানসভার ওয়েলে নেমে কাগজ ছিঁড়ে প্রতিবাদ করতে থাকে। এর প্রতিবাদে তৃণমূলের বিধায়করাও ওয়েলে নেমে আসে। সরকার পক্ষ এবং বিরোধী দলের বিধায়কদের মধ্যে স্লোগান- পাল্টা স্লোগানে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে অধিবেশন কক্ষ। এরই মধ্যে মমতাকে ওয়েলে নেমে এসে নিজের দলের বিধায়কদের শান্ত করতে দেখা যায়। অন্যদিকে বিধানসভার নিয়ম লঙ্ঘন করার অভিযোগে বিজেপি বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল, শঙ্কর ঘোষ, মিহির গোস্বামীসহ বিজেপির পাঁচজন বিধায়ককে সাসপেন্ড করা হয়। এরপর স্থগিত হয়ে যায় বিধানসভা অধিবেশন।
পরবর্তীতে আবার শুরু হলে বিরোধী দলের বিধায়কদের উদ্দেশ্যে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, 'আপনারা বিধানসভার মধ্যে কাগজ ছুঁড়ছেন এটা অনৈতিক, অসংসদীয়, অগণতান্ত্রিক ও অবৈধ বিষয়। এরা চায় আমি যদি বাংলা ভাষায় কথা বলি, মানুষ যদি আমার কথা জানতে পারে তাহলে এদের মুখোশ খুলে যাবে। এরা দুর্নীতিবাজ, এরা গদি চোর, এরা ভোট চোর। সবচেয়ে বড় ডাকাতের দল হলো বিজেপি। এরা দুর্নীতি পরায়ন দল, বাঙালির ওপর অত্যাচার করা দল, এরা মানুষকে ভাওতা দেওয়া দল, সন্ত্রাস করা দল, অত্যাচারী দল। '
মমতার ওই বক্তব্যের মাঝেই আবার উত্তেজনা শুরু হয়ে যায়। তৃণমূলের দুর্নীতিকে নিশানা করে 'মমতা চোর, তৃণমূল চোর ' স্লোগান দিতে থাকে বিজেপি। আর তখনই কার্যত মেজাজ হারান মমতা। অধিবেশন থেকেই পাল্টা 'মোদি চোর, বিজেপি চোর, অমিত শাহ চোর আবার কখনও বিজেপি হটাও দেশ বাঁচাও বলে ক্রমাগত স্লোগান দিতে থাকেন মমতা। তার সঙ্গে গলা মিলিয়ে অন্য বিধায়কদের স্লোগান দেওয়ার কথা বলেন মমতা। দলনেত্রীর নির্দেশে পেয়ে তার দলের বিধায়করা দ্বিগুণ শক্তিতে স্লোগান দিতে থাকেন।
অপরদিকে বিজেপি বিধায়করা স্লোগান দিতে থাকেন 'তৃণমূল সরকার, আর নেই দরকার। ' পাল্টা মমতা বলেন 'আর নেই দরকার, বিজেপি সরকার। '
এরকম এক পরিস্থিতির মধ্যে মমতার ঠিক সামনের আসনে বসেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। তিনিও বিজেপিকে 'ছ্যাঁচড়া' বলে অভিহিত করেন। এ সময় মুখ্যমন্ত্রী বলেন 'না না, ছ্যাঁচড়া দিয়ে তো তরকারি হয়। সেই ছ্যাঁচড়ার তরকারি তো তোমরাও খাও। তরকারিকে কেন অপমান করবে? ছ্যাঁচড়া কথাটাকে আমরা ভালোবাসি। বাংলার লোকেরা ছ্যাঁচড়াকে ভালোবাসে। কিন্তু এদের মতো এত অপদার্থ, এত নির্লজ্জ, এত অসভ্য রাজনৈতিক দল আমি জীবনে দেখিনি। '
সব মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় এত উত্তেজনা সম্প্রতি দেখা যায়নি।
ভিএস/আরএ