চট্টগ্রাম: বর্ষীয়ান বামপন্থী রাজনীতিক, সংস্কৃতিজন স্বপন সেন আর নেই। তাঁর মৃত্যুতে চট্টগ্রামের বামপন্থী, প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মহলে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
শুক্রবার (১০ অক্টোবর) ভোরে চট্টগ্রাম সরকারি জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ৭৩ বছর বয়সী অকৃতদার স্বপন সেন দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন।
চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রামের এক বনেদি পরিবারে স্বপন সেনের জন্ম। তাঁর পিতা একজন স্কুলশিক্ষক ছিলেন। সেই সুবাদে চট্টগ্রাম নগরীর ঈশ্বরনন্দী লেইনে তাঁর শৈশব থেকে জীবনের পুরোটা সময় কেটেছে।
ষাটের দশকে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে স্বপন সেনের রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়। এরপর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ও সর্বশেষ তিনি গণতন্ত্রী পার্টির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি গণতন্ত্রী পার্টির চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সহ সভাপতি ছিলেন। তিনি নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ চট্টগ্রামে বিভিন্ন সামাজিক ও নাগরিক আন্দোলনের একজন সামনের কাতারের সংগঠক ছিলেন। উদীচীসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে আমৃত্যু তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন।
স্বপন সেনের মৃত্যুতে সিপিবি কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ শাহআলম, চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক অশোক সাহা ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নুরুচ্ছাফা ভূঁইয়া, ন্যাপের কেন্দ্রীয় চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মিটুল দাশগুপ্ত, উদীচী চট্টগ্রামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. চন্দন দাশ ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক শীলা দাশগুপ্তাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে গভীর শোক প্রকাশ করা হয়েছে।
শুক্রবার বিকেলে স্বপন সেনের মরদেহ নগরের চেরাগী চত্বরে নেওয়া হয়। সেখানে সর্বস্তরের মানুষ তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
এ সময় কবি ও সাংবাদিক কামরুল হাসান বাদলের সঞ্চালনায় সংক্ষিপ্ত শ্রদ্ধা নিবেদন পর্বে বক্তব্য রাখেন, কবি ও সংস্কৃতিজন সুভাষ দে, প্রবীণ সাংবাদিক অঞ্জন কুমার সেন এবং চট্টগ্রাম জেলা সিপিবির সভাপতি অধ্যাপক অশোক সাহা।
বক্তারা বলেন, স্বপন সেন এদেশের বাম রাজনীতির, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনীতির একজন উজ্জ্বলতম মানুষ ছিলেন। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে সাতচল্লিশের দেশভাগ, ষাটের দশকের প্রগতিশীল বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির উত্থান, সাংস্কৃতিক জাগরণ, মুক্তিযুদ্ধ, আশি, নব্বইয়ের দশক থেকে সর্বসাম্প্রতিক রাজনীতির ইতিহাস, সবই ছিল তাঁর নখদর্পনে। সেই ইতিহাস তিনি সভা, সমাবেশ কিংবা আড্ডা-আলোচনায় অনর্গল বলে যেতেন৷ এদেশে যারা মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতি আর প্রগতিশীলতাকে অন্তরে লালন করতেন নির্মোহভাবে, তাদের অনেকেই আজ হারিয়ে যাচ্ছেন। সেই যাত্রায় স্বপন সেনও শামিল হলেন। তাঁর মৃত্যুতে আমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, সমাজতন্ত্রের পক্ষের একজন লড়াকু সৈনিককে হারালাম।
এরপর সিপিবি, ন্যাপ, গণতন্ত্রী পার্টি, উদীচী চট্টগ্রাম, বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটি, চট্টল ইয়ূথ কয়ার, রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নসহ আরও বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
শ্রদ্ধা নিবেদন পর্বে আরও উপস্থিত ছিলেন, ন্যাপ নেতা মিটুল দাশগুপ্ত, সিপিবি নেতা অমিতাভ সেন, সংস্কৃতিজন অনুপ সাহা, উদীচী চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক শীলা দাশগুপ্ত, সহ-সভাপতি প্রবাল দে, শিমুল সেন ও ভাস্কর রায়, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী শ্রেয়সী রায়, নাট্যকর্মী সাহিদ উদ্দিন, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি নাজিমউদ্দিন শ্যামল, বিএফইউজের সাংগঠনিক সস্পাদক মহসীন কাজী, সংস্কৃতিকর্মী শোয়েব নাঈম, অধ্যাপক শিবপ্রসাদ সুর, আলোকচিত্রী কমল দাশ, সাংবাদিক রমেন দাশগুপ্ত এবং প্রয়াত স্বপন সেনের পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
পিডি/টিসি