ঢাকা, শনিবার, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২, ১২ জুলাই ২০২৫, ১৬ মহররম ১৪৪৭

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

এসএসসিতে দেশসেরা নিবিড়, যে স্মৃতি কাঁদাল মা-বাবাকে 

আল রাহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২:৪৮, জুলাই ১১, ২০২৫
এসএসসিতে দেশসেরা নিবিড়, যে স্মৃতি কাঁদাল মা-বাবাকে  মা-বাবার সঙ্গে নিবিড়

চট্টগ্রাম: সদ্য প্রকাশিত এসএসসির ফলে দেশসেরা নিবিড় কর্মকার। ১৩০০ নম্বরের মধ্যে ১২৮৫ নম্বর পেয়েছে।

নাসিরাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র সে। এত ভালো ফল পাওয়ার পরও একটি কারণে এখনো নিবিড়ের বাবা জীবন কর্মকার ও মা রিপা রায় এর বাকরুদ্ধ হয়ে আসে।
সেটি হচ্ছে- পঞ্চম শ্রেণিতে বাবার পছন্দের স্কুলে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়া।  

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় নিবিড় জানায়, আমি যখন রেজাল্ট পাই মার্কশিট দেখে একটু হতবাক হয়েছিলাম। তবে আমি ভেবেছিলাম ১২৮০ প্লাস পেতে পারি। আগের রাতেও ভেবেছিলাম। রেজাল্ট পাওয়ার পর আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি। প্রথমত সৃষ্টিকর্তার প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা জানাই। সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ না থাকলে এ রেজাল্ট আনতে পারতাম না। এরপর মা-বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। মা-বাবা অনেক পরিশ্রম করেছে। তা সার্থক হয়েছে। বাবা-মার মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছি, এর জন্য খুশি। নাসিরাবাদ স্কুলের শিক্ষকদের কথা বলতে চাই। তাদের গাইড লাইন, সব উপদেশ মেনে চলতাম। আমার ভালো ফলের পেছনে শিক্ষকদের ভূমিকা বেশি। নিয়মিত ক্লাস করেছি। ক্লাসের বাইরেও অনেক শিক্ষকের সহযোগিতা নিয়েছি। পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছি এ স্কুলে।

স্কুল বন্ধুরাও আমাকে সহযোগিতা করেছে। সহপাঠীরাও ভালো ফলাফল করেছে। মেইনলি আমি টেক্সট বুকের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। এমসিকিউ প্র্যাকটিস করেছি। টেক্সট বুকের লাইন বাই লাইন পড়লে যে পরীক্ষা আসবে ভালো ফল পাওয়া যাবে। আমি বেশিক্ষণ পড়তাম না। যতটুকু সময় পড়তাম তা মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। দিনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৮-১০ ঘণ্টার মতো পড়েছি। বোর্ড পরীক্ষার বিগত প্রশ্নগুলো গুরুত্ব দিয়ে পড়তাম। বোর্ড পরীক্ষায় যে ফল পেয়েছি তা আমার জীবনের এটা ক্ষুদ্র বিষয়। বিভিন্ন চার্ট, চিত্র এঁকে প্রেজেন্টেশন দিতাম। এটা থেকে এ নাম্বার এসেছে। ভবিষ্যতে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছে আছে। বুয়েটে পড়তে চাই। এর কারণ হচ্ছে দেশের জন্য অবদান রাখতে পারবো। দেশের উন্নতি করতে পারবো। সমাজের জন্য কল্যাণমূলক কাজও করতে চাই প্রকৌশলী হয়ে।  

নিবিড় অনুভূতি জানিয়ে বলেন, মা আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। হাতের লেখা সুন্দর করতে মায়ের ভূমিকা বেশি। বাবাও অনেক ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছে।  

ছবি আঁকার শখ থাকলেও এসএসসিতে পড়াশোনার চ্যালেঞ্জ বেড়ে যাওয়ায় ছবি আঁকা আপাতত বন্ধ রেখেছে নিবিড়। স্কুলের রচনা প্রতিযোগিতায় সবসময় প্রথম হয়েছে নিবিড়। জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিযোগিতায় তৃতীয় পুরস্কার পেয়েছে।  

জুনিয়রদের উদ্দেশে নিবিড়ের পরামর্শ, মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতে হবে। টেক্সট বুককে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। লাইন বাই লাইন পড়তে হবে। তাহলে যে কেউ বোর্ড পরীক্ষায় ভালো করবে। পড়াশোনার ক্ষেত্রে সব বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। গণিতে বেশি গুরুত্ব দিলে বেশি নম্বর আসবে এটা ঠিক। বাকি বিষয়ে কম গুরুত্ব দিলে কম নম্বর আসবে। কনসেপ্ট ক্লিয়ার থাকতে হবে।  

গণিতের প্রশ্নপত্র কঠিন হওয়া প্রসঙ্গে নিবিড় জানায়, আমার জন্য গণিত প্রশ্ন একেবারে সহজ ছিল। সবার জন্য হতে পারে কঠিন। কয়েকটি অঙ্ক আছে ভালোমতো অনুশীলন করতে হয়।  

নিবিড়দের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে। নিবিড়ের মা রিপা রায় বলেন, আমার সন্তান সারা বাংলাদেশে প্রথম হয়েছে এটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এত ভালো লাগছে আমার। আমার প্রত্যাশা ছিল সে চট্টগ্রাম বোর্ডে একটা পজিশনে যাবে। স্কুলের টেস্ট পরীক্ষা, মডেল টেস্টের ফল দেখে মনে হয়েছে বোর্ড পরীক্ষায় সে সামনের সারিতে ভালো পজিশন পাবে। সারা দেশে প্রথম হবে এটা আশা করিনি। আমার বলার ভাষা নেই। অনেক বড় অর্জন। সব অভিভাবকের প্রতি অনুরোধ, আপনার সন্তান কাঁচা মাটি। এ মাটিকে যেভাবে গড়ে তুলবেন সেভাবে বেড়ে উঠবে। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত আমার ছেলে ও মেয়েকে ঘরে পড়িয়েছি। আমি বাইরের শিক্ষকের কাছে দিইনি, বাসায়ও শিক্ষক রাখিনি। তার দুর্বলতা দেখলে দুর্বলতা কীভাবে কাটানো যায় সে ব্যাপারে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেছি। দশম শ্রেণিতে শিক্ষদের সঙ্গে সরাসরি বা অনলাইনে কথা বলে ওভারকাম করেছি। আশা ছিল, বোর্ডে ভালো পজিশনে যাবে।  

ও যে পরিশ্রম করেছে ওর প্রত্যাশা অনুযায়ী ফল পেয়েছে। ওর পরিশ্রম কাজে এসেছে সার্থক হয়েছে। ওর মেধাতে এ ফল পেয়েছে। আমি ওকে পড়াশোনায় গাইড করতাম। পীড়াপীড়ি করতাম না। দেখতাম যে, ও যেটা পছন্দ করে ভালো করবে। নিজে ছেলেকে শৈশব থেকে তৈরি করেছি। সরাসরি প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করেছি। সব শ্রেণিতে ফার্স্টবয় ছিল।  

ভবিষ্যতে ছেলেকে কী বানাতে চান জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার ছেলে যেটা পছন্দ করে, যা করতে চায়, ওর ওপর ছেড়ে দিয়েছি। ওর প্রতি আমার আস্থা বা বিশ্বাস আছে। ও যা পছন্দ করবে ভালোই করবে।  

নিবিড়ের বাবা জীবন কর্মকার র‌্যাংকস গ্রুপের শিপিং বিভাগে চাকরি করেন। তিনি বলেন, ছেলে যে রেজাল্ট করেছে আমরা অবশ্যই খুশি। সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞ। স্কুলের শিক্ষকদের প্রতিও কৃতজ্ঞ। আমরা চাই, ও যদি ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশের সেবা করতে চায় আমরা বাধা দেব না। আমি যে বেতন পাই তা দিয়ে ছেলের পড়াশোনা, পরিবার চালাই। কোনো রকমের অসুবিধা ফিল করছি না।  

বাকরুদ্ধ কণ্ঠে বাবা বলেন, আমার ছেলে যখন পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হবে তখনকার কথা। ২০১৯ সালে ভর্তি পরীক্ষা হতো। কলেজিয়েটে এক নম্বর বা হাফ নম্বরের জন্য আসেনি। ওয়েটিংয়ে ৩, ৪ নম্বরে ছিল। তখন একটু মন খারাপ হয়েছিল, ছেলে কলেজিয়েটে আসলো না। সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপা সে এই স্কুল থেকে ভালো ফল করেছে। স্কুলশিক্ষকদের ওপর নির্ভর করেছি। বাসায় শিক্ষক রাখিনি। জাতীয় দিবসে স্কুলের রচনা প্রতিযোগিতায় সব সময় পুরস্কার পেয়েছে। শিশু একাডেমির প্রতিযোগিতা, জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেয়েছে। আমরা বেইসটা নিজেরা তৈরি করে দিতে চেয়েছি। পঞ্চম শ্রেণিতে নাসিরাবাদ সরকারি স্কুলে আসলো। তার ভালো ফলের অধিকাংশ কৃতিত্ব ওর মায়ের। আমি চাকরি করি, সময় দিতে পারিনি। তার মায়ের হাতের লেখা অনেক সুন্দর। আমার নিজের হাতের লেখা সুন্দর নয়। ছেলে সুন্দর হাতের লেখা তার মায়ের কাছে শিখেছে। আমরা চাই প্রথমে মানুষ হতে হবে। তারপর দেশের সেবা করতে হবে।  

মা বলেন, ওর বাবা চাইত ছেলেকে কলেজিয়েটে ভর্তি করাবে। যখন উনি মন খারাপ করতো আমি বলতাম, ভালো কিছুর জন্যই হয়তো ছেলে কলেজিয়েটে আসেনি। সে আজ দেশসেরা হয়েছে। এ রেজাল্ট পুরো দেশের জন্য গৌরবের।  

নিবিড় জানায়, বাবার স্বপ্ন ছিল কলেজিয়েটে ভর্তি করানোর। এ স্বপ্ন পূরণ করতে পারিনি। এসএসসিতে এমন রেজাল্ট করতে চেয়েছি যাতে বাবা মা খুশি হয়।  

এআর/পিডি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।