ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৭ কার্তিক ১৪৩২, ২৩ অক্টোবর ২০২৫, ০১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

নির্বাচনের আগে নাশকতার ছক ফ্যাসিবাদী চক্রের 

মিরাজ মাহবুব ইফতি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২:০৪, অক্টোবর ২২, ২০২৫
নির্বাচনের আগে নাশকতার ছক ফ্যাসিবাদী চক্রের 

ঢাকা: আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে নাশকতার ছক আঁকছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগসহ দলটির অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা—এমন তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের এই অপতৎপরতা ঠেকাতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের মাস্টারপ্ল্যান সম্পর্কে এরইমধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মূলত পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে ভারতে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের একটি গ্রুপ থেকে। তাদের মিশন বাস্তবায়নে সারা দেশে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী আত্মগোপনে থেকে নাশকতার ছক কষছে। এদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় প্রতিদিন ঝটিকা মিছিল বের করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এ চক্রের অনেককে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। বাকিদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে।

ভারতে থাকা ছাত্রলীগের এক সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা জানিয়েছেন, নভেম্বর-ডিসেম্বরে যে কোনো আন্দোলনের ইস্যুর মাধ্যমে ঢুকে পড়বে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তখন এই আন্দোলনকে তারা রূপ দেবে সরকার পতনের আন্দোলনে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এভাবেই তারা ইউনূস সরকারের পতন ঘটাতে চায়।  

সূত্র জানায়, সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের টার্গেট করে গুপ্ত হামলা, চিহ্নিত ছিনতাইকারী ও ডাকাতদের সংগঠিত করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটানো, ঝটিকা মিছিলে বাধা দিলে সফলভাবে পালটা হামলা চালিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনোবল ভেঙে দেওয়া এবং হঠাৎ ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে লাখো লোক জড়ো করাসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা তাদের আছে।

পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিক জানান, কোনো ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করলে রেহাই দেওয়া হবে না। আমার রেঞ্জের মধ্যে যদি কেউ এমন অপতৎপরতা ও ষড়যন্ত্র চালায়, তাহলে সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।

সাইবার ইউনিটের সূত্র জানায়, সাইবার স্পেসেও শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তারা বড় ধরনের মিছিল আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রধান টার্গেট রাজধানী ঢাকা ঘেরাও করা। এজন্য প্রথমে রাজধানীর চারদিক থেকে হঠাৎ এক ঘণ্টার ব্যবধানে হাজার হাজার নেতাকর্মী ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে জড়ো করা নিয়ে তারা বেশি সক্রিয়। পুলিশ এ সংক্রান্ত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর পালটা পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে।

ডিএমপি সূত্র জানায়, গত ২৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে গণজমায়েতের চেষ্টা করলে ২৪৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এদিন আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের পরিকল্পনা ছিল গ্রিন রোডে জমায়েত হয়ে পান্থপথ দিয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে ঢোকার। বিশ থেকে পঁচিশ হাজার লোক সেখানে বড় ধরনের জমায়েত করে বসে পড়ে দখলে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু সঠিক সময়ে পুলিশি তৎপরতায় সেটি সফল হয়নি।

সূত্র জানায়, আগে থেকেই তথ্য পাওয়া যায়, ২৮ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনার জন্মদিন ঘিরেও নাশকতার পরিকল্পনা করা হয়েছে। তবে পুলিশ সেটাও ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হয়।

স্বেচ্ছাসেবক লীগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা জানান, প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস যখন যুক্তরাষ্ট্র (ইউএসএ) সফরে দেশের বাইরে ছিলেন, গত ২৪ সেপ্টেম্বর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঝটিকা মিছিল থেকে ২৪৪ জনকে গ্রেফতার করে। এ সময় আমাদের পরিকল্পনা ছিল চারপাশ থেকে এক লাখ লোক ঘিরে ঢাকা অচল করে দিয়ে সরকার পতনের। তবে সেই পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে না দেওয়ার ফলে আমাদের নেতাকর্মীদের মনোবল ভেঙে গেছে।

পুলিশ সদর দপ্তর ও গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, গত ১১ মাসে সারা দেশ থেকে প্রায় ৪০ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

‘নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের’ গোপন বৈঠক:
গত ৮ জুলাই রাজধানীর ভাটারা থানা এলাকার কে বি কনভেনশন সেন্টারে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের উদ্যোগে এক গোপন বৈঠকের আয়োজন করা হয়। সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলা ওই বৈঠকে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ এবং অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীসহ ৩০০ থেকে ৪০০ জন অংশ নেন।

বৈঠকে সরকারবিরোধী স্লোগান দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। সেখানে পরিকল্পনা করা হয়, শেখ হাসিনার নির্দেশ পাওয়ার পর সারা দেশ থেকে নেতাকর্মীরা ঢাকায় সমবেত হবেন, তারা শাহবাগ মোড় দখল করে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করবেন। একইসঙ্গে জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে শেখ হাসিনার ‘প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত’ করবেন।  

ডিবি সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা রয়েছেন। তারা ‘প্রিয় স্বদেশ’, ‘এফ ৭১ গেরিলা’, ‘বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম’, ‘প্রজন্ম ৭১’, ‘শেখ হাসিনা’, ‘আমরা সিটিএম’সহ একাধিক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সক্রিয় ছিলেন।

 

একটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে জানা যায়, ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা সাজাতেই ওই বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছিল। তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গত ১২ জুলাই উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকার একটি বাসা থেকে যুবলীগ নেতা সোহেল রানাকে গ্রেপ্তার করে ভাটারা থানা পুলিশ। একই দিন কাছাকাছি এলাকার আরেকটি বাসা থেকে আওয়ামী লীগ নেত্রী শামীমা নাসরিন (শম্পা)-কে গ্রেপ্তার করা হয়। তার স্বামী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। দুজনকে গ্রেপ্তারের পর ১৩ জুলাই ভাটারা থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দায়ের করেন এক পুলিশ কর্মকর্তা।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, সোহেল রানা ও শম্পাকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করে তথ্য যাচাই করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই বৈঠকে অংশ নেওয়া মেজর সাদিকুল হক ওরফে মেজর সাদিককে হেফাজতে নেওয়া হয়।

আরেক সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে বরগুনার যুবলীগ নেতা সোহেল রানা ও গোপালগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেত্রী শামীমা নাসরিন স্বীকার করেন, মেজর সাদিকের নির্দেশে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে তৃণমূল আওয়ামী লীগ কর্মীদের সংগঠিত করে নাশকতার প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য কে বি কনভেনশন সেন্টারের দ্বিতীয়তলা ভাড়া নেওয়া হয়। সেদিন মেজর সাদিক সরকার উৎখাতের নানা কৌশলের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন।

ওই মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, মামলা নম্বর ২৪। বর্তমানে এই মামলায় গ্রেফতার আছেন ৬৩ জন। আমরা যাদের গ্রেপ্তার করেছি তারা প্রত্যেকেই ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।

এক প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা জানান, সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে দেশে ফেরানোর ছক আঁকতেই তারা ওই গোপন বৈঠক করেছিল। তারা উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে গেলে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতো, তার আগেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের পরিকল্পনা জেনে ফেলে।  

পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, দেশজুড়ে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি। অতীতেও আমরা দেখেছি, বিভিন্ন সময় ও বিশেষ দিনে তারা নাশকতার পরিকল্পনা করেছে। তারা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে চায়। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে এসব অপতৎপরতা রুখে দিতে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে তারা যেকোনোভাবে নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করতে পারে—সে বিষয়ে আমরা সতর্ক আছি। প্রতিটি পুলিশ ইউনিটকে যেকোনো ধরনের অরাজকতা মোকাবিলায় কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পুলিশ কঠোর অবস্থানে রয়েছে, আর জনগণও এখন সচেতন ও সতর্ক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বাংলানিউজকে বলেন, ‘আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের তৎপরতা ও সম্ভাব্য অস্থিরতা নিয়ে এখনই উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে। নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তাদের নেতাকর্মীরা ঝটিকা মিছিল ও মশাল মিছিলের মতো কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে এবং এসবের পরিধি ও অংশগ্রহণ ক্রমেই বাড়ছে। ’

তিনি বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে এ ধরনের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে— যদি রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ অবস্থান না নেয়। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের অভাব দেখা দিয়েছে; বরং কিছু পক্ষের আওয়ামী লীগের সঙ্গে গোপন যোগাযোগের অভিযোগও রয়েছে, যা তাদের পুনরায় সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ দিচ্ছে। ’

যদি ভোটব্যাংকের রাজনীতি সামনে রেখে হিসাব-নিকাশ চলে, তাহলে আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের আগে তাদের এই কার্যক্রম থেকে সংঘাত, সহিংসতা বা নাশকতার ঝুঁকি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ’

সাম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। ঝটিকা মিছিলের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছে। সম্প্রতি একযোগে ২৪৪ জনকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করার পর এ ধরনের কার্যক্রম আরও হ্রাস পেয়েছে। ’

তিনি আশা প্রকাশ করেন, ভবিষ্যতে এসব কার্যক্রম একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে।

এমএমআই/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।