ঢাকা: সদ্যসম্পন্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকেই ডাকসু নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখছিলেন অনেকেই।
এই ফলাফলে দেখা যায়, ৩৮তম ডাকসু নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ভিপি, জিএস, এজিএসসহ ২৮টি পদের মধ্যে ২৩টিতেই জয় পেয়েছে ছাত্রশিবির কিংবা শিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের প্রার্থীরা। এই অভাবনীয় বিজয়, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি সম্পর্কে মানুষের দীর্ঘদিনের প্রচলিত ধারণাকে সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছে।
ছাত্রদলের অপ্রত্যাশিত এই ভরাডুবিতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরাও। ভোটের বিশাল ব্যবধান তাদের হতবাক করেছে। কেন, কোথায় এবং কীভাবে এমন ফল এলো, এর ব্যাখ্যা মিলছে না কারো কাছেই। নানান বিশ্লেষণ ও হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে এর কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন অনেকেই।
ডাকসু নির্বাচনে ভরাডুবির পর বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল প্রকাশ্যে ভোটে অনিয়ম ও অস্বচ্ছতার অভিযোগ তোলে। সংগঠনটির অনেক নেতা দাবি করেন, নির্বাচনে ফল ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য ছাত্রশিবিরের সঙ্গে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের গোপন সমঝোতা হয়েছিল। তবে এসব অভিযোগকে ভিত্তিহীন আখ্যা দিয়ে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে ছাত্রশিবির। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ডাকসুর এই ফলাফলে রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা যেতে চায়, তাদের পাশাপাশি সব রাজনৈতিক দলের জন্যই আরও সচেতন হওয়ার বার্তা রয়েছে।
তারা মনে করছেন, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস, সাংগঠনিক দুর্বলতা, মাঠ যাচাই করে প্রার্থী মনোনয়ন না দেওয়া, বিভক্তি এবং হলে সক্রিয় অবস্থান না থাকা ছাত্রদলের পরাজয়ের বড় কারণ। পাশাপাশি, ছাত্রদল জিতলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের সময়ের মতো নিপীড়ন ফিরবে- প্রতিপক্ষের এমন প্রচারও কাজে দিয়েছে। এছাড়া ছাত্রদলের অতীত ইতিহাস, ক্ষমতা থাকাকালীন বিভিন্ন অভিযোগ, ডাকসুতে তাদের পূর্ববর্তী ভূমিকা, ৫ আগস্ট পরবর্তী প্রেক্ষাপটকে বুঝতে না পারা এবং ছাত্রশিবিরের উত্থানের পেছনের সুসংগঠিত কৌশলগুলোকে ছাত্রদলের পরাজয়ের কারণ হিসেবে দেখছেন কেউ কেউ।
ডাকসু নির্বাচনের শুরু থেকেই ছাত্রদলের কর্মকাণ্ড ছিল মূলত এডহকভিত্তিক। কোনো সুসংগঠিত পরিকল্পনার ছাপ পাওয়া যায়নি। শেষ মুহূর্তে বিএনপির হাইকমান্ডের দৃষ্টি যখন ডাকসুর দিকে যায়, তখন তড়িঘড়ি করে ছাত্রদল ও মূল দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা মাঠে সক্রিয় হন। বিএনপির একাধিক নেতার মতে, সংগঠনটির দীর্ঘদিনের পরিচিতি ও আকারের কারণে তারা ভেবেছিলেন প্রার্থীরা স্বাভাবিকভাবেই জয়ী হবেন। কিন্তু এত বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে, এমন আশঙ্কা তাদের ছিল না।
১৯৭৯ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় বিএনপির ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তারা বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। বিএনপির মূল দলের আদর্শ ও কর্মসূচি বাস্তবায়নেও সংগঠনটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের একটি গৌরবময় ঐতিহ্য থাকলেও এই পর্যন্ত তারা একবারই ডাকসু নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে।
সামরিক শাসন বিরোধী গণআন্দোলনের তুঙ্গে অনুষ্ঠিত ১৯৯০-৯১ এর নির্বাচনে ছাত্রদলের আমানউল্লাহ আমান ভিপি এবং খায়রুল কবির খোকন জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন। সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে ছাত্রদলের এই বিজয় ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছে।
তবে অর্জনের পাশাপাশি ছাত্রদলের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে থাকা নানা নেতিবাচক ধারণা ও অভিযোগকে তাদের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর ঘোষিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছিল। কমিটির কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া কমিটিতে স্থান পেয়েছেন বিবাহিত ব্যক্তি, দীর্ঘদিন রাজনীতির বাইরে থাকা কর্মী এমনকি চাকরিজীবীরাও, যা ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করছেন অনেকে।
অভিযোগ উঠেছে, ৫ আগস্টের পর ছাত্রদলের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন এমন সদস্যের সংখ্যা শতাধিক। শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের সময় দীর্ঘদিনের ত্যাগী ও পরীক্ষিত কর্মীদের উপেক্ষা করে হঠাৎ করে যুক্ত হওয়া নতুনদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এমনকি কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা ছাড়াই তাড়াহুড়ো করে কমিটি ঘোষণার ফলে বিতর্কিত ব্যক্তিরাই বেশি সুযোগ পেয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন সংগঠনটির কয়েকজন নেতা। এছাড়া ক্ষমতায় থাকার সময়ে ছাত্রদলের বিরুদ্ধে হল দখল, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও ছাত্র সহিংসতার মতো গুরুতর অভিযোগের পুনরাবৃত্তি রোধে স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দিতে না পারাও পরাজয়ের আরেকটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টদের মতে, ছাত্রদলের এই অতীত ব্যর্থতা এবং নেতিবাচক অভিযোগগুলো সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। তারা এই সকল অভিযোগগুলোকে ভোলাতে বা নতুন কোনো ইতিবাচক ন্যারেটিভ তৈরি করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় না থাকার কারণে তাদের এই নেতিবাচক অতীত আরও বেশি প্রকট হয়ে ধরা দিয়েছে। নতুন প্রজন্ম, যারা হয়তো সেই সময়ের ঘটনাগুলোর প্রত্যক্ষদর্শী ছিল না, তারাও বিভিন্ন আলোচনা এবং গণমাধ্যমের মাধ্যমে এই নেতিবাচক দিকগুলো সম্পর্কে অবগত ছিল। এর ফলে, ডাকসু নির্বাচনের আগে ছাত্রদলের একটি শক্তিশালী ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়নি, যা তাদের পরাজয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্রলীগের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ছিল। সে সময় গেস্টরুম, গণরুমের নামে হাজারো শিক্ষার্থী নির্যাতনের শিকার হন। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর তার অবসান হয়েছে। ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের প্রতিশ্রুতি ছিল গেস্টরুম সংস্কৃতি, গণরুম আর ফিরবে না। বিপরীতে শিবিরের প্রচার ছিল, ছাত্রদল জয়ী হলে আগের সেই পরিবেশই ফিরবে। এর সঙ্গে ৫ আগস্টের পর দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছাত্রদল নেতাদের বিরুদ্ধে ওঠা চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুনোখুনির অভিযোগগুলোকে অনলাইনে-অফলাইনে ব্যাপকভাবে প্রচার করে ছাত্রশিবির। এই নেতিবাচক প্রচারণা ছাত্রদলের ভাবমূর্তিকে আরও ক্ষুণ্ন করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনে পুরোনো তিক্ত অভিজ্ঞতা ফিরিয়ে আনে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একটি অংশ ছাত্রদলের পরাজয়ে তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতাকেই মূল কারণ হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, আওয়ামী লীগের প্রায় সাড়ে পনের বছরের শাসনামলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে চলা নিপীড়ণের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য ক্যাম্পাসে দীর্ঘ সময় ধরে কার্যক্রম চালাতে পারেনি ছাত্রদল। বিশ্ববিদ্যালয় ও আবাসিক হলে সক্রিয় উপস্থিতি না থাকায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে সদস্য সংগ্রহ বা রিক্রুটমেন্টও যথাযথভাবে সম্ভব হয়নি। এর ফলেই বর্তমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে শক্ত ভিত্তি গড়ে তোলা বা কার্যকর প্রভাব বিস্তার করতে ছাত্রদল এখনও সক্ষম হয়নি।
লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘হলগুলোতে গণরুম ও নিপীড়নের পুনরাবির্ভাব ঘটবে কি না, এ ধরনের প্রশ্ন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রদলের প্রতি আস্থার অভাব তৈরি করেছে। এই পরিস্থিতিতে ছাত্রদল শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্ভূত অস্থিরতা দূর করতে বা ন্যারেটিভটি বদলাতে সক্ষম হয়নি। অন্যদিকে, ছাত্রশিবির এখনও এমন কোনো ধারণা তৈরি করেনি, ফলে পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শিবির এক ধরনের সুবিধা পেয়েছে। ’
আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলে ছাত্রলীগের একক আধিপত্যের পর, ক্যাম্পাসে এক ধরনের আদর্শিক শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। হলের সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতে, ছাত্রদল এই শূন্যতা পূরণ করতে সক্ষম হয়নি। অন্যদিকে ছাত্রশিবির তাদের সুসংগঠিত কর্মী বাহিনী, একাডেমিক উৎকর্ষতা এবং নতুন প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে এই শূন্যতা পূরণ করতে অনেকটাই সক্ষম হয়েছে বলে তারা মনে করছেন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বাংলানিউজকে বলেন, ‘ছাত্রদলের পরাজয়ের মূল কারণ তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা। তারা বহু বছর ক্যাম্পাসে সক্রিয় ছিল না, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগও ছিল না। বরং তারা ভেবেছিল, ক্ষমতার পালাবদলের গতি তাদের স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিজয়ের দিকে নিয়ে যাবে। রাজনীতিতে এমন ভ্রান্ত ধারণা মারাত্মক। অন্যদিকে শিবির কৌশলী হয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় ব্যস্ত ছিল আওয়ামী শাসনামলেও। সেটার ফলই তারা পেয়েছে। ’
আওয়ামী লীগের শাসনামলে যখন ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে একক আধিপত্য বিস্তার করেছিল, তখন ছাত্রশিবির সরাসরি তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি, তবে ছাত্রশিবিরের কর্মীরা অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে ছাত্রলীগের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় অনুপ্রবেশ করে, ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে নিজেদের কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। তারা ছাত্রলীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছে এবং ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করেছে।
এই কৌশল তাদের দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য পূরণে সহায়ক হয়েছিল। ৫ আগস্টের পর এই ছদ্মবেশী কর্মীরা দ্রুত নিজেদের আসল পরিচয় নিয়ে আবির্ভূত হতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে ছাত্রদল এই পুরো ১৬-১৭ বছরই নিজেদের কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি, এমন কী অনেকে সে সময় ক্যাম্পাসেই ঢুকতে পারেনি, যা ছাত্রশিবিরের প্রার্থীদের তুলনায় তাদেরকে পিছিয়ে রেখেছিল।
রাজধানীতে শিবির-সমর্থিত একাধিক কোচিং সেন্টার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এসব কোচিং সেন্টারে গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের স্বল্প খরচে পড়াশোনার সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি তাদের প্রভাবিত করার কাজও করা হয়েছে। ভর্তি হওয়ার পর তাদের গণরুমে থাকার ব্যবস্থা ও নানা সহযোগিতা দেওয়া হয়। এভাবে ধীরে ধীরে তারা শিবিরমুখী একটি সমর্থনভিত্তি তৈরি করেছে। অন্যদিকে ছাত্রদল এই প্রক্রিয়ার কোনো কৌশলই কাজে লাগায়নি, বরং ভেবেছে অভ্যুত্থানের সুফল স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তাদের কাছে আসবে। ফলে তারা সীমিত আকারে দলীয় প্রচারণা চালালেও শিবির বহু মাত্রায় পরিকল্পিতভাবে কাজ করেছে।
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর ছাত্রদল সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে একটি নতুন এবং আশাব্যঞ্জক ন্যারেটিভ তৈরি করতে পারেনি বলেও মনে করছেন ঢাবির শিক্ষার্থীরা। তারা কেবল অতীতের ভুলগুলো নিয়েই সমালোচনামুখর ছিল, কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো কর্মপরিকল্পনা বা ভিশন দিতে পারেনি। এতে ছাত্রদলের অবস্থান দুর্বল করে দিয়েছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ছাত্রদলের উচিত ছিল ক্যাম্পাসে তাদের উপস্থিতি আরও জোরদার করা এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ স্থাপন করা। কিন্তু তারা তা করতে ব্যর্থ হয়। তাদের মতে, ছাত্রদলের নেতারা অধিকাংশ সময় ক্যাম্পাস থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের সরাসরি যোগাযোগ খুব কম ছিল। তাদের কার্যক্রম মূলত মূল দলের কর্মসূচি কেন্দ্রিক ছিল।
ছাত্রদল নিজেদের বিজয় প্রায় নিশ্চিত ভেবে একক প্যানেলেই প্রার্থী দিয়েছে। কিন্তু ফলাফলে দেখা যায়, শিবির ছাড়া অন্য প্যানেলগুলো যে পরিমাণ ভোট পেয়েছে, তা ছাত্রদলের প্রাপ্ত ভোটের সঙ্গে যোগ করলে শিবিরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো শক্তি তৈরি হতো। তবুও ছাত্রদল ঐক্যবদ্ধ কোনো প্যানেল গঠনের উদ্যোগ নেয়নি। বিপরীতে ছাত্রশিবির কৌশলগতভাবে কয়েকটি পদে নিজেদের বাইরে থেকেও প্রার্থী দাঁড় করায় এবং ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ কিংবা ভিন্ন ব্যানারের মাধ্যমে প্যানেল সাজিয়ে সেই ভোটগুলো নিজেদের দিকে টেনে নেয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ দীর্ঘ বছর ধরে রাজনীতি করে এসেছে। কিন্তু নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেই একক ন্যারেটিভ থেকে বেরিয়ে এসে বহুমুখী চিন্তা-ভাবনা করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা কেবল অতীতের ইতিহাস নয়, বরং বর্তমান এবং ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চায়। অতীতের ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগের মতো ছাত্রদলেরও শিবিরকে 'রাজাকার' হিসেবে গণ্য করাকে তাই 'রাজনৈতিক সংকীর্ণতা' মনে করেছেন নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা।
অন্যদিকে শিবিরকে ঘিরে 'উগ্রপন্থী ধর্মীয় সংগঠন' এর যে ট্যাগ লাগিয়ে কিছুটা সুবিধা পাওয়ার চেষ্টাও ছিল ছাত্রদলের প্রচারণায়। কিন্তু ছাত্রশিবির তাদের প্রচারণার কোথাও ধর্মভিত্তিক কোনো বক্তব্য রাখেনি। এটাও শিবিরের একটি অন্যতম কৌশল ছিল বলে মনে করছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা, যা তাদেরকে চূড়ান্ত ফলাফলে সফলতা অর্জন করতে সক্ষম করেছে বলে মনে করছেন তারা।
ছাত্রদলের এই পরাজয়ের পেছনে মূল দল বিএনপিরও কম দায় নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করেন, বিএনপির হাইকমান্ড ছাত্রদলের নেতৃত্ব নির্বাচনে এবং তাদের কর্মপন্থা নির্ধারণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। ছাত্রদলকে একটি শক্তিশালী এবং গতিশীল ছাত্র সংগঠন হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন ছিল, তা বিএনপি দিতে পারেনি। বরং, ছাত্রদলকে মূল দলের লেজুড়বৃত্তি হিসেবেই ব্যবহার করা হয়েছে, যা তাদের স্বকীয়তা এবং কর্মক্ষমতাকে সীমিত করে দিয়েছিল। এছাড়া গত এক বছর বিএনপির নানা স্তরের নেতাকর্মীদের নীতিবহির্ভূত কর্মকাণ্ডও এই নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলে তারা মনে করছেন।
রাষ্টবিজ্ঞানীদের মতে, ছাত্রদলের এই পরাজয় কেবল একটি নির্বাচনের ফলাফল নয়, বরং সংগঠনটির দীর্ঘদিনের ভুল নীতি, সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং পরিবর্তিত ছাত্র রাজনীতির গতিধারা বুঝতে না পারারই প্রতিচ্ছবি। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস, মাঠ যাচাই না করে প্রার্থী মনোনয়ন, অভ্যন্তরীণ বিভেদ এবং ক্যাম্পাসে সক্রিয় উপস্থিতির অভাব ছাত্রদলের এই ভরাডুবির প্রধান কারণ হিসেবে তারা চিহ্নিত করছে।
পাশাপাশি, ছাত্রশিবিরের সুসংগঠিত কৌশল, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা, শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রতিশ্রুতি এবং ডিজিটাল প্রচারণার কার্যকারিতা তাদের অভাবনীয় বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে মত সংশ্লিষ্টদের। তারা মনে করছেন, ছাত্রদলকে যদি ভবিষ্যতে ছাত্র রাজনীতিতে নিজেদের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করতে হয়, তবে তাদের অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে, প্রয়োজন হবে একটি শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামো, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন এবং পরিবর্তিত রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে মানানসই একটি আধুনিক ও প্রগতিশীল কর্মপন্থা।
অনেকেই এই পরাজয় কেবল ছাত্রদলের জন্য নয়, বরং মূল দল বিএনপিসহ বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলের জন্যই একটি সতর্কবার্তা হিসেবেও উল্লেখ করছেন। রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে কেবল অতীত গৌরব বা ক্ষমতার পরিবর্তন নয়, বরং জনসম্পৃক্ততা, সুসংগঠিত কার্যক্রম এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি অপরিহার্য বলেও মনে করছেন তারা।
এসবিডব্লিউ/এজে