ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৭ ভাদ্র ১৪৩২, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

জাতীয় নির্বাচনে কতটা প্রভাব ফেলে ডাকসু?

সিফাত বিনতে ওয়াহিদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮:৩৪, সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৫
জাতীয় নির্বাচনে কতটা প্রভাব ফেলে ডাকসু? ডাকসু নির্বাচন, ছবি: ডি এইচ বাদল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনকে ঘিরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সবসময়ই থাকে বাড়তি আগ্রহ। ঐতিহাসিকভাবে ডাকসু কেবল ছাত্ররাজনীতির নেতৃত্বই তৈরি করেনি, বরং জাতীয় রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণেও একসময় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল।

স্বাধীনতা সংগ্রাম কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ডাকসুর নির্বাচিত নেতৃত্ব মাঠে নেমেছিল সক্রিয়ভাবে। ফলে ডাকসুর নির্বাচনী ফল সবসময় নজর কাড়ে জাতীয় পর্যায়ে। সদ্যসম্পন্ন ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে তাই কতটা প্রভাব ফেলবে- এই প্রশ্ন এখন প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে ডাকসুর নির্বাচনী ফল আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে বড় কোনো প্রভাব নাও ফেলতে পারে। বরং এটি একটি প্রতীকী নির্বাচন হয়েই থাকতে পারে, যার প্রভাব সীমিত থাকবে মূলত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।

ছয় দফা, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান কিংবা নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলন- সবক্ষেত্রেই ডাকসুর সক্রিয় নেতৃত্ব জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করার দীর্ঘ এই ঐতিহ্যের কারণেই ডাকসুকে বলা হয় বাংলাদেশের ‘দ্বিতীয় সংসদ’।

১৯২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে প্রথমবারের মতো কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ প্রতিষ্ঠার পর এখন পর্যন্ত ৩৮ বার ডাকসু নির্বাচন হয়েছে। তবে মূলত স্বাধীনতার পর থেকে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে সরকারগুলোর মধ্যে এক ধরনের অনীহা দেখা যায়। যার ফলে ১৯৭১ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ১৯ বার নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও মাত্র সাতবার এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ডাকসুর নির্বাচন হয়নি। ১৯৯০ সালের পর ২৮ বছর বিরতিতে ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচন হয়। এর ছয় বছর পর মঙ্গলবার অর্থাৎ ৯ সেপ্টেম্বর হলো ৩৮তম নির্বাচন। সবশেষ নির্বাচনে সহ-সভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদক (জিএস) এবং সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে বিপুল ভোটে জয়ী হয় বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল।

১৯৬১ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত, এক দশক জুড়ে ডাকসু নির্বাচনগুলো ছিল পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক চেতনার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ওই সময়গুলো ছিল বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন, আইয়ুব খানের সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং চূড়ান্তভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন বুননের এক অগ্নিগর্ভ অধ্যায়।

ষাটের দশকের শুরুতে ১৯৬১-৬২ সালের ডাকসু নির্বাচনে শেখ ফজলুল হক মনি ভিপি এবং এস.এম. বাকের জিএস নির্বাচিত হন, তারা ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের (আওয়ামী লীগ সমর্থিত) প্রভাবশালী নেতা। তৎকালীন সময় আইয়ুব খানের সামরিক শাসন চলছিল। আওয়ামী লীগ ছিল প্রধান বিরোধী দল। এই নেতৃত্ব ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।  
১৯৬২-৬৩ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (ন্যাপ সমর্থিত) রাশেদ খান মেনন ভিপি এবং কাজী জাফর আহমেদ জিএস নির্বাচিত হন। তারা সামরিক শাসন এবং তৎকালীন শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান নেন। মতিয়া চৌধুরীর মতো একজন নারী নেত্রী ১৯৬৪-৬৫ সালে ভিপি নির্বাচিত হন (ছাত্র ইউনিয়ন), যা তৎকালীন সমাজে এক প্রগতিশীল বার্তা দেয়।

১৯৬৫-৬৬ সালের ডাকসুতে শেখ কামাল ভিপি এবং শাহজাহান সিরাজ জিএস নির্বাচিত হন, যারা ছিলেন ছাত্রলীগ সমর্থিত। এই সময়ের ডাকসু নেতৃত্বই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা আন্দোলনকে ছাত্রদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে এবং দেশব্যাপী সমর্থন আদায়ে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এই সবগুলো নেতৃত্বই ছিল ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠন থেকে আসা এবং তাদের মূল লক্ষ্য ছিল সামরিক স্বৈরশাসনের পতন ও বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠা।

ষাটের দশকের শেষভাগে এসে ডাকসু নেতৃত্ব বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনকে স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসে। ১৯৬৮-৬৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে তোফায়েল আহমেদ ভিপি এবং নাজিম কামরান চৌধুরী জিএস নির্বাচিত হন, দুজনই ছিলেন ছাত্রলীগ সমর্থিত এবং সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম প্রধান নেতা। এই নেতৃত্ব ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। তাদের নেতৃত্বে এগারো দফা আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে, যা আইয়ুব শাহীর পতন ত্বরান্বিত করে।

১৯৬৯-৭০ সালের ডাকসুতে আ স ম আব্দুর রব ভিপি এবং আব্দুল কুদ্দুস মাখন জিএস নির্বাচিত হন, তারা ছিলেন ছাত্রলীগ এবং স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা। এই নেতৃত্বই স্বাধীনতার একবারে দ্বারপ্রান্তের রাজপথে অগ্রভাগে অবস্থান করছিল। আ স ম আব্দুর রব প্রথম প্রকাশ্যে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন এবং স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন, যা ছিল ঐতিহাসিক এক মুহূর্ত। এই নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ ছাত্ররা ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল ভিত্তি স্থাপন করে এবং জনমতকে স্বাধীনতার পক্ষে সংগঠিত করে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পেছনে এই ছাত্র নেতৃত্বের ব্যাপক ভূমিকা ছিল, কারণ তারা মূলত আওয়ামী লীগের পক্ষে জনমত গঠন ও প্রচারণায় নেতৃত্ব দিয়েছিল।

সামগ্রিকভাবে, ১৯৬১ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ডাকসু নির্বাচনে বিজয়ী কোনো ভিপি-জিএস বা তাদের মূল রাজনৈতিক দল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক সরকারে কখনোই ক্ষমতায় ছিলেন না। এই ডাকসু নির্বাচনগুলো সরাসরি জাতীয় সংসদ বা প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করেনি, কারণ এগুলো ছিল মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ নির্বাচন। তবে এই দশকে ডাকসু নেতৃত্বের ভূমিকা ছিল জাতীয় রাজনীতিতে অপরিসীম এবং সুদূরপ্রসারী।

তারা সামরিক স্বৈরশাসন এবং ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিটি গণআন্দোলনের সম্মুখভাগে থেকে জনমত গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ডাকসু মঞ্চ থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ ফজলুল হক মনি, তোফায়েল আহমেদ, রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরী এবং আ স ম আব্দুর রবের মতো অসংখ্য জাতীয় নেতার রাজনৈতিক হাতেখড়ি ও উত্থান হয়, যারা পরবর্তীতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এবং স্বাধীনতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

স্বাধীনতার পর ডাকসু নির্বাচনের ফলাফলের দিকে নজর দিলে দেখা যাবে- জাতীয় সংকট, জন মানুষের আন্দোলন এবং সামগ্রিক জাতীয় রাজনীতিতে ডাকসু নিজস্ব অবস্থান তৈরি করতে পারলেও জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলে সেসময় ডাকসু নির্বাচনগুলো বা এর বিজয়ী নেতৃত্ব প্রত্যক্ষভাবে তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। এর পেছনে রয়েছে তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁক।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালে। এই নির্বাচন ছিল নতুন প্রজন্মের কাছে একটি গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতিফলন। সেসময় ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থী মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ভিপি এবং মাহবুব জামান জিএস নির্বাচিত হন। তৎকালীন সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। বিজয়ী ছাত্র ইউনিয়ন ছিল বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) ছাত্র সংগঠন। তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্ষমতাসীনদের বাইরে স্বাধীনভাবে তাদের নেতৃত্ব বেছে নিয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীতে এই নির্বাচনের ফলাফল জাতীয় নির্বাচনে কোনো ভূমিকা রাখেনি।

এর এক বছর পর, ১৯৭৩ সালেও ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, কিন্তু কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে ফলাফল স্থগিত হয়ে যায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সেসময় জাসদ ছাত্রলীগের জনপ্রিয়তা ঠেকাতে ছাত্রলীগ (মুজিববাদী) ও ছাত্র ইউনিয়ন ডাকসুতে যৌথ প্যানেল দেয়। ছাত্রলীগকে প্রায় অর্ধেক আসন ছাত্র ইউনিয়নকে ছেড়ে দিতে হয়। এতে ছাত্রলীগে সংকট বাড়ে এবং একটি অংশ ভোটের ক্যাম্পেইনে ‘নিষ্ক্রিয়’ হয়ে পড়ে। এদিকে, সরকারবিরোধী আন্দোলনের কারণে জাসদ ছাত্রলীগের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। তবে, সরকারবিরোধী ভূমিকা থেকে বন্ধুপ্রতীম সংগঠনে পরিণত হওয়ায় ছাত্র ইউনিয়নের জনপ্রিয়তা কমে যায়। ওই বছর নির্বাচনের ফলাফল স্থগিত হয়ে যাওয়াকে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ছাত্র আন্দোলনের ওপর রাষ্ট্রীয় প্রভাব বিস্তারের ইঙ্গিত বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

১৯৭৫ সালের পট পরিবর্তনের পর দীর্ঘ বিরতিতে ১৯৭৯ সালে আবারও ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই সময়ে দেশে রাজনৈতিক পটভূমি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সামরিক শাসন এবং তার পরে গণতান্ত্রিক ধারার সূচনা হলেও, ক্ষমতার কেন্দ্র ছিল ভিন্ন মেরুতে। ১৯৭৯ সালে জাসদ-ছাত্রলীগের প্যানেলে ভিপি নির্বাচিত হন মাহমুদুর রহমান মান্না এবং জিএস নির্বাচিত হন আখতারুজ্জামান। তৎকালীন সময়ে ক্ষমতায় ছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। তখনো ডাকসুর নেতৃত্ব ছিল ক্ষমতার বাইরে থাকা ছাত্র সংগঠনের হাতে।

১৯৮০ সালেও মাহমুদুর রহমান মান্না দ্বিতীয়বারের মতো ভিপি নির্বাচিত হন বাসদ-ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে, যেখানে জিএস হন আখতারুজ্জামান। এরপর ১৯৮২ সালে আখতারুজ্জামান ভিপি নির্বাচিত হন এবং জিএস হন বাসদ-ছাত্রলীগের জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। এই সময়গুলো ছিল সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বা সীমিত গণতন্ত্রের আবহে ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয় সময়। কিন্তু ডাকসুর এই নির্বাচিত নেতৃত্ব তাদের নিজ নিজ রাজনৈতিক দলকে জাতীয় পর্যায়ে ক্ষমতায় আনতে বা জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়নি। তাদের ভূমিকা ছিল মূলত ছাত্র আন্দোলনকে বেগবান করা এবং গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে জোরদার করা।

১৯৮০-এর দশকের পুরোটা জুড়েই স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী আন্দোলন ছিল তুঙ্গে। এই আন্দোলনের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ডাকসু। ১৯৮৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ থেকে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ ভিপি এবং জাসদ ছাত্রলীগ থেকে মুশতাক আহমেদ জিএস নির্বাচিত হন। এই প্যানেলটি ছিল ছাত্রলীগসহ বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোর একটি যৌথ প্যানেল, যা এরশাদবিরোধী আন্দোলনের একটি প্রতীকী জোট হিসেবে কাজ করেছিল। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা স্বৈরাচারবিরোধী ঐক্যের বার্তা দেয়।

১৯৯০ সালে স্বৈরাচার পতনের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের প্যানেল জয়লাভ করে। এ সময় আমানউল্লাহ আমান ভিপি নির্বাচিত হন এবং খায়রুল কবির খোকন জিএস হন। উভয় নির্বাচনই এরশাদ সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং বিজয়ী ছাত্র সংগঠনগুলো ছিল তৎকালীন বিরোধী রাজনৈতিক দলের সহযোগী সংগঠন। এই সময় ডাকসু নেতৃত্ব স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলকে সরাসরি প্রভাবিত করার মতো ক্ষমতা তাদের হাতে ছিল না। বরং জাতীয় রাজনীতির গতিপথই ডাকসু নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করেছে বেশি।

দীর্ঘ ২৮ বছর পর ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে ভিপি পদে নির্বাচিত হন কোটা সংস্কার আন্দোলনের আলোচিত মুখ নুরুল হক নুর। তিনি বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের প্যানেল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবার নজর কাড়েন। নুরের বিজয় ছিল অপ্রত্যাশিত, কারণ তিনি কোনো প্রতিষ্ঠিত বড় ছাত্র সংগঠনের প্রার্থী ছিলেন না। তার বিজয় দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে ভিন্নধারার ছাত্র রাজনীতির প্রতি শিক্ষার্থীদের সমর্থনের ইঙ্গিত বহন করে।  

কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে নুরের উত্থান এবং ডাকসু ভিপি হিসেবে তার আলোচিত কিন্তু প্রতিবাদী ভূমিকা তাকে তরুণ সমাজের একটি অংশের কাছে জনপ্রিয় করে তোলে। পরবর্তীতে তিনি ‘বাংলাদেশ গণঅধিকার পরিষদ’ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। এই দলটি মূলত বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার বাইরে তৃতীয় একটি শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে।

সে সময়ের ডাকসু নির্বাচন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ফলে, ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের ওপর কোনো প্রভাব ফেলার সুযোগ ছিল না। রাজনৈতিক দল গঠনের পর ২০২৪ সালে নুর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে দল নিবন্ধনের আবেদন করলেও তা পেতে ব্যর্থ হন। তবে ২০২৪ সালে তার দল নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন লাভ করে এবং চলতি বছর দলের উচ্চতর পরিষদের সিদ্ধান্তে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‌৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়৷

অন্যদিকে, ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে জিএস পদে নির্বাচিত হন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ মনোনীত প্রার্থী গোলাম রাব্বানী। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, রাব্বানীর বিজয়ের মধ্য দিয়ে ডাকসুর ওপর ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়েছিল। দীর্ঘ ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে নানা অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ উঠেছিল, যেখানে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের প্রভাব খাটানোর অভিযোগ ছিল প্রকট।

রাব্বানীর বিজয় ক্ষমতাসীনদের প্রভাবেরই ফল ছিল বলে তারা মনে করেন। জিএস হিসেবে গোলাম রাব্বানীর ভূমিকা সরাসরি জাতীয় রাজনীতিতে বড় কোনো প্রভাব ফেলেনি। তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ড বরং ছাত্র রাজনীতির অভ্যন্তরেই বেশি আলোচিত ছিল। তার প্রভাব ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ৩৮তম ডাকসু নির্বাচনে বিস্ময়করভাবে ভিপি-জিএস-এজিএস পদে বিজয়ী হয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্যানেল। তারা দেশের অন্যতম প্রধান এবং বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্যানেলকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে নতুন এক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।  

এই ফলাফল এমন এক সময়ে এসেছে যখন দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অত্যন্ত পরিবর্তনশীল, বর্তমানে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ রয়েছে এবং তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে সংগঠন হিসেবেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে অনেকে বুঝতে চাইছেন, আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ডাকসু নির্বাচনের এই ফলাফল জাতীয় রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলার ইঙ্গিত দিচ্ছে কি?

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ছাত্রদলের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী এবং বড় ছাত্র সংগঠনকে বিপুল ভোটে পরাজিত করা শিবিরের সাংগঠনিক সক্ষমতা এবং আদর্শিক দৃঢ়তার পরিচায়ক। এই বিজয় নিঃসন্দেহে জামায়াততে আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে। কিন্তু অতীতের মতোই জাতীয় রাজনীতিতে তেমন প্রভাব ফেলতে পারবে না।

লেখক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ এ প্রসঙ্গে বাংলানিউজকে বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচনে হার-জিতের ব্যাপারটা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এখন ইজ্জতের লড়াই হয়ে গেছে। যে কারণে এই নির্বাচন ও এর ফলাফল নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে উচ্ছ্বাস ও আশঙ্কা থাকে। স্বাভাবিকভাবেই এই জয়ে বিজয়ীদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে এবং এর ধারাবাহিকতা জাতীয় নির্বাচনেও তারা ধরে রাখার চেষ্টা করবে। ’

স্বাধীন বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি নির্বাচনে দলটি অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায়নি। দুটি নির্বাচন জামায়াত বর্জন করেছিল—একটি এরশাদের অধীনে ১৯৮৮ সালের ৩রা মার্চের নির্বাচন, আরেকটি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন। একটি নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক লীগের ব্যানারে অংশ নিয়েছিল। আরেকটি নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে অংশগ্রহণ করে। দলটির নিজস্ব প্রতীক দাঁড়িপাল্লা নিয়ে ৫টি সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পেরেছে।

দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নিয়ে জামায়াতের অংশগ্রহণ করা পাঁচটি নির্বাচন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিগত পাঁচটি নির্বাচনে দলটি গড়ে ৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে। এসব নির্বাচনে এ পর্যন্ত ৫০টি আসন পেয়েছে জামায়াত। তাদের অর্জিত গড় আসন মাত্র ১০টি। ভোটের মাঠে গড়ে ১০টি আসন পাওয়ার মতো উপযোগী রাজনৈতিক দল স্বভাবতই তাই সামনের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আরও বেশি সংখ্যক আসন প্রাপ্তির প্রত্যাশা করছে।

ডাকসুতে বিজয়ের পর জামায়াতে ইসলামী জাতীয় রাজনীতিতে নতুন করে দাপট দেখানোর চেষ্টা করবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা। তাদের এই বিজয়কে তারা নিজেদের জনপ্রিয়তা এবং জনগণের সমর্থনের প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরতে চাইবে। যেহেতু আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং আগামী নির্বাচনে দলটির অংশগ্রহণের সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে, তাই রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণে জামায়াত এই সুযোগ কাজে লাগাতে চাইবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

অন্যদিকে ডাকসুতে ছাত্রদলের ভরাডুবি বিএনপির জন্য এক বিরাট উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে বলেও মনে করছেন কেউ কেউ। এই ফলাফল বিএনপিকে সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং তরুণ প্রজন্মের কাছে তাদের আবেদন কমে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে ভাবতে বাধ্য করবে তারা মন্তব্য করছেন। জামায়াত ডাকসু নির্বাচনের ফলাফলের সুযোগ নিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসন ভাগাভাগির ক্ষেত্রে বিএনপির ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে বলে তারা ধারণা করছেন।

আসন ভাগাভাগির ক্ষেত্রে তাই নতুন দর কষাকষির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে বলেও তারা মনে করছেন। ডাকসু নির্বাচনের ফলাফলকে হাতিয়ার করে জামায়াত চাইবে সর্বোচ্চ আসনে ছাড় আদায় করতে চাইবে। বিএনপির জন্য তা কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে বলে মত দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, বিএনপি যদি ডাকসু নির্বাচনের ফলাফলে শঙ্কিত হয়ে জামায়াতের দরকষাকষির ফাঁদে পা দেয়, তবে নিজেদের বড় ক্ষতি করার সম্ভাবনা রয়েছে। জামায়াতের দাবি মেনে নেওয়া বা তাতে নমনীয় হওয়া বিএনপির ভাবমূর্তি এবং মধ্যপন্থী ভোটারদের কাছে নেতিবাচক বার্তা দিতে পারে বলে তারা মত দিচ্ছেন। বিশেষ করে, আন্তর্জাতিক মহলেও এটি বিএনপির গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। জামায়াতের আদর্শিক অবস্থান এবং অতীত ইতিহাস বিবেচনা করে বিএনপিকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে বলে তারা মনে করছেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ এ প্রসঙ্গে বাংলানিউজকে বলেন, ডাকসু নির্বাচনকে জাতীয় নির্বাচনের পরীক্ষাগার বলা যেতে পারে, কিন্তু এটিকে জাতীয় নির্বাচনের ভবিষ্যৎ ফলাফল নির্ধারণী উপাদান ভাবা ভুল হবে। ভোটার কাঠামো, প্রেক্ষাপট, ইস্যু- সবকিছুই আলাদা। এখানকার বিজয়ীদের কেউ কেউ বড় রাজনীতিবিদ হয়েছেন। কিন্তু অনেকেই এখনও সংগ্রাম করে যাচ্ছেন৷ এটাই হচ্ছে শিক্ষাঙ্গনের রাজনীতির সঙ্গে জাতীয় রাজনীতির পোস্টমর্টেম।

অতীতের ইতিহাস দেখিয়েছে, ডাকসুর বিজয়ী নেতৃত্বের অনেকেই পরবর্তীতে জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তবুও তা প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলে স্বয়ংক্রিয় প্রভাব তৈরি করেনি। ২০১৯ ও ২০২৫ সালের ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল যেমন নতুন নেতৃত্ব ও ছাত্র সংগঠনগুলোর মনোবলকে বাড়িয়েছে, তেমনই রাজনৈতিক দলগুলোর কৌশল ও ভাবমূর্তিতেও প্রভাব ফেলেছে, কিন্তু তা মূল জাতীয় ভোটের ফলাফল নির্ধারণের ক্ষমতায় নেই বলেই মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।

এসবিডব্লিউ/এইচএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।