এক সময়ের পরিচিত বিকেলের গন্ধটা এখন বদলে গেছে। বর্ষায় স্যাঁতস্যাঁতে মাটি, কচি গাছ ভেজা বাতাসে যে একটা সজীবতা ছিল, সেটা যেন আজকের ঢাকায় নিঃশব্দে হারিয়ে যাচ্ছে।
এই মশা ফুলে পরাগায়ন করতো, যাদের লার্ভা জলাশয়ের ব্যাকটেরিয়া খেয়ে পুকুর পরিষ্কার রাখতেও সহায়তা করতো। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তারা অন্য রক্তখেকো ক্ষতিকর মশার লার্ভা খেয়ে বংশবিস্তার নিয়ন্ত্রণে রাখতো। এই উপকারী মশা আজ ঢাকার জলাশয় থেকে বিলুপ্তপ্রায়।
ঢাকায় এখন কামড় দেওয়া, রক্ত শোষণ করা, মৃত্যু বয়ে আনা প্রাণঘাতী মশার আধিপত্য। এ ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর হিসাব কষতে গেলে আঙুল ছুঁয়ে শেষ হয় না।
‘শৈশবকালে আমাদের গ্রামের বাড়িতে প্রায়ই দেখতাম পুকুরের ধারে বড়সড় লার্ভা ঘুরে বেড়ায়, এগুলো হাতি মশা বলতাম আমরা, এখন আর দেখি না। এখন ঢাকায় শুধু দেখি ছোট ছোট কালচে মশা, এক কামড়েই মাথা ঘুরে যায়,’ বলছিলেন রাজধানীর হাতিরঝিলের ৩৪ বছর বয়সী মারুফ ইসলাম, যিনি ঢাকায় বসবাস করছেন প্রায় ১৫ বছর। সম্প্রতি ডেঙ্গুতে অসুস্থ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি।
হাতিরঝিলের আশপাশের এলাকায় সারাদিনই মশার উৎপাত লেগে থাকে, সিটি কর্পোরেশন থেকে ওষুধ দেওয়া হলেও মশার উপদ্রবে জীবন হারানোর দশা নগরবাসীর, বলেন ভুক্তভোগী মারুফ।
হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির ‘প্রাকৃতিক কীটনাশক’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার দীর্ঘদিন নানা প্রজাতির মশা ও বিভিন্ন ধরনের কীটপতঙ্গ নিয়ে গবেষণা করছেন। টক্সোরিঙ্কাইটিস মশার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই মশা অন্যান্য মশার মতো রক্তখোকো নয়। এ প্রজাতির প্রাপ্তবয়স্ক মশা রক্ত না খেয়ে বিভিন্ন শর্করাবিশিষ্ট পদার্থ যেমন- ফুলের মধু, ফলের রস, ক্ষতিগ্রস্ত গাছের রস ও স্যাপ, গাছের মধুরস, এমনকি পচনশীল জৈববস্তুর নির্যাস খেয়ে বেঁচে থাকে। এ ধরনের খাদ্যাভ্যাসের কারণে তারা পরাগায়ণ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। টক্সোরিঙ্কাইটিস মশা দেখতে সাধারণ মশার তুলনায় বেশ বড়। এর শরীরে নীল-সবুজ রঙের ধাতব আভা বিদ্যমান, যা একে সহজেই অন্যদের থেকে আলাদা করে চেনার সুযোগ দেয়। লার্ভা বা শূককীট অবস্থায় এরা পরিণত হয় ভয়ংকর শিকারিতে। এরা ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক এডিস মশা এবং ম্যালেরিয়া পরজীবীর বাহক অ্যানোফিলিস মশার শূককীটদের শিকার করে খেয়ে ফেলে। ফলে এটি প্রাকৃতিকভাবে ক্ষতিকর মশার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং রোগ ছড়ানো প্রতিরোধে সরাসরি ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে পচনশীল জৈব পদার্থ ভেঙে এটি প্রাকৃতিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়ও অবদান রাখে। তবে গত এক দশকে এই মশার প্রজাতি শহরের জলাশয় থেকে বিলুপ্তপ্রায়।
‘এই মশা বাঁচিয়ে রাখাই ছিল প্রাকৃতিক মশা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রথম লাইন। সেটা আমরা হারিয়ে ফেলেছি জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ ও অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে,’ বলেন ড. কবিরুল বাশার।
ঢাকায় মশা মানেই এখন মৃত্যু
২০২৪ সালের সরকারি হিসাব বলছে, শুধু ঢাকায় ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ১১৬৩ জন। আক্রান্তের সংখ্যা পৌঁছেছে প্রায় এক লাখ সত্তর হাজারে, যেখানে এক বছর আগেই এই সংখ্যা ছিল এক লাখ আটত্রিশ হাজারের মতো। মাত্র এক বছরে এই সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ২৩ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গু ড্যাশবোর্ড অনুযায়ী, চলতি বছরের শুরুর ছয় মাসেই আক্রান্তের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়েছে। জুলাইয়ের প্রথম দুই সপ্তাহেই আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ১৬ হাজার। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্তের হার। সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন গড়ে ৫০ থেকে ১০০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, আইসিইউ শয্যা বরাদ্দে সংকট দেখা দিচ্ছে। প্লাটিলেট কমে যাওয়া, ডেঙ্গু হেমোরেজিক সিনড্রোম বা শক সিনড্রোম নিয়ে যেসব রোগী আসছেন, তাদের মধ্যে অনেকে হাসপাতালের বিছানাও পাচ্ছেন না সময়মতো। এদের অনেকেরই বয়স কম, স্কুলে যাওয়া ছোট ছেলেমেয়েরাও আক্রান্ত হচ্ছে দ্রুতগতিতে।
চিকিৎসা সংক্রান্ত একটি সমীক্ষা (Clinical Profile of Dengue Patients, ২০২৪) বলছে, ১০৭ জন রোগীর ওপর গবেষণায় দেখা গেছে, ৫৭ শতাংশ রোগী সাধারণ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলেও, ২৬ শতাংশের প্লাটিলেট ট্রান্সফিউশন প্রয়োজন হয়েছে, ১১ শতাংশ রোগীকে আইসিইউতে নিতে হয়েছে। প্রায় অর্ধেক রোগীই আক্রান্ত হয়েছিলেন ঢাকার ভেতরে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ড্যাশবোর্ড বলছে, শুধু ১৭ জুলাইয়ের মধ্যেই নতুন ৩২১ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী ছিলেন ঢাকার দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকাগুলোর। খিলগাঁও, মুগদা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, উত্তরা, ধানমণ্ডি প্রতিটি এলাকাতেই প্রতিদিন রোগী আসছেন নতুন করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উষ্ণতা ও আর্দ্রতা বাড়ায় মশার প্রজননক্ষেত্রও বাড়ছে। বিশ্বজুড়েই উপকারী মশাগুলোর হার কমেছে, আর সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে ডেঙ্গু, জিকা, চিকুনগুনিয়ার মতো ভাইরাস।
ঢাকায় পরিস্থিতি এখন এতটাই ভয়াবহ যে, একেকটি গামলায় জমে থাকা পানিতে ছোট একটি ভুলেই পরিবারে নেমে আসতে পারে শোক। এই শহরে প্রতিদিন একটি মশার কামড়েই শুরু হতে পারে হাসপাতালে যাওয়ার যাত্রা। আর এই পথে শেষ গন্তব্য যেন না হয় চিরতরে বিদায়, সে জন্য দরকার এখনই সচেতনতা, বিজ্ঞানভিত্তিক উদ্যোগ এবং পরিবেশের পুনরুদ্ধার, বলছেন পরিবেশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান।
রাজধানীর কুড়িল এলাকায় দীর্ঘ বছর যাবত বসবাস করছে জিসানের পরিবার। ৩ বছরের ছোট্ট জিসান ২০২৪ সালের আগস্টে হঠাৎ জ্বরে আক্রান্ত হয়, পরে রক্তপাত। হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা বলেন, ‘ডেঙ্গু শক সিনড্রোম’। দুই দিনের মধ্যেই পরিবারকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে চিরতরে চলে যায় জিসান।
‘আমি জানতাম না যে ঘর পরিষ্কার রাখার পরও কীভাবে আমার বুকের ধন এই মরণ কামড়ের শিকার হলো। দুই ভাই-বোনের মধ্য জিসান ছিল ছোট। আমার অনেক সাধনার সন্তান ছিল সে। মেয়ের জন্মের ১৪ বছর পর এই বাচ্চা আসে আমাদের জীবনে। কিন্তু এই অপরিকল্পিত দূষণের শহর তার জীবনকে সংক্ষিপ্ত করে দিল। আমরা একটা মৃত্যুপুরীতে বাস করছি,’ আক্ষেপ নিয়ে বলেন জিসানের বাবা মামুন মিয়া।
ঢাকার পরিবেশ এডিস মশার জন্য
২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক জার্নাল প্যারাসাইটস অ্যান্ড ভেকটরস (Parasites & Vectors)‑এ প্রকাশিত ঢাকা শহরকেন্দ্রিক একটি গবেষণায় (Conducted by: Jahangirnagar University in collaboration with Malaria Elimination Initiative, UCSF) দেখা গেছে, এডিস মথা এখন দিনে এবং রাতেও কামড়াচ্ছে। এরা প্লাস্টিকের কাপ, নির্মাণাধীন ভবনের কাঠের বাক্স, পরিত্যক্ত টায়ার, বোতলের ছিপি ও এসির নিচে জমে থাকা পানিতেও প্রজনন করছে।
এই গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, শহরের আবাসিক এলাকাগুলোতে ৭৪ শতাংশ মশার লার্ভা পাওয়া গেছে প্লাস্টিক ও অন্যান্য কৃত্রিম পাত্রে জমা পানিতে। গবেষণাটি জানায়, শুধু পাত্র অপসারণ বা ধোঁয়া স্প্রে করেই এখন আর এই মশার বিস্তার রোধ করা যাচ্ছে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও (WHO, 2021 Climate and Vector Report) একই ধরনের পর্যবেক্ষণ জানায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এডিস মশা আচরণ বদলাচ্ছে। রাতেও তারা সক্রিয় হচ্ছে, যা আগে ছিল না।
ঢাকা শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, উন্মুক্ত নালা ও জলাবদ্ধ আবর্জনার স্তূপ তাদের জন্য হয়ে উঠেছে আদর্শ প্রজননক্ষেত্র। যে কারণে এখন এমন অনেক এলাকা রয়েছে, যেখানে নিয়মিত ফগিং বা স্প্রে চললেও মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন, বলেন পরিবেশবিদ ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) সংগঠনের সদস্য-সচিব শরীফ জামিল।
এই পরিস্থিতি নিছক স্বাস্থ্য সংকট নয়, বরং পরিবেশ ব্যবস্থাপনার এক গভীর ব্যর্থতা, যেখানে প্লাস্টিক দূষণ, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন মিলেমিশে তৈরি করছে মরণঘাতী মশার স্বর্গ, যুক্ত করেন তিনি।
পরিবেশের পরিবর্তন, মশার পরিবর্তন
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তন ও অনিয়ন্ত্রিত নগরায়নই এডিস মশার বিস্তার বাড়িয়েছে। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী যেখানে উপকারী মশাগুলোর ঘনত্ব কমেছে, সেখানেই ডেঙ্গু বা জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়েছে।
ঢাকা এই বৈশ্বিক প্যাটার্নের একটি বাস্তব ও ভয়াবহ উদাহরণ। এখানে প্রতিদিনের জীবন এখন এক অনিশ্চয়তা, যেখানে একটি মশার কামড়ই হতে পারে মৃত্যুর কারণ।
এদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনসেক্ট রিয়ারিং অ্যান্ড এক্সপেরিমেন্টাল স্টেশন (ওজঊঝ)-এর গবেষকরা ইতোমধ্যে উপকারী মশার একটি স্থায়ী প্রজনন কলোনি তৈরির জন্য কাজ করছেন। গবেষণাটি সফল হলে এটি পরিবেশদূষণহীন ও টেকসই এক রোগনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার পথ খুলে দেবে। এই প্রজাতির মশা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। অনেকেই এর বড় আকৃতি ও উজ্জ্বল রং দেখে আতঙ্কিত হতে পারেন। কিন্তু জানা দরকার, এই মশাটি মানুষের জন্য সম্পূর্ণ নিরীহ এবং উপকারী। এ ধরনের মশা দেখা গেলে ভয় না পেয়ে তাকে রক্ষা করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
ঢাকার মানুষ এখন শুধু ট্রাফিক বা দূষণ নয়, মশার ভয় নিয়েই দিন কাটায়। অথচ এক সময় প্রকৃতিতেই ছিল প্রতিকার, উপকারী মশাই ছিল আমাদের প্রথম প্রহরী। তাদের হারিয়ে নিজেদের অসহায় করে তুলেছি আমরা। এখন সময় প্রকৃতির সেই হারিয়ে যাওয়া সৈনিকদের ফিরিয়ে আনার, আর শহরকে সত্যিকারের বাসযোগ্য করে তোলার, বলেন পরিবেশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান।
পিএ