ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১০ জুন ২০২৫, ১৩ জিলহজ ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

যে কারণে ‘বাধাহীন বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ’ পান আবদুল হামিদ

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:২২, জুন ৯, ২০২৫
যে কারণে ‘বাধাহীন বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ’ পান আবদুল হামিদ রোববার রাতে দেশে ফেরেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ

ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন মোহাম্মদ আবদুল হামিদ। বাংলাদেশের ২০তম ও ২১তম রাষ্ট্রপতি ছিলেন (ব্যক্তিগতভাবে ১৭তম) তিনি।

এর আগে জাতীয় সংসদের স্পিকার; তারও আগে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ফ্যাসিস্ট পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে চিকিৎসার জন্য তার বিদেশে যাওয়া ও পরে দেশে ফেরাকে ঘিরে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে, তার বিরুদ্ধে মামলা থাকা সত্ত্বেও কোনো আইনি ব্যবস্থা না নেওয়ায় সমালোচনা আরও তীব্র হয়েছে। বিষয়টি ঘিরে সরকারের ভূমিকা নিয়েও বিতর্ক চলছে।

গত ৭ মে গভীর রাতে থাই এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে ঢাকা ত্যাগ করেছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কিশোরগঞ্জের এক মামলার আসামি হয়েও তিনি কীভাবে দেশত্যাগ করলেন তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে তখন থেকেই। এ নিয়ে নানা আলোচনা-বিতর্কের মধ্যে রোববার (৮ জুন) রাত দেড়টায় থাই এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে আবদুল হামিদ ঢাকা ফেরেন। ফ্লাইটটি (টিজি ৩৩৯) অবতরণের পর আনুষ্ঠানিকতা শেষে রাত পৌনে তিনটার দিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করেন তিনি।

আবদুল হামিদ দেশে ফেরার পর তাকে গ্রেপ্তার করা, না করার বিষয়টি সামনে আসে। সরকার অবশ্য বলেছে, গত ১৪ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জ সদর থানায় তার বিরুদ্ধে হওয়া হত্যা মামলা নিয়ে তদন্ত চলছে। এতে তিনি দোষী প্রমাণ হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাছাড়া এ বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের এক কমিটিও রয়েছে। তাকে গ্রেপ্তারের ব্যাপারে কমিটির রিপোর্টও জরুরি।   

প্রশ্ন এও উঠেছে, হত্যা মামলা থাকার পরও সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বিনা বাধায় বিদেশ ভ্রমণ করলেন কীভাবে? এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত একজন সাবেক রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে আগেই কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিতে চাচ্ছে না সরকার। তদন্তে যদি তিনি দোষী না হন বা ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ না পাওয়া যায় তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে। দোষ প্রমাণ না হলে আগেই একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বা শাস্তি দিতে চায় না সরকার।   

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হয়ত এ কারণে তার বিদেশ ভ্রমণ সহজ হয়েছে। তবে বড় ব্যাপার হলো, আবদুল হামিদ পর পর দুইবারের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন। যে কারণে দেশের বাইরে তার চিকিৎসা নিতে যাওয়া ও দেশে ফিরে আসা বিনা বাধায় সম্ভব হয়েছে।   

আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানা পরিদর্শনে গিয়ে তিনি বলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি দোষী প্রমাণিত হলে তিনি শাস্তি পাবেন।   

তাকে প্রশ্ন করা হয়, একজন সাবেক রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে মামলা থাকা সত্ত্বেও কেন এখনো কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি? উত্তরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আপনারাই (সাংবাদিক) বলেছেন, কিছু কিছু মামলা এখনো তদন্ত হয়নি। তদন্ত হওয়ার পরে যে দোষী হবে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। আপনারাই বলেছেন, নির্দোষরা যাতে সাজা না পায়। এজন্য আমাদের তদন্তটা করতে দেন। তদন্ত করার পর যে-ই দোষী হোক না কেন, কাউকে আইনের বাইরে রাখা হবে না। তাকে আমরা আইনের আওতায় নিয়ে আসবো।

ফৌজদারি মামলা যাদের বিরুদ্ধে রয়েছে, তদন্তে প্রমাণ না হলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না— বিষয়টি নিশ্চিত করতে চাইলে তিনি বলেন, তারা ওইভাবে প্রমাণিত না হলে কেন একজন নির্দোষ লোককে আমি সাজা দেব? দোষী যে হবে, তাকে আমরা শাস্তি দেব। এখন কিশোরগঞ্জের এদের ক্ষেত্রে উপদেষ্টাদের তিনজনের একটি কমিটি হয়েছে। উনারা একটি রিকমেন্ডেশন দেবে। ওই রিকমেন্ডেশন পাওয়ার পর ওনারা যদি দোষী হয়, তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর দোষী না হলে, ওনাদের যার যার জায়গায় ফেরত দেওয়া হবে।

এ বিষয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (উত্তরাঞ্চল) মুখ্য সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, আমরা আমাদের জায়গা থেকে এটাই বলব—অন্তর্বর্তী সরকার অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকার, অভ্যুত্থানের ম্যান্ডেট পাওয়া সরকার। যারা এত দিন ধরে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও তাদের যারা এমন দোসর ছিল, যারা তাদের ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে সহযোগিতা করেছে—তাদের সামগ্রিক বিষয়গুলোতে অন্তর্বর্তী সরকারের কঠোর হস্তক্ষেপ চাই এবং এটা আইনগত প্রক্রিয়ায় যেন হয়।

সারজিস আলম বলেন, আমরা এই বিষয়টি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামগ্রিক যে স্টেপ এবং কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন তারা—আমরা এ বিষয়টি অবজার্ভ করছি। আমরা বিশ্বাস করি, তারা অন্তত এসব প্রশ্নে তাদের জায়গা থেকে তাদের শক্ত অবস্থান সব সময় তাদের কাজের মাধ্যমে ব্যক্ত করবেন।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর কিশোরগঞ্জ সদর থানায় পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ মোট ১২৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়। ১৪ জানুয়ারি দায়ের হওয়া এ মামলায় অন্যতম আসামি করা হয় আবদুল হামিদকে। মামলা মাথায় নিয়ে ৭ মে তিনি দেশ ছাড়ার পর নানা বিতর্কের মাঝে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি রাজপথে আরও জোরালো হয়ে ওঠে। নানা রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতাকর্মীরা আন্দোলনে নামে। চাপে থাকা অন্তর্বর্তী সরকার ১০ মে রাতে উপদেষ্টা পরিষদের এক বিশেষ সভায় সিদ্ধান্ত নেয়— আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও তাদের নেতাদের সকল কার্যক্রম (সাইবার স্পেসসহ) নিষিদ্ধ থাকবে।   

আবদুল হামিদের বিনা বধায় দেশত্যাগে দায়িত্বে অবহেলার কারণে তিন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তার বিদেশ যাওয়ার ঘটনা তদন্তে গত ১১ মে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করে সরকার। কমিটির কমিটির সভাপতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক সি. আর. আবরার; সদস্য হিসেবে রয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, এবং নৌ-পরিবহন ও শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। কমিটির রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছিল ৷

এরপর ১২ মে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করে দলটির এবং এর সব অঙ্গসংগঠনের যাবতীয় কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করা হয়।  

এসকে/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।