ঢাকা, সোমবার, ৩০ আষাঢ় ১৪৩২, ১৪ জুলাই ২০২৫, ১৮ মহররম ১৪৪৭

অন্যান্য

উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ

গোলাম মাওলা রনি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮:৩৯, জুলাই ১৪, ২০২৫
উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ গোলাম মাওলা রনি

ইদানীং কবিতার প্রতি কেন জানি আমার বেজায় ঝোঁক বেড়েছে। চারদিকে যখন অশনিসংকেত ঠিক তখন বাস্তবতার চেয়ে কল্পনার মাঝে সুখ খুঁজে ফিরি।

মনের গহিনে যখন বিরান মরুভূমির মরীচিকা চিকচিক করে ঠিক তখনই কবিতার সাহায্যে মুহূর্তের মধ্যে বসরার গোলাপের বাগান সাজিয়ে নিই। কবির হৃদয় যে কতটা পবিত্র এবং তাদের চিন্তা সে মহাকালের মহাসংকটে ধ্রুবতারার মতো মানুষকে পথ দেখায় তার কিছু বাস্তব নমুনা আজ আপনাদের সামনে তুলে ধরব। আজকের শিরোনামে যে কাব্যগ্রন্থের নাম ব্যবহার করেছি তা কবি শামসুর রাহমানের লেখা।

আলোচনার শুরুতেই কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি লাইন আপনাদের শোনাই-কোথায় পাগলা ঘণ্টি বাজে ক্রমাগত, এলোমেলো পদধ্বনি সবখানে। হামলাকারীরা ট্রাম্পেট বাজিয়ে ঘোরে শহর ও গ্রামে এবং ক্রন্দনরত পুলিশের গলায় শুকায় বেল ফুল। দশদিকে কত রকাডেমিতে নিশিথে গোর খাদকেরা গর্ত খোঁড়ে অবিরত, মানুষের মুখগুলো অতি দ্রুত হয়ে যাচ্ছে শিপাঞ্জীর মুখ। কবি শামসুর রাহমান উল্লিখিত কবিতা লিখেছিলেন স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে অর্থাৎ শেখ মুজিবের জমানায়। অথচ কবিতার কথামালা বিবেচনা করলে মনে হয় হয়তো আজকের দিনটিকে বর্ণনা করার জন্য কবিতাটি রচিত হয়েছে। চলমান বাংলাদেশ বিশেষ করে ২০২৪ সালের আগস্ট মাসের ৫ তারিখের পর এই বাংলায় যা ঘটছে, তা যদি না দেখে মারা যেতাম, তবে মনে হতো বাস্তবতাবিবর্জিত এক অবোধ শিশু মারা গিয়েছে। ফলে নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে যা কিছু দেখছি কিংবা যা কিছু শিখছি তার জন্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকে ধন্যবাদ। গত এক বছরে মানুষের যে বিবর্তন সমাজের, যে পরিবর্তন এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের যে টলটলায়মান অবস্থা হয়েছে তা আমার মন মস্তিষ্কে কেউ জোর করেও ঢোকাতে পারত না যদি না আমার জীবনে ২০২৪ এবং ২০২৫ সাল না আসত।

গত এক বছরে কত মানুষ হঠাৎ করে কীভাবে যে ক্ষমতাধর হয়ে গেল তার হিসাব মেলাতে পারছি না। যারা দুবেলা খেতে পারতেন না, যাদের পরনে ভালো কোনো জামাকাপড় ছিল না এবং ক্ষুধা দারিদ্র্য এবং বেকারত্বের আতঙ্কে যারা মরে যাওয়ার কথা চিন্তা করতেন তারা রাজধানীর পাঁচতারকা হোটেলে গিয়ে ভোরে বিফের স্টিফ, স্যামন মাছের ফিশ অ্যান্ড চিপস এবং হাভানা চুরুটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলেন, দেশটা রসাতলে গেল। ঢাকায় এখনো প্যারিসের রিজ কার্লটনের মতো একটি হোটেল হলো না। হোটেলের রঙ্গমহলে গিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করেন আজকের তালিকায় বোম্বে থেকে কেউ এসেছে কি না।

গত এগারো মাসে কিছু মানুষের গলার আকৃতি জিরাফের চেয়েও বড় হয়ে গেছে। তাদের হুমকিধমকি, লম্ফঝম্ফ দেখলে অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়। তাদের নিষ্ঠুরতা দেখলে হায়েনার নির্মমতাকে নস্যি বলে মনে হয়।  এই বাংলার শকুন দাঁতাল শুয়োরেরা কোনো দিন মৃত প্রাণীর ওপর উল্লাসনৃত্য করেনি। বাংলার নিষ্ঠুর মানুষ পাথর যুগের আদলে পাথর দিয়ে মানুষ মেরে লাশের ওপর উল্লাসনৃত্য করেনি। ধর্ষকরা দল বেঁধে ধর্ষণের জন্য অভিযানে বের হয়নি-তারপর স্বামীকে বেঁধে পরিবারের সবাইকে জিম্মি করে মা-মেয়েকে একত্রে পালাক্রমে ধর্ষণের মহোৎসব করেনি। এই বাংলায় পুলিশকে মেরে মধ্যযুগীয় কায়দায় লাশ টাঙিয়ে রাখা হয়নি। রাষ্ট্রের অস্ত্র লুট করে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে খুন করার ঘটনা ঘটেনি। এই ভূখণ্ডে ধনী অভিজাত শিক্ষিত সজ্জনকে প্রকাশ্যে বিবস্ত্র করা হয়নি। পরের ধন হরণের চৌর্যবৃত্তি, ডাকাতি কিংবা রাহাজানি সব রেকর্ড ভঙ্গ করে বাড়ি দখল, মিলকারখানা, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় দখলের যে উৎসব দেখছি তা হজম করার জন্য প্রসিদ্ধ ছড়াকার আবু সালেহর ছড়া ছাড়া আমার আর কীই-বা উপায় আছে।

আবু সালেহ লিখেন- ‘ধরা যাবে না ছোঁয়া যাবে না, বলা যাবে না কথা, রক্ত দিয়ে পেলাম শালার এমন স্বাধীনতা! যার পিছনে জানটা দিলাম যার পিছনে রক্ত সেই রক্তের বদল দেখো বাঁচাই কেমন শক্ত। ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না, বলা যাবে না কথা রক্ত দিয়ে পেলাম শালার মরার স্বাধীনতা! বাঁচতে চেয়ে খুন হয়েছি বুলেট শুধু খেলাম উঠতে এবং বসতে ঠুকে দাদার পায়ে সেলাম। ধরা যাবে না ছোঁয়া যাবে না বলা যাবে না কথা, রক্ত দিয়ে পেলাম শালার আজব স্বাধীনতা। ’

আবু সালেহ আরও লিখেন-বাগিয়ে নিয়ে চেয়ারখানা জাত শুয়োরের ছা-বলছে আবার তাতেও নাকি প্রাণটা ভরে না। রক্ত খেলো মুণ্ড খেলো গিলল সবই পেটে-তাতেও নাকি পেট ভরে না যাচ্ছে জিভে চেটে। এমন ধরন রাক্ষুসীদের দেশটা দেখে ভাই হাতুড় শাবল তাক করেছি মারব জোরে ঘাই। কবিতা রেখে এবার বাস্তবজীবনে ফেরা যাক। নদীতে ইলিশ নেই। যা-ও দুই-চারটা পাওয়া যাচ্ছে দাম শুনলে মাথায় বজ্রপাত হয়। সারা দেশে টানা বৃষ্টি। উপকূলীয় অঞ্চলে হাহাকার। নদীনালা খাল, সমুদ্র পানিতে একাকার। ক্ষুধার্ত ও গৃহহীন মানুষ যখন কাঁদছে তখন চাঁদাবাজরা গদা হাতে হাঁকছে-ফন্দিবাজরা রাজপথ কাঁপিয়ে লন্ডন আমেরিকা দিল্লি পিন্ডি থেকে বিপদ-আপদ বালামুসিবত ডাকছে। সাধারণ মানুষ শুধু ভাবছে এবং জীবনের হিসাবের খাতার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে জীবনপঞ্জির বাঁকে বাঁকে খুঁজছে আর কী কী অবশিষ্ট আছে হারাবার। অভাবের তাড়না হতাশার দুর্বিপাক এবং দুর্ভিক্ষের আতঙ্ক মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। অন্যদিকে রাজাসনে বসে কর্তারা যা ভাবছে তা কবি শঙ্খ ঘোষ তাঁর সবিনয় নিবেদন কবিতায় বহু আগেই লিখে গেছেন। শঙ্খ ঘোষ বলেন, ‘আমি তো আমার শপথ রেখেছি অক্ষরে অক্ষরে। যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন দিয়েছি নরক করে। দাপিয়ে বেড়াবে আমার দল, অন্যে কবে না কথা, বজ্রকঠিন রাজ্য শাসনে সেটাই স্বাভাবিকতা। গুলির জন্য সমস্ত রাত, সমস্ত দিন খোলা বজ্রকঠিন রাজ্যে এটাই শান্তিশৃঙ্খলা। যে মরে মরুক অথবা জীবন কেটে যাক শোক করে আমি আজ জয়ী সবার জীবন দিয়েছি নরক করে। ’

শঙ্খ ঘোষের আরেকটি কবিতা দিয়ে আজকের নিবন্ধ শেষ করব। তবে তার আগে জাতি হিসেবে নিজেদের দুর্বলতা ও অক্ষমতার কিছু ফিরিস্তি দেওয়া আবশ্যক। আমরা মহাসর্বনাশ ঘটার আগে চিৎকার করতে পারি না। নিজের চোখের মধ্যে বিষাক্ত তির বিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত আমরা অন্যের দুঃখকষ্ট বেদনা দেখে আহ্লাদিত হই। মানুষ যখন সাহায্যের জন্য আর্তচিৎকার করে তখন নিজেদের শরীরকে সচল না করে আমরা আল্লাহ খোদা-ভগবান-ঈশ্বর-দেব-দেবীর ওপর সব দায়িত্ব আরোপ করে অনুভূতিহীন প্রাণী হয়ে যাই। কসাইখানার পশুগুলো জবাই হওয়ার আগেও যেমন নিজেদের মধ্যে গুতোগুতি করে তদ্রুপ আমরাও মহাবিপর্যয়ের সব আলামত দেখার পরও সামান্য প্রতিবাদ না করে নিজেদের অত্যাচারীর তলোয়ারের কাছে সঁপে দিই। আমাদের উল্লিখিত দুর্বলতা ও অক্ষমতার মূল কারণ আমাদের মেরুদণ্ডহীনতা এবং নিজেদের মূল্যায়ন না করতে পারার ব্যর্থতা। আমরা জেগে থেকে ঘুমের ভান করি এবং ঘুমন্ত অবস্থায় জেগে থাকার অভিনয় করি। আমার এই হালচালাক কবি শঙ্খ ঘোষ তাঁর হামাগুড়ি কবিতায় কীভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, তা নিচে তুলে ধরা হলো-
ঘুমটা ভেঙে গেলো হঠাৎ।
বাইরে কি ঝড় হচ্ছে?
দাপাদাপি করছে জানালার পাল্লাদুটো,
মাঝে মাঝে বিজলি ঝলকাচ্ছে।
ফের শুয়ে পড়তে গিয়ে সেই বিদ্যুতের ছটফটে আলোয় মনে
হলো ঘরের মধ্যে যেন হামা দিচ্ছে কেউ!
- কে ওখানে? কে?
হামা কোন শব্দই করে না।
উঠে আসি কাছে, আবারও জিজ্ঞাসা করি :
-কে আপনি কি চান?
সে তবু নিশ্চুপ থেকে এ কোণ ও কোণে ঘুরছে
মাথা তুলছে না কিছুতেই, চোখে চোখ নয়!
-কিছু কি খুঁজছেন আপনি?
শুনতে পাচ্ছি :
-‘খুঁজছি ঠিকই, খুঁজতে তো হবেই-
পেলেই বেরিয়ে যাবো, নিজে নিজে হেঁটে। ’
-‘কি খুঁজছেন?’
মিহি স্বরে বললেন তিনি:
-‘মেরুদণ্ডখানা। ’
সেই মুহূর্তে বিদ্যুৎ ঝলকালো ফের! চমকে  উঠ দেখি :
একা নয়, বহু বহু জন-
একই খোঁজে হামা দিচ্ছে এ-কোণে ও-কোণে ঘরজুড়ে।
               
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।