বাংলাদেশে এখন রাষ্ট্র সংস্কারের এক মহানাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে। দিনের পর দিন রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে বৈঠক হচ্ছে।
তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে এ নাটক নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র প্রতিক্রিয়া। সাধারণ মানুষ মনে করছে, জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করে দেশের সুশীল সমাজের একটি অংশ তাদের চিন্তা এবং মতামতগুলো জনগণের নামে সংবিধানে এবং রাষ্ট্রব্যবস্থায় চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এ রাষ্ট্র কেবল একটি মুষ্টিমেয় সুশীল গোষ্ঠীর নয়, জনগণের।
শুরুতে আমাদের জানা দরকার সুশীল সমাজ বলতে আমরা কী বুঝি? সুশীল সমাজ বা সিভিল সোসাইটি হলো একটি সমাজের সেই অগ্রসর জনগোষ্ঠী যারা সমাজ এবং জাতির বিবেক হিসেবে কাজ করেন। যারা জনগণকে পথ দেখান, জনগণকে আলোকিত করেন, রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থার বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। সুশীল সমাজ হলো রাষ্ট্রের ‘থিঙ্কট্যাঙ্ক’, যারা রাষ্ট্রকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্য মতামত দেন, গবেষণা ও লেখালেখি করেন। সুশীল সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তারা পক্ষপাতহীন, দলমতের উর্ধ্বে থেকে যে কোনো বিষয়ে মতামত দেবেন। সরকারের বিভিন্ন নীতি, আইন এবং কার্যক্রমকে তারা নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করবেন, ভুলত্রুটিগুলো ধরিয়ে দেবেন এবং সংশোধন করার জন্য সরকারকে পরামর্শ দেবেন। এ নিয়ে জনমত গঠন করেন। বিশ্বজুড়ে সুশীল সমাজ এভাবেই কাজ করেন। যেসব দেশে গণতন্ত্র বিকশিত হয়েছে, গণতন্ত্রের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেসব দেশগুলোতে সুশীল সমাজ গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। তাদের গুরুত্বপূর্ণ মতামতগুলো রাষ্ট্রচিন্তা এবং সরকার পরিচালনায় পাথেয় হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশের সুশীল সমাজের একটি অংশ যেন অন্য পথে হাঁটে। তাদের একটি নিজস্ব রাজনৈতিক এজেন্ডা রয়েছে। সেই এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য তারা সর্বক্ষণ চেষ্টায় থাকে। রাষ্ট্রক্ষমতায় তারা হিস্সা নিতে চায়, যেটি সুশীল সমাজের মৌলিক চরিত্রের বিপরীত। শুধু রাষ্ট্রক্ষমতার হিস্সা নয়, রাজনৈতিক দলগুলোকে তার নিষ্ক্রিয় এবং অকার্যকর করতে চায়। সুশীল সমাজ এবং রাজনৈতিক দল ও সরকারের সম্পর্ক হওয়া উচিত পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের। কিন্তু আমাদের দেশের এই সুশীল সমাজের একটি অংশ রাজনৈতিক দলগুলোকে মনে করে ‘অশিক্ষিত’। তারা কিছু বোঝে না। সুশীল সমাজই সমস্ত পাণ্ডিত্যের আধার।
বাংলাদেশের সুশীল সমাজ রাজনৈতিক দলগুলোকে পরিশুদ্ধ হতে বা রাজনৈতিক দলগুলোকে গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য পরামর্শ, তথ্য উপাদান এবং গবেষণা দিয়ে সমৃদ্ধ করতে চায় না। বরং তারা রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের সামনে হেয় প্রতিপন্ন করে, জনগণের কাছে রাজনৈতিক দলগুলোকে ছোট করে নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায়। সুশীল সমাজের এই অংশের কারণেই ২০০৭ সালে বাংলাদেশে বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া কার্যকর করার চেষ্টা করা হয়েছিল। এটি ছিল বাংলাদেশের সুশীল সমাজের একটি ‘ক্যু’। কিন্তু ২০০৭ সালের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর মইন উ আহমেদ এবং ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বে ওই সরকার কেবল ব্যর্থই হয়নি বরং সুশীল সমাজ সম্পর্কে জনগণের মধ্যে একটা নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করেছে। জনগণ বুঝতে পেরেছে সুশীলরা টেবিলটক, গোলটেবিল বৈঠক কিংবা টকশোতে যেভাবে কথা বলেন সেটা তারা বিশ্বাস করেন না। তারা যেটি বিশ্বাস করেন, সেটি তারা করেন না। ক্ষমতা পেলে সুশীলরা যে কতটা ভয়ংকর হয়ে ওঠেন তা ২০০৭ সালে এ দেশের মানুষ দেখেছে।
২০২৪-এ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে, বৈষম্য মুক্তির অভিপ্রায়ে এ দেশের ছাত্র-তরুণরা অকাতরে প্রাণ দিয়ে স্বৈরাচারের পচন ঘটায়। কিন্তু এই স্বৈরাচারের পতনের পর দেখা যাচ্ছে যে, যারা এ আন্দোলনের সম্মুখসারির যোদ্ধা, যারা বৈষম্যবিরোধী এক বাংলাদেশ স্বপ্নের জাল বুনে বাংলাদেশকে হিংস্র দানবের হাত থেকে মুক্ত করেছিল তারাই এখন সাইডলাইনে। রাষ্ট্রক্ষমতা পুরোটাই যেন সুশীল সমাজের একটি অংশ কুক্ষিগত করেছে। এখন যারা রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে কথা বলছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে, আগামী দিনের বাংলাদেশ কেমন হবে সে ব্যাপারে তাদের মতামত রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। তারা আসলে কারা? গত ১৫ বছরে তাদের ভূমিকা কী ছিল? তারা কি রাজপথে আন্দোলন করেছে? তারা কি জীবনের ঝুঁকি নিয়েছে? তারা কি নিগৃহীত হয়েছে? না, গত ১৫ বছর তারা ছিলেন নিরাপদে। কেউ বিদেশে, কেউ দেশে। দূর থেকে বাংলাদেশের তামাশা দেখেছেন, এখন তারা সবকিছুকে তাদের নিজেদের মতো করে সাজাতে চাইছেন। বাংলাদেশ যেন তাদের কাছে একটা গিনিপিগ, যাকে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হবে। এ দেশের জনগণের ভাগ্য নিয়ে তারা যেন এক্সপেরিমেন্ট করতে মরিয়া।
গত ১৩ জুন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস লন্ডন সফর করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। সেই সাক্ষাতে তারা একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছিলেন। যেখানে ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন করার আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছিল। এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়। এর ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গণতন্ত্র এবং নির্বাচনের সুবাতাস বইতে শুরু করেছিল। কিন্তু এরপর এর বাস্তবায়ন মাঠে হয়নি, বরং এরপর যখন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের লাগাতার ৯ দিনের বৈঠক হচ্ছে, তখন মনে হচ্ছে আমরা কোথায় যাচ্ছি? সুশীল সমাজ কী চাইছেন? তারা কেন তাদের মত জোর করে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চাপাতে চাইছেন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রধান কাজ কী হওয়া উচিত রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে তারা কিছু সংস্কার প্রস্তাব উপস্থাপন করবেন। যে সংস্কারের দাবিতে জনগণ, ছাত্র সমাজ দীর্ঘদিন আন্দোলন করেছে। যেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ইত্যাদি। এ সংস্কার প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের মতামত দেবে। যেসব বিষয়গুলোতে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবে তার ভিত্তিতে যৌথ সম্মতির একটি ঘোষণাপত্র তৈরি করা হবে। এ ঘোষণাপত্রের আলোকে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচনে যারাই ক্ষমতায় আসুক না কেন, যে দলই জয়ী হোক না কেন তারা এ যৌথ ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন করবেন। এ যৌথ ঘোষণাপত্রের বাইরেও যেসব আকাঙ্ক্ষা এবং দাবিদাওয়াগুলো থাকবে সেগুলোর নিয়ে সুশীল সমাজ অবিরতভাবে আলাপ-আলোচনা করবেন, সরকারের সঙ্গে দরকষাকষি করবেন, জনগণকে বোঝাবেন এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এ আকাঙ্ক্ষাগুলো সন্নিবেশিত করার জন্য তারা প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবেন। কিন্তু আমরা দেখছি যে ড. আলী রীয়াজের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোকে অনেক কিছু করতে বাধ্য করছে। যা নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। অনেক উন্নত গণতান্ত্রিক দেশেও এসব চর্চা শুরু হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলোকে বলা হচ্ছে এসবে সম্মত না হলে ‘জুলাই সনদ’ হবে না। তাহলে এ আলাপ-আলোচনার দরকার কী? বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ যথার্থই বলেছেন, যদি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যা যা চায় সেটাই বাস্তবায়ন করবে, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এ ধরনের বৈঠক করার দরকার কী? অনেকগুলো বিষয় আসলে খুবই টেকনিক্যাল এবং খুঁটিনাটি। এ বিষয়গুলো আসলে ধারণা সূচক। বাস্তবে প্রয়োগে এর কতটুকু লাভ বা ক্ষতি হবে তা নিয়ে বিশ্ব জুড়েই বিতর্ক আছে। যেমন প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস-বৃদ্ধি, সাংবিধানিক কমিশন ইত্যাদি। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস করা একটি তাত্ত্বিক ধারণা। পৃথিবীতে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস করে কোন দেশে গণতন্ত্র সুসংহত বা কোন দেশে গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে এ নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হতে পারে। এটি কোনো পরীক্ষিত ফর্মুলা নয়। রাষ্ট্র ব্যবস্থা, গণতন্ত্র ইত্যাদি কোনোটাই ল্যাবরেটরিতে তৈরি ফর্মুলা না, যে ফর্মুলা প্রয়োগ ঘটালেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। গণতন্ত্র জবাবদিহিতা, সুশাসন এগুলো হলো অব্যাহত চর্চার বিষয়, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো জনগণকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করবে। সুশীল সমাজ একটি থিঙ্কট্যাংক হিসেবে সরকারের জবাবদিহিতার জন্য ক্রমাগতভাবে জাতির বিবেকের ভূমিকা পালন করবে। এ দুটির যখন সমন্বয় হবে, এর সঙ্গে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে, তখন গণতন্ত্রের বিকাশের ধারাটা সুবিন্যস্ত হবে। কিন্তু আমরা লক্ষ করছি সুশীল সমাজের কয়েকজন প্রতিনিধি সংস্কারের নামে যেন একটি ছক তৈরি করেছেন। যেই ছকটির বাইরে গিয়ে কেউ কিছু করলেই সেটি তারা মানতে রাজি হচ্ছেন না। তারা এমন একটি ব্যবস্থা চাইছেন যে ব্যবস্থাটা তারা তাত্ত্বিকভাবে চিন্তা করেন, কিন্তু এই তাত্ত্বিক ব্যবস্থাপনার প্রয়োগ সফল হবে, না ব্যর্থ হবে সেটি তারা কি নিশ্চিতভাবে বলতে পারবেন? সুশীলরা যেসব সংস্কারের জন্য চাপ দিচ্ছে, যেমন ধরা যাক দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদে উচ্চকক্ষে কীভাবে নির্বাচন হবে- আমাদের দেশে তো নয়, বিশ্বে কোথাও এর কোনো রেডিমেড ফর্মুলা নেই। কিন্তু আমাদের সুশীল সমাজ এখন একটি ফর্মুলা চাপিয়ে দিতে চাইছেন। এটা গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত।
সংস্কার একটি চিরন্তন পরিবর্তনশীল ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এটি অব্যাহত চর্চার বিষয়। আর সে কারণেই রাজনৈতিক দলগুলোকেই সংস্কারের দায়িত্বটি ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু তা না করে সুশীল সমাজ যখন সংস্কার কমিশনের নামে তাদের নিজস্ব মতামতগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছে, তখন রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব এবং অধিকার খর্ব হচ্ছে।
আমাদের সুশীল সমাজ এখন যে ভূমিকা পালন করছেন, তাতে মনে হচ্ছে যে সুশীল সমাজের ভূমিকা, তাদের কাজের পরিধি নিয়েই তাদের আগে সম্যক জ্ঞান দেওয়া দরকার। এজন্য আগে দরকার সুশীল সমাজের সংস্কার। সুশীল সমাজকে যদি সংস্কার না করা হয় তাহলে বারবার তারা রাজনীতির মধ্যে প্রবেশ করবেন, রাজনীতির জল ঘোলা করবেন। তাদের রাজনৈতিক অভিপ্রায় বাস্তবায়ন করার জন্য রাজনৈতিক বিভক্তি এবং বিশৃঙ্খলা তৈরি করার চেষ্টা করবেন। ফলে গণতন্ত্র কখনোই শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে না। এখন দেখা যাচ্ছে সুশীল সমাজ রাজনৈতিক দলগুলোকে নানা বিষয়ে বিভক্ত করার চেষ্টা করছেন। এ বিভক্তি গণতন্ত্রের যাত্রাপথকে ব্যাহত করছে। ঐক্যের বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে গেলে প্রত্যেককে তার দায়িত্ব পালন করতে হবে। কেউ যেন কারও সীমা অতিক্রম না করে সেটি লক্ষ রাখতে হবে। আমাদের সবকিছু যখন সংস্কার হচ্ছে, তখন সুশীল সমাজের সংস্কার হোক না! ক্ষতি কী?
সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন