যশোর: অব্যাহত বর্ষণে যশোরের ভবদহ এলাকার দেড় শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ জলাবদ্ধতার কবলে পড়েছে।
এরূপ পরিস্তিতিতে ভবদহ স্লুইজ গেটের ২১ ভেন্টের সব খুলে দেওয়া, আমডাঙা খালের দ্রুত জমি অধিগ্রহণ ও সংস্কার কাজ শুরু, ৮১ কিলোমিটার নদী খননের পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন ও ঘের নীতিমালা কার্যকর দাবি জানিয়েছেন ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ।
বৃহস্পতিবার (০৪ সেপ্টেম্বর) দুপুরে যশোর শহরের ভোলা ট্যাংক রোডে সংগঠনের অস্থায়ী কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি জানান নেতারা।
সংবাদ সম্মেলনে সংগ্রাম কমিটির সদস্য সচিব চৈতন্য কুমার পাল বলেন, চলতি বছর বৃষ্টিপাতের পরিমাণ গতবারের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি হলেও এবার ভবদহ এলাকায় জলাবদ্ধতার মাত্রা একটু কম।
গত বছর বৃষ্টিপাত হয়েছিল ৫১৮ মিমি। এবার বৃষ্টিপাত হয়েছে (২৮ আগস্ট পর্যন্ত) ১০৭৮ মিমি, যা দ্বিগুণেরও বেশি।
গতবারের তুলনায় এবার জলবদ্ধতার মাত্রা কমের প্রধান কারণ ভবদহের আটটি স্লুইজ গেট খুলে দেওয়ায় ব্যাপক হারে পানি নেমেছে। যদি সব গেট এই মুহূর্তে খুলে দেওয়া যায় তাহলে জলাবদ্ধতা নিরসনে ‘ম্যাজিক চেঞ্জ’ অর্থাৎ বিষ্ময়কর পরিবর্তন ঘটবে এবং সপ্তাহের মধ্যেই পানি নিষ্কাশিত হয়ে যাবে।
এক্ষেত্রে একটি বাধা রয়েছে দাবি করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, টেকা ঘাটে এলজিইডির ডাইভার্সন রোডের সংকীর্ণ পানি বেরোবার পথ। এখনই এই বাধা অপসারণ করা জরুরি। তাহলে দ্রুতই ১৫০ গ্রামের বাড়ি-ঘর, আবাদ-ফসল, স্কুল-কলেজ জলাবদ্ধতা মুক্ত হবে, যন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাবে আড়াই লাখ মানুষ।
নেতৃবৃন্দ বলেন, ২০১২ সাল থেকে সকল গেট বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল পানি উন্নয়ন বোর্ড, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, তৎকালীন সরকারের প্রতিমন্ত্রীসহ স্বার্থবাদী মহলের ষড়যন্ত্রে। এলফলে ভবদহ স্লুইজ গেট থেকে বারোআউড়িয়া মোহনা পর্যন্ত প্রায় ৬০ কিমি নদী হত্যা করা হয়।
সরকারি অর্থ লুটপাটর স্বর্গরাজ্য তৈরি করে এবং সমগ্র এলাকা স্থায়ী জলাবদ্ধতার কারণে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়েছে। ইতিপূর্বেও স্লুইজ গেট বন্ধ করে অনুরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টিকার হয়।
এবারের টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার কবলে পড়েছে যশোরের দুঃখ, ভবদহ অঞ্চল। প্লাবিত হয়েছে অভয়নগর, মণিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলার দেড় শতাধিক গ্রাম। উঠানে হাঁটু পানি, টিউবওয়েল তলিয়ে যাওয়া, বাঁশের সাঁকো আর রাস্তার ধারে টং বানিয়ে পশু-পাখির সঙ্গে মানুষের থাকাই এখন বাস্তবতা। দুর্বিষহ দিন কাটছে এই অঞ্চলের আড়াই লাখেরও বেশি মানুষের।
অভয়নগর উপজেলার সুন্দলী গ্রামের কানু বিশ^াস বলেন, প্রায় দুই মাস ধরে এলাকার বেশিরভাগ মানুষের বাড়িতে হাঁটু পর্যন্ত পানি। বাঁশের সাঁকোই পার হতে হচ্ছে। পানিয়জলের জন্যে থাকা টিউবওয়েলও পানির নিচে।
মশিয়াহাটী গ্রামের প্রিয়ব্রত দাস বলেন, ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমরা জলাবদ্ধতার শিকার। বর্ষা এলেই ঘর-বাড়ি, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল নিয়ে পানিতে থাকি। ভবদহের যত নিচের দিকে যাবেন, ততই জলাবদ্ধতা বেশি। মানুষ অসহায়ভাবে জীবনযাপন করছে। স্থায়ী সমাধানের জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ দরকার।
কেশবপুর উপজেলার মঙ্গলকোট বসুন্টিয়া গ্রামের পরেশ দেবনাথ, মনোহরনগর এলাকার আব্দুল গফ্ফার বলেন, ভবদহ এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ রাস্তার ধারে টং বানিয়ে গরু-ছাগল নিয়ে থাকছেন। এদিকে, ২৭ বিলে পানির কারণে চাষাবাদও বন্ধ। মানুষের বিকল্প অর্থ উপার্জনের ব্যবস্থা না থাকায় অনেক কষ্টে দিন পার করতে হচ্ছে।
এদিকে, ভবদহ অঞ্চলের বাসিন্দা ও ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির সদস্য সচিব চৈতন্য কুমার পাল বলেন, অব্যাহত বর্ষণে ভবদহ এলাকার দেড় শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এই তিন উপজেলার ১৪২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি উঠেছে।
এরমধ্যে ৯৩টি প্রাইমারি স্কুল, ৪২টি হাই স্কুল আর বাদবাকি কলেজ ও মাদ্রাসা। সামনে শীত, সেইসময় আরো কষ্টের মধ্যে পড়বে এই অঞ্চলের মানুষ। ইতিমধ্যে শরীরে চুলকানি, ঘা-পাঁচড়া, পেটের পীড়া, সর্দি-জ¦র ইত্যাদি রোগে ভুগছে মানুষ, বিশেষ করে শিশু ও বয়স্করা।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা ইকবার কবির জাহিদ বলেন, ভবদহ জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধানে আমাদের প্রদান দাবিগুলোর আংশিক মেনে নিয়েছে সরকার। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় কাজ খুবই ধীরগতিতে।
তিনি বলেন, আমরা জলাবদ্ধতা নিরসনে আমডাঙা খাল প্রশস্তকরণে জমি অধিগ্রহণের কাজ দ্রুত করার দাবি জানাচ্ছি। ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা দ্রুত করে খাল সংস্কার করা হলে জলাবদ্ধতা নিরসনে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ৮১ কিলোমিটার নদী খননের কাজ এখনো শুরু হয়নি। এ মাসের মধ্যে কাজ শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ নিতে হবে।
টিআরএম (জোয়ারাধার) বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে আরও গতিশীল ও ঘের সংক্রান্ত নীতিমালা কার্যকর করার দাবিতে মাসব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় সংবাদ সম্মেলন থেকে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে হাট মিটিং, গ্রাম মিটিং ও সভা-সমাবেশ।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যন্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন উপদেষ্টা তসলিম-উর-রহমান, সদস্য নাজিম উদ্দিন, শিবপদ বিশ্বাস, শেখর বিশ্বাস, অনিল বিশ্বাস, সাধন বিশ্বাস, রাজু আহম্মেদ, আলমগীর হোসেন এবং বিশ্বজিৎ বিশ্বাস।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী বলেন, ভবদহ স্লুইজ গেটের ৮টি কপাট খুলে দেওয়া হয়েছে, কাল নাগাদ আরো দুইটি খুলে দেওয়া হবে। প্রতিদিনই পানি কমছে। গত ২৪ গণ্টায় পানি প্রায় ২০ মিমি কমেছে বলে তিনি জানান।
তিনি আরো বলেন, জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কয়েকটি নদী খননের কাজ বাস্তবায়ন করবে। আগামী সপ্তাহে তাদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর হলে দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হবে। একই সঙ্গে আরও কয়েকটি খাল খননের কাজও শুরু হবে।
এসএইচ