ত্রিশ পাড়া কোরআনের হাফেজ আমাদের ছেলে শহীদ আজিজুল ইসলাম। তার লাশ তুললে তিনটা কবর খুঁড়তে হবে।
জুলাই আন্দোলনে শহীদ আজিজুল ইসলামের বাবা আব্দুর রহিম ও মা রেজিয়া বেগম এ আকুতি জানান। তাদের বাড়ি লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার শ্রীরামপুর ইউনিয়নের ঝালঙ্গী গ্রামে। জুলাই শহীদ ছেলের লাশ না তুলতে কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আবেদনও করেছেন তারা।
শহীদ আজিজুলের পরিবার ও স্থানীয়রা জানান, আজিজুল ইসলাম বরিশালের চরমোনাই মাদরাসা থেকে ত্রিশ পাড়া কোরআনের হাফেজ হয়ে ফিরে আসে। পরে স্থানীয় আউলিয়ার হাট আলিম মাদরাসায় ভর্তি হয়। গেল দাখিল পরীক্ষায় তার অংশ নেওয়ার কথা ছিল। এরই মাঝে দেশে জুলাই আন্দোলন শুরু হলে বাড়িতে ফাঁকি দিয়ে আন্দোলনে যাইত আজিজুল ইসলাম। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বিকেলে বিজয় মিছিল বের হলে সবার সঙ্গে কাউয়ামারী বাজারে বিজয় মিছিলে অংশ নেয় আজিজুল। সেখানে মোশারফ হোসেন প্রধান কলেজের মুল ফটকের ডিজিটাল সাইনবোর্ড খুলে ফেলছিল আজিজুল ইসলাম। দুর্ভাগ্যবশত সেখানে বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলে তার মৃত্যু হয়।
পরদিন তাকে পারিবারিক কবর স্থানে দাফন করা হয়। জুলাই আন্দোলনের বিজয় মিছিলে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলেও আজিজুল ইসলাম শহীদ হিসেবে গেজেট ভুক্ত হয়েছে। এরপর চলতি বছরের ৩০ জুন ঘটনার প্রায় ১০ মাস পরে পাটগ্রাম থানায় আজিজুল হত্যা মামলা দায়ের করেন পার্শ্ববর্তী উপজেলার সিংগিমারী এলাকার আব্দুস সালামের ছেলে মোশারফ হোসেন। অপরিচিত ব্যক্তির দায়ের করা হত্যা মামলার খবর শুনে আটদিন পরেই তা প্রত্যাহার করতে স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশ মহাপরিদর্শকসহ ঊর্ধ্বতন বিভিন্ন মহলে আবেদন করেন শহীদ আজিজুলের বাবা আব্দুর রহিম।
সেই মামলায় শহীদ আজিজুলের লাশ কবর থেকে তুলে ময়নাতদন্তের অনুমতি চেয়ে আদালতে আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই শাহাজাহান আলী। এটা শুনে দ্বিতীয়বার শোকের সাগরে পড়েন শহীদ পরিবারসহ পুরো এলাকাবাসী। তাদের দাবি কোরআনের হাফেজের লাশ এক বছর পরে কবর থেকে তুলতে দেওয়া হবে না। শহীদ আজিজুলের লাশ কবর থেকে না তুলতে আদালতসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত আবেদন করেন শহীদ আজিজুলের বাবা আব্দুর রহিম।
শহীদ আজিজুলের দাদি রুপজান বেওয়া বলেন, আমার নাতির রক্তে দেশ স্বাধিন হয়েছে। স্বাধিন দেশে নিরাপরাধ মানুষকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে হয়রানি করলে শহীদের আত্মা কষ্ট পাবে। আমার নাতি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছে। আমাদের কারও প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। এখন নাতির লাশ তুললে আমি বাঁচব না।
আব্দুর রহিম বলেন, আমার ছেলে শহীদ আজিজুল ইসলাম কোরআনের একজন হাফেজ। সে জুলাই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল এবং বিজয় মিছিলে গিয়ে কলেজের সাইনবোর্ড ভাঙতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যায়। আমরা তাকে দাফন করেছি। রাস্ট্র তাকে শহীদের মর্যাদা দিয়ে গেজেট প্রকাশ করেছে। তার মৃত্যু নিছক দুর্ঘটনা মাত্র। কারও প্রতি কোনো ক্ষোভ বা অভিযোগ ছিল না এবং নেই। মৃত্যুর ১০ মাস পরে বর্তমান ওসি মিজানুর রহমান আমাদের মামলা করার চাপ দিয়েছিল। আমরা মামলা করিনি। পরে মোশারফ নামে অপরিচিত একজন বাদী হয়ে মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে। শহীদের বাবা ও একজন সাক্ষী হিসেবে সে মামলা প্রত্যাহার করতে আবেদন করেছি। মিথ্যা মামলায় মানুষকে হয়রানি করলে আমার হাফেজ ছেলের কবরে আজাব হবে, আমরা তা চাই না।
আজিজুলের মা রেজিয়া বেগম বলেন, আমার কলিজা আজিজুল ত্রিশপাড়া কোরআন মুখস্থ করেছে। তার লাশ কবর থেকে তুলতে দেব না। কেউ জোর করে তুললে তিনটা কবর খুড়তে হবে। একটা ছেলের অপর দুইটাতে আমরা স্বামী-স্ত্রী থাকব। এক বছর পর কোরআনের হাফেজের লাশ দেখলে আমরা মরে যাবো। আমরা মামলা চাই না। আমার ছেলের লাশকে পুঁজি করে কেউ কেউ মামলা বাণিজ্য করছে। আমরা বেঁচে থাকতে তা হতে দেব না। ওসি বার বার ডেকেছিল মামলা করতে আমরা বলেছি, ছেলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে দুর্ঘটনায় মারা গেছে। আমরা মামলা করব না। অপরিচিতদের দিয়ে মামলা করেছে পুলিশ।
এ মামলার বাদী মোশারফ হোসেন বলেন, শহীদ আজিজুল আমার সহযোদ্ধা ছিলেন। তার পরিবার মামলা করতে সাহস করেনি এবং তাদের নির্দেশে আমি বাদী হয়ে মামলা করেছি। তবে মামলা বাণিজ্যের প্রমাণ দিতে পারলে সব শাস্তি মেনে নেব। বাণিজ্যের অভিযোগটি ভিত্তিহীন।
গত বছর ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে গিয়ে পাটগ্রামের দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। একজন শহীদ আজিজুল ইসলাম (১৯) অপরজন শহীদ নুরুজ্জামান (৪৫)। তাদের বাড়িও পাশাপাশি এলাকায়। নুরুজ্জামান আউলিয়ারহাট এলাকায় বিজয় মিছিলে গিয়ে হোঁচোট খেয়ে সড়কে পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হন। পরে পাটগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ৬ আগস্ট রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে ৮ আগস্ট চিকিৎসাধিন অবস্থায় মারা যান। নুরুজ্জামানের মৃত্যুর ঘটনায়ও ১০ মাস পরে চলতি বছরের ৩০ জুন পাটগ্রাম থানায় ৪১ জনের নামসহ অজ্ঞাত ৫০/৬০ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহতের পরিবারের অপরিচিত আলী হোসেন। যিনি মামলার ৮ দিনপর তা প্রত্যাহারের আবেদন করেন।
জুলাই আন্দোলনের ঘটনায় পাটগ্রাম থানায় চলতি বছরের ৩০ জুন দায়ের করা দুই মামলায় (২১ ও ২২ নং) বিএনপিরও ৫/৭ জন নেতাকে আসামি করা হয়েছে। মামলা দুইটি প্রত্যাহার করতে বাদী ও দুই শহীদ পরিবার একই দিনে পৃথক পৃথক প্রত্যাহারেরও আবেদন করেছেন। যা নিয়ে তৈরি হয়েছে ধূম্রজাল। মামলায় গ্রেপ্তার এড়াতে বিএনপি নেতারাও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। মামলা দুইটিতে ব্যাপক বাণিজ্য হয়েছে বলেও দাবি বাদী ও নিহতের পরিবারের।
নুরুজ্জামান হত্যা মামলায় ২৭ থেকে ৩১ নম্বর আসামির তালিকায় শ্রীরামপুর ইউনিয়ন ছাত্রদল, কৃষকদল, স্বেচ্ছাসেবক দলের পদধারী নেতাদের নাম দেওয়া হয়েছে। রয়েছেন ইউনিয়ন ছাত্রদলের সম্পাদক, কৃষকদলের সহ সভাপতি, স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব ও যুগ্ন আহ্বায়ক।
নুরুজ্জামান হত্যা মামলার ২৭ নম্বর আসামি শ্রীরামপুর ইউনিয়ন কৃষকদলের সহ সভাপতি হিটলার বলেন, জুলাই আন্দোলন করেছি এখন সেই আন্দোলনের হত্যা মামলার আসামিও হলাম আমরা পাঁচজন। আমার ছেলে, শ্যালক, চাচাত ভাই, বন্ধুর ছেলে সবাই বিএনপির সহযোগী সংগঠনের নেতা। দলীয় কোন্দল থেকে আমাদের আসামি করা হয়েছে। যা দলীয় উচ্চ পর্যায়ে বলা হয়েছে।
নুরুজ্জামানের স্ত্রী সুফিয়া বলেন, আমার স্বামী মিছিলে গিয়ে আহত হয়ে পরে চিকিৎসাধিন অবস্থায় মারা যান। আমরা মামলা করিনি। মামলার বাদীকে চিনি না, তাকে মামলা করতে বলিওনি। আমার স্বামীর লাশ না তুলতে আদালতে আমি আবেদন করেছি। শহীদ স্বামীর লাশ তুললে আমি বাঁচব না।
শহীদ নুরুজ্জামান হত্যা মামলার বাদী আলী হোসেন বলেন, জুলাই আন্দোলনের সময় আমি ঢাকায় ছিলাম। পরবর্তীতে চলতি বছরের জুন মাসে ভাইদের সঙ্গে জমি নিয়ে বিরোধের কারণে গ্রামে আসি। ৩০ জুন ভাইদের বিরুদ্ধে জমি নিয়ে মামলা দিতে পাটগ্রাম থানায় গেলে ফক্কর আলী নামে একজন ওসি স্যারের রুমে নিয়ে যান। তখন ওসি স্যার মামলা নেবেন বলে জানান। এরপর ফক্কর আলী ও একজন পুলিশ একটা কাগজ লিখে এনে আমাকে স্বাক্ষর করতে বললে আমি তা পড়ে দেখতে চাই। কিন্তু ওসি স্যার তা পড়তে দেননি। ওসি স্যার বলেন, আপনার মামলা স্বাক্ষর করেন। কি লেখা আছে তা স্বাক্ষরের পরে দেখতে পাবেন। আমি স্বাক্ষর করার পর স্যার (ওসি) কাগজটা রেখে দেন।
এর তিন দিন পর বিএনপির তিনজন লোক বাড়ি এসে বলেন, "আমি কেন তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেছি। তখন আমি বুঝতে পারি ওসি স্যার ভাইদের বিরুদ্ধে মামলা না নিয়ে নুরুজ্জামান হত্যা মামলার বাদী আমাকে বানিয়েছে। এখন জীবনের ভয়ে আমিও পালিয়ে বেড়াচ্ছি। মামলার আটদিন পর তা প্রত্যাহার করতে বিভিন্ন মহলে আবেদনও করেছি। আমি শহীদ নুরুজ্জামানের কেউ না, তাকে চিনিও না। ঘটনাও জানি না, আসামিদেরও চিনি না। মিথ্যা মামলায় আমাকে কৌশলে বাদী করা হয়েছে বলেও দাবি করেন বাদি আলী হোসেন।
জুলাই আন্দোলনের পাটগ্রাম উপজেলা সমন্বয়ক ও এনসিপি'র যুগ্ম সমন্বয়কারী কবির আহমেদ রাব্বী বলেন, ৫ আগস্ট পাটগ্রামে আন্দোলন হয়নি, বিজয় মিছিল হয়েছিল। সেখানে পৃথক দুর্ঘটনায় দুইজন শহীদ হয়েছেন। এ ঘটনায় নিহতের পরিবার কোনো মামলা করেনি। বাণিজ্য করতে অপরিচিতদের দিয়ে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর তীব্র প্রতিবাদসহ নিন্দা জানিয়ে মামলাটি সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেন তিনি।
দুই হত্যা মামলায় চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে দাবি করে পাটগ্রাম থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমান বলেন, কাউকে জোর করে মামলা নেওয়া হয়নি। বাদীরা স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে লিখিত দেওয়ায় মামলা নেওয়া হয়েছে। তারা হয়তো কোনো ভয়ে মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করতে পারে।
আরএ