সিলেট: ভাঙা ঘরের সামনে পড়ে থাকা ইটে শেওলা ধরেছে। ইটগুলো দিয়ে বাবা-মায়ের জন্য ঘর তৈরি করতে চেয়েছিলেন সুহেল আহমদ (২১)।
গত বছরের ২০ জুলাই বিকেলে ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ উপজেলার সিমরাইল ‘প্রিয়ম নিবাসে’ আগুন দেওয়া হয়। সেখানে কাজ শেষে বিশ্রামে ছিলেন সুহেল আহমদসহ ১৪ শ্রমিক। তাদের মধ্যে ১১ জন বের হতে পারলেও জীবন্ত দগ্ধ হন সুহেলসহ তিনজন।
সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার ছারখাই ইউনিয়নের কাকুরা গ্রামের বাসিন্দা তখলিছুর রহমান ও পারভিন বেগম দম্পতির ছেলে সুহেল আহমদ (২১)।
সাত ভাইবোনের মধ্যে সুহেল ছিলেন সবার বড়। তার ছোট বোন ফরিদার বিয়ে হয়েছে কিছুদিন আগে। আরও দুই বোন-আবিদা নবম শ্রেণিতে ও মুনতাহা দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়েন। তিন ভাইয়ের মধ্যে রুহেল আহমদ বয়সে কিশোর।
সুহেল আহমদের মৃত্যুতে থেমে যায় পরিবারটির স্বপ্ন। বাড়ির ভাঙা ঘরের সামনে সুহেলের কেনা ইটের স্তূপ স্মৃতি হিসেবে রয়ে গেছে। আগুনে পুড়ে অঙ্গার ছেলেকে শেষবারের মতো দেখতে না পারার আক্ষেপে কাতর তার বাবা-মা।
সুহেলের মৃত্যুর সংবাদ পরিবার জানতে পারে দুই দিন পর। এমন খবরে শোকের মাতম চলে দরিদ্র পরিবারটিতে।
সুহেলের বাবা-মা বলেন, ‘আমাদের জন্য একটা নতুন ঘর বানানোর স্বপ্ন ছিল আমার বাছাধনের। সেই জন্য আয়-রোজগারের টাকা দিয়ে কিছু ইট কিনে রেখেছিল। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। এখন ইটগুলো দেখলেই ছেলের কথা মনে পড়ে, বুকটা ফেটে যায়। আগুনে পুড়ে আমার ছেলের মুখটাও শেষবারের মতো দেখতে পারলাম না। ’
ছেলের কথা বলতে গিয়ে সুহেলের মা পারভিন বেগম বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। চোখে অশ্রু আর বুকভরা কষ্ট নিয়ে ছেলেকে শেষবারের মতো দেখতে না পারার আক্ষেপ পোড়ায় তাকে।
ছেলের জন্য বিলাপ করে তিনি বলেন, ‘ওরা আমার সন্তানরে এমনভাবে পুড়িয়ে মারলো, আমার আদরের ছেলের মুখটাও শেষবারের মতো দেখতে পারলাম না। ’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার ছেলে শহীদ সুহেলের আয়ে সংসার চলতো। তার মৃত্যুর পর এখন আমরা বড়ই অভাবে আছি। ’
সুহেলের অনেক স্বপ্নের কথা উল্লেখ করে পারভিন বেগম আরও বলেন, ‘আমাদের জন্য একটা ঘর বানানোর জন্য ইটও কিনে রেখেছিল। বলেছিল, আম্মা, তোমাদের আর ভাঙা ঘরে থাকতে হবে না। কয়টা দিন ধৈর্য ধরো, আমি তোমাদের নতুন ঘরে তুলব।
সাত ভাইবোনের মধ্যে সুহেল ছিলেন সবার বড়। তার ছোট বোন ফরিদার বিয়ে হয়েছে কিছুদিন আগে। আরও দুই বোন আবিদা নবম শ্রেণিতে ও মুনতাহা দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়েন। অন্য দুই ভাইয়ের মধ্যে জুয়েল মাদ্রাসায় সপ্তম শ্রেণিতে ও তুহেল চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী।
সুহেলের ছোট ভাই রুহেল আহমদ বলেন, ‘আমার বাবা অসুস্থ। ১০ বছর আগে পায়ে গ্যাংরিন আক্রান্ত হলে পায়ের রগ কেটে ফেলা হয়। এরপর থেকে তিনি কোনো কাজ করতে পারেন না। পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলেন বড় ভাই সুহেল। তার মৃত্যুর পর এখন আমরা অনেক বেশি আর্থিক চাপে পড়েছি। সংসার চালানোর পাশাপাশি ভাইবোনদের পড়ালেখার খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এছাড়াও অসুস্থ বাবা-মায়ের চিকিৎসার খরচ তো আছেই। ’
সুহেলের বন্ধু ও কাকুরা গ্রামের বাসিন্দা হামিদ বলেন, ‘আমরা ১৪ জন ব্যাংকের রেনোভেশনের কাজ করতাম। ২০ জুলাই শনিবার বিকেল ৪টা থেকে ৫টার দিকে প্রতিদিনের মতো দুপুরের খাবার খেয়ে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের দ্বিতীয় তলায় শুয়ে পড়ি। হঠাৎ ভবনের মানুষের চিৎকারে ঘুম ভাঙে। চোখ খুলে দেখি চারদিক কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। প্রাণ বাঁচাতে আমি ও আরও দুজন কর্মী তিনতলা থেকে লাফ দিই। আমাদের দুজনের পা ভেঙে যায়। বাকিরা ওপরের তলা দিয়ে অন্য ভবনের ছাদে উঠে পালিয়ে যায়। কিন্তু কুষ্টিয়ার দুজন ও বন্ধু সুহেল পালাতে পারেনি। আগুনে পুড়ে তারা তিনজনই মারা যায়। ’
সুহেলের স্মৃতিচারণ করে বন্ধু হামিদ আরও বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমি আর সুহেল একসঙ্গে বড় হয়েছি। গ্রামের বাড়িতে গেলে দুজন একসঙ্গেই ঘুরে বেড়াতাম। মারা যাওয়ার আগের রাতেও সুহেলের সঙ্গে অনেক কথা হয়। বন্যার কারণে টানা ৬ মাস কোনো কাজ করতে পারেনি সে। কয়েকদিন আগে ঋণ করে ছোট বোনের বিয়েও দিয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে খুব আর্থিক চাপে ছিল। মৃত্যুর ২০ দিন আগে আমার সঙ্গেই নারায়ণগঞ্জে কাজে যোগ দেয়। মা-বাবার জন্য একটি ঘর বানাতে চেয়েছিল। এ জন্য কিছু ইটও কিনে রেখেছিল। কিন্তু আগুনে পুড়ে তার সব শেষ হয়ে গেছে। ’
জানা গেছে, জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকা ও সরকার থেকে সঞ্চয়পত্রের ১০ লাখ টাকা পেয়েছে সুহেলের পরিবার। এছাড়া জেলা পরিষদ থেকেও আরও ২ লাখ টাকা অনুদান পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা।
এনইউ/এসআইএস