জার্মানিতে গত ৮ মাসে ৩ জন বাংলাদেশি তরুণ আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। কয়েক মাস অন্তর বাংলাদেশের তিনজন তরুণের আত্মহত্যা দেশটির বাংলাদেশি কমিউনিটিতে তোলপাড়, সমালোচনা ও প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে।
প্রবাসী সংগঠনগুলো খুঁজছে আত্মহত্যার কারণ ও তা প্রতিরোধের কার্যকর উপায়।
জার্মানির প্রবাসী সংগঠনগুলোর দেওয়া তথ্যমতে, জার্মানিতে ২০২৫ সালের মার্চে আত্মহত্যা করেন সুলতান মারুফ আহমেদ নামের এক তরুণ। দেশটির ডর্মস্টাড বিশ্ববিদ্যালয়ের এ শিক্ষার্থীর সিলেট থেকে জার্মানিতে পড়তে এসেছিলেন। তার আত্মহত্যার স্পষ্ট কারণ না জানা গেলেও বিভিন্ন সূত্র অর্থনৈতিক ও পারিবারিক চাপকেই এ মৃত্যুর জন্য দায়ী করেছে।
বার্লিনে বসবাসকারী ইফতেখার হোসেন মিয়া এ বছরের ৬ জুন আত্মহত্যা করেন। তার মৃত্যুর স্পষ্ট কারণও অজানা।
নিহতের সহপাঠী ও প্রতিবেশী বাংলাদেশিরা জানান, পারিবারিক ও অর্থনৈতিক চাপই তাকেই আত্মহত্যায় প্ররোচিত করতে পারে। সর্বশেষ আত্মহত্যা করেন ফেনীর নুরুসসাফা তামিম। ৬ জুলাই তার লাশ উদ্ধার করা হয়। তার মৃত্যুর কারণ সম্পর্কেও নাম প্রকাশ না করার শর্তে তার সহপাঠীরা জানান, অর্থনৈতিক চাপেই সম্ভবত আত্মহত্যা করেছেন তামিম।
পরপর তিনটি আত্মহত্যার ঘটনা জার্মানিতে বসবাসরত শিক্ষার্থী ও পরিবারগুলোর মধ্যেও নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করছে। কমিউনিটি সংগঠনগুলোও এর কারণ বিশ্লেষণের চেষ্টা করছে। সঙ্গে এ ঘটনা প্রতিরোধের জন্য নানা পরিকল্পনাও হাতে নিচ্ছেন।
নর্থ রাইন ওয়েস্টফেলিয়া অঙ্গরাজ্যের কমিউনিটি সংগঠক ড. শাফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, সত্যি কথা বলতে বাংলাদেশ থেকে শিক্ষার্থীদের জার্মানিতে আসতে দুই বছরের বেশি সময় শুধু ভিসার জন্যই অপেক্ষা করতে হয়। এ সময় তারা অন্য কোনো কর্মে যুক্ত হতে পারে না, এতে করে তাদের অর্থনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি হয়। এরপর জার্মানিতে অনেকে আসেন জার্মান ভাষা না শিখেই। বর্তমানে জার্মানিতে খণ্ডকালীন চাকরিও প্রতিযোগিতামূলক। এ সময় যারা বড় অংকের ঋণ নিয়ে এই দেশে আসেন তাদের পরিবার দেশে টাকা ফেরত পাঠানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। মূলত অর্থনৈতিক সংকট, ভাষা না জানা, টাকা পাঠানোর চাপ আবার ঠিকমতো পড়াশোনা শেষ করতে পারাও একজন শিক্ষার্থীকে হতাশা ও একাকিত্বে ফেলে দেয়। এসব কারণে চাপ সহ্য করতে না পেরে অনেকে আত্মহত্যা করেন।
এর সমাধান কি? এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশি জার্মান এ ক্রীড়া সংগঠক জানান, মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা শিক্ষার্থীদের সময় দিতে হবে। জার্মান সরকার প্রায় ১৩ হাজার ইউরো ব্লক করে এ দেশে আসার নিয়ম চালু করেছে এ সংকট মোকাবিলার জন্যই। অনেকে টাকা আয় করে শুরুতেই হিরো হতে চান, এ মনোভাব দূর করতে হবে, জার্মান ভাষা শিখতে হবে তাহলে চাকরিও পাওয়া যাবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, কোনো কিছু না জানলে বা সমস্যা থাকলে সেটা অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে হবে, তাহলে মানসিক চাপ দূর হবে। সবচেয়ে বড় কথা, সবকিছুর জন্য একটু সময় দিতে হবে। একটু সময় দিলেই সমাধান হয়ে যাবে।
বার্লিনের সাংস্কৃতিক সংগঠক জাহিদ কবীর হিমন বাংলানিউজকে বলেন, দেশে পরিবার পরিজন রেখে জার্মানিতে অনেকেই একাকিত্ব বোধ করেন, জীবন ধারণের জন্য এখানে কঠোর পরিশ্রম করে অর্থ আয় করতে হয়। এ ছাড়া এদেশের পড়াশোনা অত্যন্ত জটিল যা বাংলাদেশের তুলনায় একেবারেই আলাদা, অপরদিকে পরিবার থেকে অর্থ পাঠানো চাপ থাকে। আশ্চর্যের ঘটনা হচ্ছে বাংলাদেশি কমিউনিটিতেও অনেক সময় অনেককে পরিকল্পিতভাবে অপমান করে একঘরে করে রাখা হয়। এসব কারণে একজন শিক্ষার্থীর জীবনে যে কঠিন চাপের সৃষ্টি হয়, যা তাকে আত্মহত্যার মত সিদ্ধান্তের দিকে ধাবিত করে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের এ ধরনের বিপদের সময় মানসিক সমর্থন দিয়ে পাশে থাকার জন্য আমরা একটা সংগঠন গড়ে তুলতে কাজ করে যাচ্ছি। শিগগিরই তা আত্মপ্রকাশ করবে বলে আশা রাখছি।
বার্লিনের প্রবীণ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক মাইন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, আমার কাছে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে অনেকেই ব্যাংক বা বিভিন্নজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে জার্মানিতে পড়তে আসেন। এখানে আসার পর একজন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করবে না কি চাকরি পরে ঋণ পরিশোধ করবে এমন চিন্তায় একটা চক্রের মধ্যে ঘুরপাক খায়। পরে যখন তারা পড়াশোনা ও ঋণ পরিশোধ কোনোটাই করতে না পারে তখন চিন্তা করে বেঁচে থেকে কি হবে।
জ্যেষ্ঠ এ সামাজিক সংগঠক ও সমাজকর্মী তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে নতুন যারা জার্মানিতে আসতে চাচ্ছেন তাদের পরামর্শ দিয়ে বলেন, এখানে আসার আগে সুদূরপ্রসারী চিন্তা করে আসতে হবে। বিভিন্ন এজেন্সি ও চটকদার অনলাইন বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পড়া যাবে না। নিজে ভালোভাবে জেনে-বুঝে প্রস্তুতি নিয়ে আসলে এখানে এসে চক্রের মধ্যে পড়তে হবে না।
অন্যদিকে জার্মানিতে কর্মরত একজন সরকারি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আত্মহত্যা সত্যিই দুখজনক। আমরা জানতে পারি, এদেশে এসে অনেকেই অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে যায়। জুয়ায় টাকা লোকসান দিয়ে ঋণ করে আবার টাকা জুয়াতে বিনিয়োগ করেন অনেকে। পরে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে অনেকেই হতাশায় ভোগেন। এ রকম ঘটনাও শুনেছি। এজন্য সন্তান বিদেশে পাঠিয়ে খেয়াল রাখতে হবে সেখানে তারা কি করছে।
জেএইচ