ঢাকা, সোমবার, ১০ আষাঢ় ১৪৩২, ২৩ জুন ২০২৫, ২৬ জিলহজ ১৪৪৬

প্রবাসে বাংলাদেশ

ফ্রান্সে ‘ফেত দ্য লা মিউজিক’ একটি রাত, হাজারো সুর

মুমিন আনসারি, ফ্রান্স করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:৪৯, জুন ২২, ২০২৫
ফ্রান্সে ‘ফেত দ্য লা মিউজিক’ একটি রাত, হাজারো সুর

শহরের পুরনো ক্যাফেগুলোয় বাজছে অ্যাকোর্ডিয়নের সুর। পাশের মোড়ে দাঁড়িয়ে কেউ গাইছে নিজের লেখা গান।

দূর থেকে ভেসে আসছে ইলেকট্রনিক বিটস। শনিবার (২১ জুন) ফ্রান্স ঠিক এমনই এক অদ্ভুত সুন্দর সুরের শহরে পরিণত হয়, যেখানে প্রতিটি অলিগলিই যেন একেকটি কনসার্ট ভেন্যু।

এই দিনটি কোনো সাধারণ দিন নয়, এটি ফ্রান্সের জাতীয় সঙ্গীত দিবস, বিশ্বজুড়ে পরিচিত ‘ফেত দ্য লা মিউজিক’—যার আক্ষরিক অর্থই ‘সঙ্গীতের উৎসব’। ১৯৮২ সালে ফ্রান্সের তৎকালীন সংস্কৃতি মন্ত্রী জ্যাক ল্যাং ও সঙ্গীত গবেষক মরিস ফ্লোরেট যখন প্রথম এই ধারণা দেন, তখন হয়তো কল্পনাও করেননি যে একদিন এটি ১২০টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়বে।

গতকাল প্যারিসে হেঁটে বেড়ালে আপনি হয়তো বুঝতেই পারতেন না, কোনটা অপেশাদার গায়ক আর কোনটা পেশাদার ব্যান্ড। মেট্রো স্টেশনের ভেতর থেকে শুরু করে নদীর পাশে, ব্যালকনি থেকে ক্যাফের সামনের ফুটপাথ—সবখানে মানুষ গাইছে, বাজাচ্ছে, নাচছে।

গার দ্যু নর্দ স্টেশন থেকে শুরু করে মারাইস-এর পুরনো ইহুদি পাড়া, কিংবা লাতিন কোয়ার্টারের তরুণ অধ্যুষিত বারগুলো—সব জায়গাতেই যেন শব্দ আর সুর মিশে এক হয়ে উঠেছে।

এক তরুণ পিয়ানোবাদক তার কি-বোর্ডে যখন ‘La Vie en Rose’ বাজাচ্ছেন, ঠিক তখনই এক বৃদ্ধা পাশ থেকে বলে উঠলেন—‘এই গানটা আমার প্রথম ভালোবাসার কথা মনে করিয়ে দেয়। ’ এটাই এই উৎসবের সৌন্দর্য—সঙ্গীত এখানে শুধুই বিনোদন নয়, স্মৃতির মিছিলও।

কোভিড পরে এটাই ছিল সবচেয়ে প্রাণবন্ত আয়োজন। মানুষ বেরিয়ে এসেছে ঘর থেকে, কেউ গাইছে, কেউ হাততালি দিচ্ছে, কেউবা মোবাইলের ভিডিওতে ধরে রাখছে সেই মুহূর্ত। অনেক জায়গায় শিশুদের পারফরম্যান্স থেকে শুরু করে ডিজে সেশন পর্যন্ত চলেছে টানা রাতভর।

একজন ফরাসি মা জানালেন, ‘আমার ৮ বছরের মেয়ে আজ তার জীবনের প্রথম মাইক্রোফোন হাতে গাইলো। ওর চোখে যে আনন্দ দেখেছি, তা ব্যাখ্যার বাইরে। ’

সবচেয়ে চমকপ্রদ দিক হলো—এই দিনে ফ্রান্সে কোনো অনুমতির প্রয়োজন নেই গান পরিবেশনের জন্য। চাইলেই আপনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে গান গাইতে পারেন, যন্ত্র বাজাতে পারেন—শুধু শর্ত একটাই, সেটা যেন হয় সঙ্গীতের জন্য, আনন্দের জন্য।

এই একদিনে সঙ্গীত হয়ে ওঠে এক ভাষা, যা কোনো পরিচয় চায় না—চায় শুধু অংশগ্রহণ। পেশাদার শিল্পীর পাশে দাঁড়ানো এক অপেশাদার গায়কও হয়ে ওঠে উৎসবের নায়ক।

সঙ্গীত যেমন এক করে, তেমনি জাগায়। হয়তো এক তরুণ এখান থেকেই শুরু করবে তার সঙ্গীতজীবন, কিংবা এক প্রেমিক এই সুরের রাতেই বলবে ভালোবাসার কথা। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে ভরা এই ফ্রান্সে ২১ জুন যেন এক ‘একতার সুর’—যেখানে সব ভাষা, জাতি, শ্রেণি—সব পেছনে পড়ে যায়, সামনে থাকে শুধু গান।

যখন রাত গড়িয়ে ভোর আসে, শহরের বাতাসে তখনো ভাসে সুরের রেশ। জানালার পর্দা নড়ে ওঠে কোনো তালের ছন্দে। একদিনের এই সঙ্গীত-উৎসব আমাদের মনে করিয়ে দেয়—সৃষ্টির ভেতরেই সুর লুকিয়ে আছে, শুধু দরকার তাকে ডেকে তোলা। ২১ জুন তাই কেবল এক উৎসব নয়, একটি বার্ষিক উপলক্ষ—মনে করিয়ে দেয়, মানুষ গান গায় শুধু কণ্ঠ দিয়ে নয়, হৃদয় দিয়ে।

আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।