ঢাকা, শুক্রবার, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৩ জুন ২০২৫, ১৬ জিলহজ ১৪৪৬

রাজনীতি

নির্যাতিত নেতারাই বরিশাল-২ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী

মুশফিক সৌরভ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০:১৯, জুন ১২, ২০২৫
নির্যাতিত নেতারাই বরিশাল-২ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী

বরিশাল: আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও পতিত সরকারের সাংসদরা যখন জনরোষ থেকে বাঁচতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, ঠিক তখন মুক্ত বাতাসে প্রশান্তির শ্বাস নিচ্ছেন গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকারের জন্য লড়াই করে ১৭ বছর পার করা বিএনপিসহ অন্য দলগুলোর নেতাকর্মীরা। কোনো বাধা-বিপত্তি ছাড়াই দলীয় কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি জাতীয় সংসদসহ বিভিন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য প্রস্তুতিও নিচ্ছেন তারা।

বিশেষ করে তফশিল ঘোষণা না হলেও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অনেকটাই সরগরম রাজনীতির মাঠ। সংসদীয় এলাকাগুলোতে সম্ভাব্য প্রার্থীদের পদচারণা শুরু হয়ে গেছে। যদিও সেই পদচারণায় এবারই প্রথম কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগের কেউ মাঠে নেই; এমনকি তাদের সাথে জোটে থাকাদেরও একই অবস্থা।

বরিশাল জেলার ৬টি সংসদীয় আসনে এরই মধ্যে প্রার্থীতা ঘোষণা করেছে জামায়াত। বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরাও জানান দিয়েছেন তাদের অবস্থান। এর বাইরে অন্য দলগুলোর নেতাকর্মীরাও সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সরব হতে শুরু করেছেন।  

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় সংসদের ১২০ নম্বর আসন (বরিশাল-২) এর নির্বাচনী এলাকায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলাম তাদের প্রার্থী হিসেবে মাস্টার আবদুল মান্নানের নাম এরই মধ্যে ঘোষণা করেছে।  

আব্দুল মান্নান বলেন, বিগত সরকারে আমলে মিথ্যে মামলার আসামি হয়েছি, কারাগারে ছিলাম দীর্ঘদিন। তারপরও জনগণের পাশে ছিলাম। আমি চাই আগামী নির্বাচন ফ্রি-ফেয়ার হোক, যাতে জনগণ তার নিজের ভোটাধিকার নিজেই প্রয়োগ করতে পারে, আর সেটা হলে জয়ের বিষয়েও আমি আশাবাদী।

অপরদিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ নাম ঘোষণা না করলেও ২০১৮ সালের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া মাওলানা নেছার উদ্দিন এবারও দলীয় মনোনয়ন পেতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে। এর বাইরে মডেল তিন্নি হত্যা মামলায় খালাস পাওয়া জাতীয় পার্টির সাবেক সাংসদ গোলাম ফারুক অভি প্রার্থী হতে পারেন এমন গুঞ্জনও রয়েছে তৃণমূলে। যদিও তিনি এবার জাতীয় পার্টির হয়ে নাকি দল বদল করে নাকি স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু জানা যায়নি। তবে তিনি প্রার্থী হলে এ আসনে ভোটের মাঠের হিসাব নিকাশ বদলে যাবে বলে মনে করছেন অনেকে।

পরিসংখ্যান বলছে, বরিশাল-২ আসনে ১৯৭৩ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ৯টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩বার জাতীয় পার্টি, ৩বার বিএনপি বিজয়ী হলেও বাকি ৩বারের মধ্যে দুইবার আওয়ামী লীগ ও একবার ওয়ার্কার্স পার্টি নির্বাচিত হয়েছে। তবে নতুন করে সংসদীয় এলাকা নির্ধারণের পূর্বে দেখা গেছে, বানারীপাড়া উপজেলা ও পিরোজপুরের নেছারাবাদ (স্বরুপকাঠি) মিলে একটি সংসদীয় আসন ছিল। তখন বানারীপাড়া উপজেলার সন্তান প্রয়াত সৈয়দ শহীদুল হক জামাল তিনবার এ আসন থেকে বিএনপির হয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই হিসেবে ২০১৪ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত তিনটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের বাইরে বরিশাল-২ আসনটি বিএনপির দখলেই ছিল।  

সাড়ে ৩ লাখের বেশি ভোটারের এ আসনে বিএনপির হয়ে প্রার্থী হতে চান একাধিক ব্যক্তি, এমনটাই জানা গেছে ভোটার ও অনুসারীদের কাছ থেকে। যার মধ্যে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এস সরফুদ্দিন আহমেদ সান্টুর অবস্থান শক্ত। বিগত সরকারের আমলে তিনি বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে তেমন একটা এলাকায় আসতে না পারলেও তার জনপ্রিয়তা রয়েছে এখনও। যদিও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বরিশাল-২ আসন থেকে দুইবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাই এ আসন থেকে তার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া যায় না, তবে গুঞ্জন রয়েছে, বিএনপির এ ত্যাগী নেতা এবারে বরিশাল-৫ (সদর) আসন থেকে দলীয় মনোনয়ন চাইতে পারেন।

এর বাইরে দল থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশীর তালিকায় রয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক কাজী রওনাকুল ইসলাম টিপু, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য দুলাল হোসেন, বিএনপি নেতা (অব.) কর্নেল সৈয়দ আনোয়ার হোসন, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান, ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল, বিএনপি নেতা ও সাবেক হুইপ প্রয়াত সৈয়দ শহীদুল হক জামালের ছেলে ব্যারিস্টার সৈয়দ সাইফুল হক সাইফ।

এসব প্রার্থীদের মধ্যে প্রায় সবারই পেশা ব্যবসা, যারা ওয়ান ইলেভেনের পর থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে একাধিক হামলা-মামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

যেমন মনোনয়ন প্রত্যাশী ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল বিভিন্ন সময় তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে তাদের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় ছিলেন। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সাবেক ঢাকার ডিবি প্রধান হারুন অর রশিদের টার্গেটের ব্যক্তিতে পরিণত হওয়া ছাত্রদল নেতা জুয়েলের বিরুদ্ধে সরাসরি ৫৬টি মামলা যেমন ছিল তেমনি ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে বিভিন্ন জায়গায় অগণিত মামলার আসামি হয়েছেন। তাকে বহুবার রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করার মতো ঘটনাও ছিল গণমাধ্যমের আলোচিত সংবাদ। এছাড়া বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক কাজী রওনাকুল ইসলাম টিপুও দীর্ঘদিন জেল খেটেছেন এমনকি রিমান্ডে নির্যাতনেরও শিকার হয়েছেন। বিএনপির এই নেতার বিরুদ্ধে ছিল ২৮টির মতো মামলা। একইভাবে একাধিক মামলার আসামি ছিলেন নির্বাহী কমিটির সদস্য দুলাল হোসেনসহ অন্য মনোনয়ন প্রত্যাশীরাও।

আর বিএনপির মনোনয়নপত্র প্রত্যাশী প্রার্থীরা সকলেই দেশ ও মানুষের সেবা করার জন্য রাজনীতিতে যুক্ত থেকে জনপ্রতিনিধি হতে চান বলে জানিয়েছেন বাংলানিউজকে।

মনোনয়ন প্রত্যাশী বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক কাজী রওনাকুল ইসলাম টিপু বাংলানিউজকে বলেন, রাজনীতি ছাড়া আর কিছু ভালোভাবে পারি না, আর শিখেছি মানুষের সেবা করতে। এলাকার মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নে দলের মনোনয়ন চাই, আর যদি মনোনয়ন পেয়ে বিজয়ী হই এবং আমার দল ক্ষমতায় আসে, তাহলে অবশ্যই ভালো কাজগুলোই করবো।

দলের সিদ্ধান্তের বাইরে কোনো পদক্ষেপ নিতে রাজি নন ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল। তিনি বলেন, গত ১৭ বছর দলের হয়ে ফ্যাসিবাদ পতন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে ফ্রন্ট লাইনে ছিলাম, কখনও পিছপা হইনি কিংবা পথভ্রষ্ট হয়নি। আমাদের নেতা তারেক রহমানের আগামীর সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার যে চিন্তাভাবনা, তার সাথে থাকতে চাই, সেটা যেভাবে যে পথেই হোক।

এদিকে তরুণ প্রজন্মের ভোটার সিয়াম হাওলাদার বলেন, তরুণ প্রজন্ম তরুণদের দিকেই ঝুঁকবে এটা স্বাভাবিক। তবে যোগ্য প্রার্থী হলে যে কাউকে ভোট দিতে পারি। আমরা তরুণরা পছন্দের যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার সুযোগ চাই।  

অপরদিকে নির্বাচন নিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) বরিশাল মহানগরের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল আলম বলেন, ভোট কবে হবে কীভাবে হবে তা এখনও আমরা জানি না, তবে নির্বাচনে প্রার্থীদের অবশ্যই জনবান্ধব হতে হবে। আর নির্বাচন ব্যবস্থায় যদি সংস্কারের বিষয়টি সামনে আসে তাহলে সেটি কীভাবে হবে সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তাই এখনই এ বিষয়ে মন্তব্য করা যাবে না। কারণ আমাদের ওপর অন্য কোনো দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা চাপিয়ে দিলে তা নিয়ে আবার প্রশ্ন উঠবে। তাই সংস্কার পর্যন্ত অপেক্ষা করাটাই উত্তম।

উল্লেখ্য, বারবার সীমানার পরিবর্তন ঘটলেও বরিশাল-২ আসনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এখান থেকে ১৯৭৩ সালে বাবু হরনাথ বাইন (বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ), ১৯৭৯ সালে আবদুল ওয়াদুদ সরদার (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল), ১৯৮৬ সালে সৈয়দ আজিজুল হক (জাতীয় পার্টি), ১৯৮৮ সালে সৈয়দ আজিজুল হক (জাতীয় পার্টি), ১৯৯১ সালে রাশেদ খান মেনন (বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি), ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালে সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল), ১৯৯৬ সালের জুনের নির্বাচনে গোলাম ফারুক অভি (জাতীয় পার্টি -এরশাদ), ২০০১ সালে সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল), ২০০৮ সালে মনিরুল ইসলাম মনি (বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ), ২০১৪ সালে তালুকদার মোহাম্মদ ইউনুস (বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ), ২০১৮ সালে শাহে আলম তালুকদার (বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ), ২০২৪ সালে রাশেদ খান মেনন (মহাজোট) থেকে নির্বাচিত হয়েছেন।

এমএস/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।