নিজের যাপিত জীবনেও নেই স্বপ্ন বলতে কিছু। শুধু জানেন অন্যের জমিতে ‘কামলা’র কাজ করেই আহার জোগাতে হবে।
উনুনে আগুন না জ্বললে অনটনের সংসারের দু’দণ্ড শান্তি নয়তো নিমিষেই ম্লান হবে। শ্রমিকদের সম্মান আর অধিকার আদায়ের রক্তাক্ত গৌরবময় দিন মহান মে দিবসের মর্মবাণী জানারও সময় নেই তার! এমনকি নেই প্রায় ১৩৩ বছর আগের নিজেদের অধিকার আদায়ের দিনটি সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণাও!
আঞ্চলিক ভাষায় তাজমুল বলছিলেন এমন- ‘কী অইবো (হবে) মে দিবস বুইজ্জা (বুঝে)? ক্ষেতে খামারেই কাম কইরা (কাজ করে) খাইতে অইবো (খেতে হবে)। কোনো দিফস (দিবস) নাই। আল্লাহ’র দিন সব সমান। পেটে খাওন না থাকলে কেউ খোঁজ লইবো না। বউও বাপের বাড়িত পালাইবো (স্ত্রীও শ্বশুর বাড়ি পালাবে)। ’
ময়মনসিংহ সদর উপজেলার কাতলাসেন গ্রামে বুধবার (০১ মে) খুব সকালে কথা হচ্ছিলো তাজমুলের সঙ্গে। পুরো কথাই তিনি আঞ্চলিক ভাষায় বলেন। প্রমিত বাংলায় তার কথাগুলো উপস্থাপন করলে দাঁড়ায়-চলতি বোরো মৌসুমে নিত্যদিন ৮’শ টাকা মজুরি।
এখানে অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থের জমিতে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজে নির্ধারিত কর্মঘণ্টাও নেই। ৮ ঘণ্টায় কাজ শেষ করারও জো নেই। ন্যূনতম ১০ থেকে ১১ ঘণ্টা খাঁটুনিতে ঘোরাতে হয় সংসারের চাকা। আবার ‘ওভারটাইম’ নামক শব্দটির সঙ্গেও রীতিমতো অপরিচিত এই শ্রমিক।
এ অবস্থা কী কেবল গ্রামের মাঠ শ্রমিক তাজমুলেরই? মোটেও না। খানিক এগোতেই পাশের ফুলবাড়িয়া উপজেলার কাতলাসেন লাগোয়া কালিবাজাইল গ্রামে আরেক গৃহস্থের ক্ষেতে বোরো কাটায় মনোনিবেশ করেছেন মজিবুর রহমান (৫০)। প্রায় সাড়ে ৩০ শতাংশ জমিতে ধান কাটার চুক্তি নিয়েছেন তিনিসহ আরো কয়েক শ্রমিক।
মজিবুর জানান, নগদ টাকাকড়ির পাশাপাশি দুপুরের খাবার দিচ্ছেন গৃহস্থ। এ উপার্জনের টাকা দিয়েই সংসারের চার সদস্যের ভরণ-পোষণ হবে। একদিন কাজ বন্ধ রাখলেই না খেয়ে থাকতে হবে।
প্রতিদিনের টাকায় দিন শেষে রাতে চাল-ডাল-নুন নিয়ে বাড়ি ফিরবেন। এরপর সবাই মিলে খেয়ে নিশ্চিন্ত মনে ঘুম দিবেন।
মজিবরের সঙ্গে আলাপচারিতায় স্পষ্ট হলো মে দিবসের গুরুত্ব বা তাৎপর্য বোঝার কোনো ইচ্ছা নেই তার। ‘দিবসে কী পেট ভরবো?’ মজিবরের কণ্ঠে এমন উচ্চারণের সময়েই খিলখিল করে হেসে উঠলেন অন্য শ্রমিকরাও।
তাদের মোদ্দাকথা- শ্রম দিবসের শোষণ বঞ্চনার স্বপ্ন দেখার দিনটিই তাদের কাছে অন্য দশদিনের মতোই সাধারণ।
অন্য পেশার মতো ফসলের মাঠেও মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছে নারী শ্রমিকরা। মজিবরদের কয়েক ক্ষেত পেরিয়ে এক গৃহস্থের উঠোনে দেখা মিললো আমেনা খাতুনসহ কয়েক নারী শ্রমিকের। চল্লিশ বছর বয়সী আমেনা স্থানীয় কালিবাজাইল গ্রামেরই বাসিন্দা।
ধান শুকানো ও চুছা ছাড়ানোর কাজ করছিলেন। তিনি জানান, মাঠে সারাদিন খেটে পুরুষরা যেখানে পাচ্ছেন সাড়ে ৭’শ থেকে ৮’শ টাকা। সেখানে ৫’শ থেকে সর্বোচ্চ ৬’শ টাকা জুটেছে নারী শ্রমিকদের ভাগ্যে। কাপড়ের খোঁটে বেঁধে সেই টাকা নিয়ে বাড়ি যাবেন।
শ্রমিক দিবসের কথা তুলতেই চোখ ছানাবড়া করে উল্টো আমেনার প্রশ্ন, ‘এইড্যা আবার কী?’ বলেই আঁচলে আড়াল করলেন নিজের মুখ।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৭ ঘণ্টা, মে ০১, ২০১৯
এমএএএম/জেডএস