দেশের বহুল আলোচিত সাবেক ছিটমহল লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার একটি ইউনিয়ন দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা। ১৯৮৫ সালে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহল একত্রে পাটগ্রাম উপজেলার একটি স্বতন্ত্র ইউনিয়ন (দহগ্রাম ইউনিয়ন) হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
২০১১ সালে ১৯ অক্টোবর দহগ্রাম সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দহগ্রামবাসীর স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে ১০ শয্যার হাসপাতাল উপহার দেন। সেই থেকে সরকারি কাগজ কলমে হাসপাতালটিতে সেবা দেওয়া হলে বাস্তবে ভিন্ন।
স্থানীয়রা বাংলানিউজকে জানান, আন্তঃবিভাগ-বর্হিবিভাগে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার কথা থাকলেও কোনো কারণ বা ঘোষণা ছাড়াই কয়েক বছর ধরে আন্তঃবিভাগ বন্ধ রয়েছে। বহির্বিভাগে চিকিৎসা দিতে মাঝে মধ্যে কিছু প্যারাসিটামল ট্যাবলেট নিয়ে দুই ঘণ্টার জন্য হাসপাতাল খুলে বসেন দু-একজন ওয়ার্ডবয় ও নার্স। মাঝে-মধ্যে চিকিৎসকও আসেন, তবে নিয়মিত নন। আর এলেও দুপুর ১২টার মধ্যে হাসপাতালে তালা ঝুলিয়ে চলে যান তারা। দুপুরের পর থেকে পরদিন সকাল ১০টা পর্যন্ত কারও কোনো সমস্যা হলে চিকিৎসা নিতেও ছুটতে হয় পাটগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।
লালমনিরহাট সিভিল সার্জনের কার্যালয় সূত্র জানায়, উদ্বোধনের দিন থেকে দহগ্রাম হাসপাতালে আন্তঃবিভাগ-বর্হিবিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এ হাসপাতালে মেডিকেল অফিসারের চারটি পদেই পূর্ণ থাকলেও দু’জন চিকিৎসক ৮/৯ বছর ধরে অলিখিত ছুটিতে। ডা. নাজমুল ইসলাম ও ডা. আহমেদ মোস্তফা নামে দুই চিকিৎসক খাতা কলমে এ হাসপাতালে নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও বাস্তবে তাদের কোনো সন্ধান নেই খোদ সিভিল সার্জনের কাছেও। বাকি দু’জন বেতন ভাতা তুললেও বাস্তবে কর্মস্থলে নেই। উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার দু’টি পদের একজন কর্মরত থাকলেও বাস্তবে তিনিও অনুপস্থিত। নার্স চারটি পদের চারজনই এ হাসপাতালের সেবা দেখিয়ে বেতন ভাতা তুললেও বাস্তবে তারা একজনও নেই হাসপাতালে। তবে ১০ শয্যার হিসাব অনুযায়ী সরকারি ওষুধ পত্রসহ যাবতীয় সরঞ্জাম নিয়মিত সরবরাহ করা হয় এ হাসপাতালে।
সরেজমিনে দেখা যায়, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হচ্ছে হাসপাতালের যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র ও ভবনগুলো। চামচিকা-বাদুরসহ বিভিন্ন প্রাণীর আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে এ হাসপাতাল। চিকিৎসক ও নার্সদের বসবাসের জন্য করা আটটি কোয়াটার, রোগী পরিবহনের একটি অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার না করায় রুগ্ন হয়ে পড়েছে। পুরো হাসপাতাল জুড়ে একমাত্র ওয়ার্ডবয় মিজানুর রহমান পরিবার নিয়ে চিকিৎসকের একটি কোয়াটারে থাকেন। রোগীদের থাকার বেডগুলো নিজের কোয়াটারে নিয়ে খাট হিসেবে তিনি ব্যবহার করছেন।
দহগ্রামের গৃহবধূ এস্মোতারা বেগম বাংলানিউজকে জানান, হাতের কাছে হাসপাতাল থাকলেও মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবাসহ যেকোনো সমস্যা হলে পাটগ্রাম হাসপাতালে যেতে হয়। এটা নামের হাসপাতাল। মাঝে মধ্যে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চিকিৎসক এসে সব রোগের একই ওষুধ দিয়ে চলে যান। এরপর মরতে বসলেও প্রাথমিক চিকিৎসা জোটেনা দহগ্রামবাসীর কপালে।
এসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহারটি পুনরায় সচল করতে প্রধানমন্ত্রীর সহায়তা কামনা করেন তিনি। একই কথা বলেন আঙ্গোরপোতা গ্রামের কলেজছাত্রী মারুফা আক্তার।
লালমনিরহাট সিভিল সার্জন ডা. কাশেম আলী বাংলানিউজকে বলেন, বিনাছুটিতে দীর্ঘ ৮/৯ বছর অনুপস্থিত থাকা দহগ্রাম হাসপাতালের দুই চিকিৎসকের বিষয়ে একাধিকবার মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। বাকি জনবল হাসপাতালে কর্মরত রয়েছেন এবং সরকারিভাবে তাদের জন্য ওষুধপত্রসহ যাবতীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে হাসপাতালে তালা ঝুলে থাকার বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির মাধ্যমে বেরুবাড়ির বিনিময়ে দহগ্রাম আঙ্গোরপোতা তিনবিঘার মালিকানা পায় বাংলাদেশ। ভারতের অভ্যন্তরে একটুকরো এ বাংলাদেশে প্রবেশ করতে করিডোর ব্যবহার করতে হয়। ১৯৮৫ সালে দহগ্রাম একটি স্বতন্ত্র ইউনিয়ন পরিষদ হিসেবে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার সঙ্গে যুক্ত হয়। ১৯৯২ সালে করিডোর গেট হয়ে এক ঘণ্টার জন্য দীর্ঘ বন্দি জীবন থেকে মুক্তি পান এ দহগ্রাম ইউনিয়নের মানুষ। পরবর্তীতে ২০০১ সাল থেকে সারাদিনের জন্য করিডোর গেট খুলে রাখা হলেও সন্ধ্যার পরেই গেট বন্ধ করে দেওয়া হতো। ২০১১ সালে ১৯ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দহগ্রাম সফরে গিয়ে আজীবনের জন্য করিডোর গেট খুলে রাখার উদ্বোধন করেন। সেদিনই উপহার স্বরূপ দহগ্রামবাসীর স্বাস্থ্য সেবার জন্য ১০ শয্যা বিশিষ্ট দহগ্রাম হাসপাতালের উদ্বোধন করেন।
বাংলাদেশ সময়: ১১১১ ঘণ্টা, এপ্রিল ১১, ২০১৯
এনটি