হবিগঞ্জ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষজনও নববর্ষ উদযাপন করেন। তবে সেটা হালফিল আধুনিকতার ছোঁয়ায় নয়।
এছাড়া হাওরাঞ্চলের মানুষদের বৈশাখ উদযাপনের ব্যাপরটি নির্ভর করে ঘরে তোলা নতুন ধানকে ঘিরেই। ধানের ভাল ফলন হলে উৎসবের আমেজ বেশি, আর কাল বৈশাখীসহ বিভিন্ন কারণে ফলন কম হলে বা ফসলহানি হলে মনমরা অবস্থাতে নিরানন্দেই কাটাতে হয় নববর্ষের প্রথম দিনটি। বিগত বছর আগাম বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়াতে এবার উৎসাহ-উদ্দীপনা একটু কম।
হবিগঞ্জের আজমিরিগঞ্জ উপজেলার জলসুখা গ্রামের রাজীব ঘোষ বাংলানিউজকে বলেন, বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনেই ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে করা হয় পূজা-অর্চনা। এছাড়াও ছোটদের নতুন কাপড় পরিধান, পাড়া-পড়শীদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ, ঘর-দরজা পরিষ্কার করা, নববধূদের বাবার বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে যাওয়াসহ পূর্ব পুরুষদের আচরিত চল অনুসরণ করেই শেষ করা হয় দিনটির। তবে বিশেষ এই দিনটিতে তাদের কেউ যাতে কোনো ধরনের অমঙ্গলের সম্মুখীন না হন সে ব্যাপরটিতে বেশি নজর দেয়া হয়।
আজমিরিগঞ্জ বাজারের কাপড় ব্যবাসয়ী মৃণাল কান্তি গোপ জানান, পহেলা বৈশাখের এক মাস আগে থেকেই তিনি তার ক্রেতাদের নিমন্ত্রণ করেন সন পালন/উদযাপনের জন্য। আর নববর্ষের দিনে হাওরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থান থেকে ক্রেতারা সপরিবারে আসেন তার দোকানে। সকলকেই ভরাপেট মিষ্টিসহ বিভিন্ন খাবার দিয়ে আপ্যায়নের পর হাসিমুখে বিদায় দেন। ক্রেতারাও যাওয়ার সময় বিগত বছরের সকল বকেয়া অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে পরিশোধ করে যান। বছরের প্রথম দিনটিতে সকল ক্রেতাকে হাসিমুখে বিদায় করাটাই তাদের প্রধান লক্ষ্য থাকে।
তিনি আরো জানান, অন্যান্য বছরে বাংলা সন শুরুর ১ মাস আগে থেকেই ক্রেতারা ঠাট্টা করে তাকে বলতেন, দাদা এবার কিন্তু বেশি করে মিষ্টি খাওয়াত হবে। কিন্তু বিগত বছর আগাম বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় তার নিয়মিত ক্রেতাদের মাঝেও নেই তেমন উৎসাহ।
প্রত্যন্ত পাহাড়পুর গ্রামের স্বাধীন মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, বিগত বছর আগাম বন্যায় ক্ষতি হওয়ার পর আবার নতুন করে ধান ফলিয়েছি। এতে আর্থিকভাবে তিনি দুর্বল হয়ে পড়েছি। তাই এবার পহেলা বৈশাখে সন্তানদেরকে নতুন কাপড় কিনে দিতে পারিনি। তবে সুন্দরমতো ধান ঘরে তুলতে পারলে সকলকেই নতুন জামা কিনে দেবেন বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন স্বাধীন।
সরেজমিনে আজমিরীগঞ্জের পাহাড়পুর বাজার ঘুরে ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, আজ থেকে প্রায় ১ দশক আগেও এ বাজারটিতে বাংলা নববর্ষে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ীদের মধ্যে শুভ হালখাতা উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রায় সপ্তাহব্যাপী প্রস্তুতি চলতো। মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে নববর্ষের দিনে পুরনো দেনাদারদের দাওয়াত করে এনে মিঠাই-মণ্ডা খাইয়ে লেনদেনের নিকেশ করা হতো। সেই সাথে চলতো গল্প-গুজব প্রাণোচ্ছ্বল আড্ডা। সন্ধ্যায় হতো মিলাদ মাহফিল। আর সনাতন ধর্মাবলম্বী ব্যবসায়ীদের দোকানে বিভিন্ন গাছের পাতা ও ফুল নিবেদনের মাধ্যমে পূজাঅর্চনা করা হতো। এরপর একই নিয়মে দেনাদারদের দাওয়াত করা ও মিষ্টি বিতরণের পালা চলতো দিনভর। আর সন্ধ্যার পর বসতো কীর্তন বা অন্যান্য গানের আসর। তবে কালের পরিক্রমায় এসব অনুষ্ঠানাদি এখন একেবারেই হারিয়ে গেছে।
ওই বাজারের হরলাল দাশ নামে এক মিষ্টির ব্যবসায়ী জানান, আগেকার দিনে বৈশাখের প্রথম দিনে অনেক বেশি মিষ্টি বিতরণ করা হতো। তবে বর্তমানে গ্রামের ছেলে-মেয়েরা শহরমুখী হয়ে গেছে। এখন আর আমাদের পুরনো ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি বর্তমান প্রজন্মের তেমন একটা আগ্রহ নেই, টান নেই, দরদ নেই। অধিকাংশ ছেলেপুলেই ভোরবেলা পহেলা বৈশাখের কনসার্ট এবং নানা অনুষ্ঠান উপভোগ করতে শহরে চলে যায়। যে কারণে বাংলার পুরোনো সব ঐতিহ্য হারাতে বসেছে।
এ ব্যাপারে হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক মাহমুদুল কবীর মুরাদ বাংলানিউজকে বলেন, সরকারি কর্মসূচির মধ্য দিয়ে গোটা জেলায় পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হবে। এতে প্রতিটি উপজেলা পরিষদই হাতে নেবে নানা সরকারি কর্মসূচি। তবে যেহেতু হবিগঞ্জের অধিকাংশই হাওরাঞ্চল, সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতে প্রান্তিক কৃষকদের সম্পৃক্ত করে কিছু করা যায় কি না, সে ব্যাপারে কাজ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
** ব্যাপক ফলনেও বৈশাখের আনন্দ নেই কৃষকের মনে
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০১৮
জেএম