মাটির তৈরি শিল্পকর্ম দিন দিন আবেদন হারিয়ে আজ তা বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। কালের বিবর্তনে, শিল্পায়নের যুগে ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য এই মৃৎশিল্প।
তবে সব ধরনের বাধা ও প্রতিকূলতাকে পেছনে ফেলে পৈত্রিক মৃৎশিল্পের এই ধারাবাহিকতাকে বড় সযতনে বাঁচিয়ে রেখেছেন শ্রীমঙ্গলের জ্যোর্তিময় পাল। তার পরিবারের প্রায় প্রত্যেকেই এই পেশায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।
তিনি তার এলাকার তিনজন দুঃস্থ নারীর কর্মসংস্থানেরও সুযোগ করে দিয়েছেন এখানে। নিয়তি পাল, রিনা পাল এবং কানন পাল নামের তিন নারী তার সহকারী হিসেবে কাজ করছেন।
শ্রীমঙ্গল শহরের সন্ধানী আবাসিক এলাকায় জ্যোর্তিময়ের কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, প্রত্যেকেই মাটির তৈরি জিনিসপত্র নির্মাণে ব্যস্ত সময় পার করছেন। পরিষ্কার এঁটেল মাটিতে অভিজ্ঞ হাতের অসাধারণ নৈপুণ্য, অক্লান্ত পরিশ্রম আর কারিগরি জ্ঞানের মেলবন্ধনে জ্যোর্তিময় একে একে নির্মাণ করে চলেছেন আপন শিল্পকর্ম। প্রতিটির নির্মাণক্ষণ মাত্র ৩০ থেকে ৪০ সেকেন্ড। জ্যোর্তিময় বাংলানিউজকে বলেন, ‘মেসার্স রাণী মৃৎশিল্প কারখানা’ নামক এই প্রতিষ্ঠানটিতে আমি এবং আমার স্ত্রী বীণা পাল দুজনেই পরিশ্রম করি। আমাদের পাশাপাশি আমার সন্তানরাও জড়িত রয়েছে এখানে।
তিনি বলেন, মৌলভীবাজার, শ্রীমঙ্গল, রাজনগর, ভূনবীর, সরকার বাজার ও টেংরাবাজার থেকে পাইকারি আড়ৎদাররা এসে কিনে নিয়ে যায় মাটির বিভিন্ন জিনিসপত্র। হাঁড়ি, পাতিল, কলস, ফুলের টব, ফুলদানি, ঘট, চাটা, বগলাসহ অর্ধশতাধিক আইটেম রয়েছে এখানে।
আক্ষেপ প্রকাশ করে তিনি জানান, মৌলভীবাজারের স্বনামধন্য অনেক দই-মিষ্টির ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে জন্মলগ্ন থেকে প্রায় বিশ বছর আমি মাটির বিভিন্ন জিনিসপত্র সরবরাহ করে এসেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় গত দুই বছর ধরে তারা মাটির জিনিসপত্রের পরিবর্তে এখন প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার করছেন। ক্রেতার চাহিদা নাকি এখন আর মাটির তৈরি স্বাস্থ্যসম্মত জিসিনপত্রের দিকে নেই।
সাংসারিক জীবনে দুই ছেলে ও এক মেয়ের বাবা জ্যোর্তিময়। বড় ছেলে জয়দেব বিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেছেন। ছোট ছেলে গৌরাঙ্গ পড়ছেন মাস্টার্সে। দুই ছেলেই পৈত্রিক ব্যবসায় সম্মান দেখিয়ে এর সঙ্গে যুক্ত।
জ্যোর্তিময়ের ছেলে জয়দেব বাংলানিউকে বলেন, সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের ক্রেতাদের বুঝতে হবে কোন জিনিসটি স্বাস্থ্য এবং সুযোগ-সুবিধার দিকে এগিয়ে। ক্রেতারা যদি মিষ্টির দোকানে গিয়ে বলেন আমাদের মাটির পাত্রেই দই দেবেন তাহলে দোকান কর্তৃপক্ষ তার ক্রেতার কথা বিবেচনায় রেখে মাটির পাত্রেই দই বিক্রি করবেন।
মাটির পাতিলে স্বাদের একটি বিষয় রয়েছে এমন বক্তব্য উল্লেখ করে জ্যোর্তিময় বলেন, মাটির তৈরি পাতিলে দই ফ্রিজে ৭-৮ ঘণ্টা রেখে দিলে একভাবেই থাকে। কিন্তু প্লাস্টিকের পাত্রে রাখলে ঘণ্টা দু-তিনেকের মধ্যেই ঘনত্ব নষ্ট হয়ে গলে যায়। মিষ্টির ক্ষেত্রেও অনেকটা তাই। আমাদের পার্শ্ববর্তী পশ্চিমবঙ্গে এখনও দই-মিষ্টির ক্ষেত্রে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। আর এটা স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং বেসরকারি সহযোগিতা পেলে এই শিল্পকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে এলাকার দুঃস্থ মানুষের কর্মসংস্থানের কথা জানান শিল্পী জ্যোর্তিময় পাল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শেখ মনির উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমান সময়ে প্লাস্টিকের জামানার সঙ্গে যুদ্ধ করে মৃৎশিল্প টিকে থাকতে পারছে না। প্লাস্টিক, মেলামাইন এগুলো খুবই সহজলভ্য হয়ে গেছে এবং মানুষের রুচির জায়গাটা নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। মানুষ এখন আর সুন্দর একটি হস্তশিল্প কিংবা তার নিজের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কোনো জিনিস ব্যবহারের কথা চিন্তা করে না। কিন্তু প্লাস্টিক, মেলামাইন যে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর সেটাও বিবেচনায় আনে না।
নিজস্ব সংস্কৃতি, সমাজ, সভ্যতা, চেতনা, নিজেদের বাঙালিত্বের যে একটা ব্যাপার, আমরা যে সেই মৃৎশিল্পের জগতের মানুষ এগুলো আজ আমাদের মাথায় নেই বলে আক্ষেপের সঙ্গে জানান ড. শেখ মনির উদ্দিন।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৪১ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৮
বিবিবি/আরআর