কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের কারণে দুর্ভোগ তার পিছু ছাড়েনি। কিছু হিংস্র মানুষের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে তার বাড়িটির ওপর।
পাগলা গারদ থেকে বের হয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে তাকে করতে হয় ভিক্ষা। সবকিছু হারিয়ে ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে ঠাঁই হয় ফেনী সদর উপজেলার ধর্মপুর আবাসন ও আশ্রায়ন প্রকল্পের ৩ নং ব্যারাকের একটি কক্ষে।
সম্প্রতি বাংলানিউজটোয়েন্টিফোরসহ বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে তার দুর্ভাগ্যজনক পরিণতির প্রতিবেদন প্রকাশের পর টনক নড়ে প্রশাসনের। খবর নিতে শুরু করে জেলা প্রশাসন। সেনাবাহিনীর গোয়েন্দাদের সহায়তায় ফিরে পান হারানো দুই সন্তান শাহ আলম ও শাহজাহানকে। কিন্তু দুই সন্তানকে ফিরে পিয়েও মেহেরজানের হাহাকার থামে না। অসহায় মা’কে দূরে ঠেলে দেয় তারা।
রোববার (০৮ এপ্রিল) বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপচারিতার সময় মেহেরজান জানান, মুক্তিযুদ্ধের পর এতোগুলো বছর পার হয়ে গিয়েছে, কিন্তু এখনও শহীদ জননীর স্বীকৃতি মেলেনি তার। মেলেনি মুক্তিযোদ্ধাভাতাসহ কোনো সুযোগ-সুবিধা। তার শেষ আশ্রয় ছিল বঙ্গবন্ধুর দেওয়া বাড়িটি। কিন্তু বেহাত হয়ে গেছে সেটিও।
বর্তমানে আর কিছু না হোক, বঙ্গবন্ধুর দেওয়া বাড়িটা ফিরে পেতে চান তিনি।
তিনি বলেন, এতো বছর পর দুই হারানো সন্তানকে ফিরে পেয়েছি, কিন্তু তাদের সঙ্গে থাকতে পারছিনা। সরকার যদি মিরপুরের সেই বাড়িটি উদ্ধার করে দেয়, তাহলে মরেও শান্তি পেতাম। সন্তান এবং নিজের একটা স্থায়ী ঠিকানা হতো।
জননী মেহেরজান জানান, বঙ্গবন্ধু তাকে ‘ধন্য স্ত্রী’, ‘ধন্য জননী’ উল্লেখ করে লিখিতভাবে সান্তনা দিয়েছিলেন। সান্তনা পত্রের সঙ্গে নগদ ৩৬ হাজার টাকা ও মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন।
পরে তাকে ঢাকার মিরপুর রূপ নগরের ৫ নম্বর সেকশনের ১৬ নং লেনের ৬৩৬ নং টিনশেট বাড়িটি বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেখানে বসবাসরত অবস্থায় ১৯৮৪ সালের সেপ্টেম্বরে এক প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গপাঙ্গরা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়।
মেহেরজান বলেন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে বারবার গিয়েও কোনো প্রতিকার মেলেনি। তাই এরপর থেকে ভিক্ষা করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না।
জানা যায়, বাড়িটি উদ্ধারের জন্য মেহেরজান গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কমিশনার সেটেলমেন্টের কাছে আবেদন করার পর ১৯৯৭ সালের ১৭ অক্টোবর শুনানির দিন ধার্য করা হয়। শুনানিতে মেহেরজান হাজির হলেও কর্তৃপক্ষ আজও তাকে কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি।
বয়সের ভারে নুয়ে পড়া প্রায় ৯০ বছরের অসহায় বৃদ্ধা মেহেরজান বিবি ক্ষুধার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে ভিক্ষা করতে বের হন প্রতিদিন মানুষের দুয়ারে দুয়ারে। এই বয়সেও চরম অসহায়ত্বের মধ্যে দিন কাটছে তার। পাশে কেউ নেই, আছে শুধু কিছুদিন শান্তিতে বেঁচে থাকার আকুতি।
খবর নিয়ে জানা যায়, মেহেরজান বিবি ১৯৩০ সালের ১০ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম ইব্রাহীম, পেশায় উকিল। মায়ের নাম বিবি হনুফা। পৈতৃক নিবাস চাঁদপুর সদর উপজেলার বাবুর হাট এলাকার ২৬ নং দক্ষিণ তরপুরচণ্ডী গ্রামে।
তারা ছিলেন তিন ভাই ও তিন বোন। সোনাগাজী উপজেলার ৬ নং চরছান্দিয়া ইউনিয়নের বড়ধলী হাজী বাড়ির মরহুম মমতাজ উদ্দিনের ছেলে সুবেদার এটিএম সামসুদ্দিনের (পরে মেজর) সঙ্গে মেহেরজান বিবির বিয়ে হয়। পঞ্চাশের দশকে নদীগর্ভে বড়ধলী গ্রাম বিলিন হয়ে গেলে নিঃস্ব পরিবারটি শহরে চলে আসে। থাকা শুরু করেন ঢাকার মিরপুর ১ নাম্বারের একটি বাড়িতে।
মেহেরজান বিবি জানান, তার ৯ ছেলে ও ২ মেয়ে ছিল। তার ছয় ছেলে ও স্বামী একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে শহীদ হন।
শহীদ ছেলেরা হলেন- ছায়েদুল হক (সিলেটে রিলিফ অফিসার পদে কর্মরত ছিলেন), দেলোয়ার হোসেন, বেলায়েত হোসেন, খোয়াজ নবী, নুরের জামান ও আবুল কালাম। বাকি দুই ছেলে শাহ আলম ও শাহ জাহান। তারা মেহেরজানের কোনো খোঁজ-খবর নেন না এবং তাদের সন্ধানও তিনি জানেন না। দুই মেয়ে মরিয়ম বিবি ও হাসনা বিবি মারা গেছেন।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনী তার স্বামী ও ছয় সন্তানকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, মুক্তিযোদ্ধা পরিবার জানতে পেরে মিরপুরে তাদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে মেহেরজান ঢাকার মিরপুরে বাংলা মিডিয়াম হাই স্কুলের (বর্তমানে মিরপুর বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়) শিক্ষিকা ছিলেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর স্বামী-সন্তানদের শহীদ হওয়ার খবরে তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। দীর্ঘদিনেও তার পুরোপুরি মানসিক সুস্থতা ফিরে আসেনি।
বাংলাদেশ সময়: ১০০৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১১, ২০১৮
এসএইচডি/এনএইচটি