ঢাকা, বুধবার, ১২ ভাদ্র ১৪৩২, ২৭ আগস্ট ২০২৫, ০৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

জাতীয়

বেদে কন্যাদের চোখে-মুখে খুশির ঝলক

জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২:৫৯, এপ্রিল ৪, ২০১৮
বেদে কন্যাদের চোখে-মুখে খুশির ঝলক প্রশিক্ষণ শেষে নগদ টাকা ও সনদপত্র প্রদান/ছবি: বাংলানিউজ

ঢাকা: চৈত্রের কটকটা রোদ। তীব্র গরম। তা সত্ত্বেও ওদের চোখে মুখে উজ্জ্বল আভা। ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি। এই হাসি অনগ্রসর জীবন থেকে উন্নত জীবনে উত্তরণের। এই হাসি বেদে কন্যাদের দিন বদলের।

আগে যারা পাড়ায় পাড়ায় সাপ খেলা দেখিয়ে বেড়াতো, দিনটিই যেন ছিলো সেই বেদে কন্যাদের। তারা এখন সবাই স্বপ্ন দেখছে নতুন জীবনের।

অনগ্রসর জীবন থেকে বের হয়ে একেক জন নিজেকে গড়ে তুলেছে উদ্যোমী উদ্যোক্তা হিসেবে।

সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন স্বনির্ভরতার পথে এই সম্প্রদায়ের তরুণীরা।

পোশাক সেলাই প্রশিক্ষণ শেষে বুধবার (০৪ এপ্রিল) দুপুরে ৩০ জন বেদে তরুণীর হাতে তুলে দেয়া হয় সনদপত্র ও এককালীন আর্থিক অনুদান।

উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি হাবিবুর রহমান। তিনি প্রশিক্ষণ গ্রহণের স্বীকৃতি স্বরূপ বেদে কন্যাদের হাতে নগদ সহায়তা ও সনদ তুলে দেন।  

সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ রাসেল হাসানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন সাভার পৌরসভার মেয়র আব্দুল গণি, পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) আবিদা সুলতানা, ঢাকা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাইদুর রহমান, সাভার সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খোরশেদ আলম, উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান প্রমুখ।

নিজের অনুভূতি জানাতে মঞ্চে ডাকা হয় বেদে কন্যা বর্ষা আক্তারকে। প্রশিক্ষণ নেয়া ৩০ তরুণীর প্রতিনিধি হিসেবে তিনি বলেন, নারী শিক্ষা ও বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বেদে সম্প্রদায়ের কিশোরী ও তরুণীদের বাল্য বিয়ের যে প্রচলন ছিলো তা প্রতিহত হয়েছে। এখন শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমরা উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে ওঠার স্বপ্ন দেখছি। এক্ষেত্রে পুলিশ কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান আমাদের কাছে দিনবদলের দূত। এখন আমরা স্বপ্ন দেখি উন্নত জীবনের- আবেগঘন কণ্ঠে বলেন বর্ষা।

বেদে পল্লীর পোড়াবাড়ি সমাজকল্যাণ সংঘের সাধারণ সম্পাদক রমজান আহামেদ বলেন, বেদে পল্লীতে যেখানে আগে মাদক ব্যবসা হতো সেখানে মাদক ছেড়ে সবাই উন্নত জীবনের পথে। বেদে সম্প্রদায়ের শিক্ষিত তরুণদের জন্যে উত্তরণ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে কোচিং সেন্টার খোলা হয়। আর তরুণীদের জন্যে তৈরি করা হয় তৈরি পোশাক কারখানা। গাড়ি চালনার মতো কারিগরী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যথাযথ কর্মসংস্থান ছাড়াও যোগ্যতা অনুযায়ী সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করেছেন পুলিশ কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান। এভাবেই ‘উত্তরণ’র হাত ধরে এখন উত্তরণের পথে গোটা বেদে সম্প্রদায়।

পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) আবিদা সুলতানা জানান, এতদিন কেবল পত্রপত্রিকায় পড়ে এসেছি বেদে সম্প্রদায়ের সমাজ বদলের গল্প। আজ সরাসরি এসে দেখলাম তার চাইতে-ও বেশি কিছু হয়েছে এই পল্লীতে।

ঢাকা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) সাইদুর রহমান বলেন, সাড়া জাগানো ‘বেদের মেয়ে জোৎসা’ চলচ্চিত্রের বেদে কন্যার চরিত্রের সঙ্গে বাস্তবের বেদে কন্যাদের আর মিল পাওয়া যাবে না। কারণ সেই পরিস্থিতি বদলে দিয়েছেন হাবিবুর রহমান স্যার।

সাভার সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খোরশেদ আলম বলেন, শুধুমাত্র বেদে পল্লীই নয়, স্থানীয় হিজড়া সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়নে হাবিবুর রহমান স্যারের নেয়া নানা পদক্ষেপ আজ সাড়া ফেলেছে সমাজে।

সাভার পৌরসভার মেয়র আব্দুল গণি জানান, পুলিশ কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান এখানে প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়েছেন, মসজিদ, ঈদগাঁহ, খেলার মাঠ উন্নয়ন করেছেন। ছিন্নমূল বেদেদের আশ্রয়ণের জন্যে গুচ্ছ গ্রাম প্রতিষ্ঠা করছেন। এভাবেই সাভারকে বদলে দিয়ে এই পুলিশ কর্মকর্তা সাভারবাসীর হৃদয়ে স্থায়ীভাবে আসন গড়েছেন।

ইউএনও শেখ রাসেল হাসান বলেন, হাবিবুর রহমান স্যারের প্রচেষ্টায় জেলা প্রশাসন যুক্ত থেকে এখানকার মানুষদের জীবনমান উন্নয়ন করেছে। সমাজ বদলে যা পরিণত হয়েছে মডেলে।

পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি (পার্সোনাল ম্যানেজমেন্ট) ও উত্তরণ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান জানান, আমি যখন ঢাকার পুলিশ সুপার (এসপি) ছিলাম তখনই আমার নজরে আসে এখানকার অপ্রতিরোধ্য মাদক ব্যবসা। যার পরিপ্রেক্ষিতে গোটা এলাকাটিই হয়ে উঠেছিলো অপরাধ প্রবণ।

আইন প্রয়োগের মাধ্যমে অপরাধ পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব না, প্রয়োজন সচেতনতা- এমন ধারণা থেকেই আমি অপরাধের শেকড় অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখতে পাই এখানকার মানুষদের জীবনের কুসংষ্কার, বাল্য বিয়ের মতো দীর্ঘদিনের অনাচারসহ নানা অসামাজিক কার্যকলাপ। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এই মানুষদের আলোর পথে আনার। সেই প্রয়াসে এখন গোটা এলাকা জেগে উঠেছে। মানুষদের জীবনমান উন্নত হয়েছে। মর্যাদা বেড়েছে অনগ্রসর বেদে জনগোষ্ঠীর। এটাই আমার প্রাপ্তি।

তবে এই প্রাপ্তিকে ধরে রাখতে হবে। টেকসই করতে হলে এখানকার কেউ অপরাধে যুক্ত হলে সামাজিকভাবেই তাকে সচেতন করে তোলার আহ্বান আসে এই পুলিশ কর্মকর্তার কণ্ঠে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫০ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৪, ২০১৮
জেডআর/এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।