ঢাকা, রবিবার, ৯ ভাদ্র ১৪৩২, ২৪ আগস্ট ২০২৫, ০০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

জাতীয়

নামজারির দুর্ভোগ দেশজুড়ে

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:৩৬, আগস্ট ২৪, ২০২৫
নামজারির দুর্ভোগ দেশজুড়ে

ডিজিটাল ভূমি সেবা চালু হলেও সার্ভার সমস্যা, জনবল সংকট, কর্মকর্তা ও দালালদের কারণে সাধারণ মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়ছেন। জমি নামজারি, খাজনা পরিশোধ, বিদেশযাত্রা, চিকিৎসা ও ব্যাবসায়িক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

সরকারও পাচ্ছে না কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব। ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন ভূমি অফিসে সরেজমিন ঘুরে এসব চিত্র দেখা গেছে।

ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, মাসের পর মাস ঘুরেও জমি নামজারি করতে পারছেন না। কেউ বিদেশ গমনে আটকে পড়েছেন, কেউ বা চিকিৎসার জন্য জরুরি টাকা সরবরাহে ব্যর্থ। আবার কেউ ব্যাবসায়িক লেনদেন করতে না পেরে আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি। অনেকে অভিযোগ করেছেন, ডিজিটাল সেবা চালু হলেও ঘুষ ও দালালবিরোধী প্রচেষ্টা কার্যকরে তেমন কোনো সুফল হয়নি।

কর্মকর্তারা ফাইল অনলাইনে আটকে রাখার কারণে দীর্ঘসূত্রতার শিকার হচ্ছেন মানুষ।

সরেজমিন গাজীপুর : গাজীপুরে অনলাইন সার্ভারে প্রবেশ করা কঠিন। কম্পিউটারে প্রায়ই ‘বেড গেটওয়ে’ বার্তা দেখা দেয়। সার্ভার সমস্যা এবং জনবল সংকটে ফাইল যাচাই-বাছাই বিলম্বিত হচ্ছে। এতে শত শত মানুষ ভূমি সেবা নিতে সমস্যায় পড়ছেন।  

টঙ্গী সার্কেল অফিসের আওতাধীন গাছা ভূমি অফিসের এক কর্মকর্তা বলেন, নতুন সার্ভার প্রতিদিন আপডেট হওয়ায় গতি কম। অনেক সময় ৫ মিনিটের কাজ এক ঘণ্টা লাগছে।

এখানকার উপসহকারী কর্মকর্তা মো. ইউসুফ মিয়া বলেন, সার্ভারের ইন্টারন্যাল ত্রুটি থাকলে অনেক সময় ফাইল শো করে না। তবে সার্ভারের চেয়ে কিছু কমন ভুল বিশেষ করে পরচা, ভায়া দলিল, ওয়ারিশ সনদ ইত্যাদি জমা না দেওয়ায় ফাইল বাতিল হচ্ছে।

এতে তাদের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। সালনা থেকে আসা ফরিদুল ইসলাম জানান, তাঁর ভগ্নিপতি জটিল রোগে আক্রান্ত। চিকিৎসার জন্য জমি বিক্রি করে বিদেশে যাবেন। তবে জমি বিক্রি করতে চেয়েও সার্ভার সমস্যার কারণে খাজনা দিতে পারছেন না। এতে জমি বিক্রি আটকে গেছে।

চাঁদপুরের হাইমচরের ব্যবসায়ী নূর মোহাম্মদ বলেন, গাজীপুর মহানগরীর পুবাইলের বসুগাঁও এলাকায় পৌনে ছয় শতাংশ জমি কিনেছেন। দেড় মাস আগে অনলাইনে জমি নামজারির আবেদন করেছেন। ২৮ দিনের মধ্যে নামজারি হওয়ার কথা। মোবাইল ফোনেও মেসেজ আসার কথা। কিন্তু মোবাইল ফোনে মেসেজ না পেয়ে খোঁজ নিতে সহকারী কমিশনার (ভুমি) এসেছেন।

জেলা রাজস্ব বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য শুধু গাজীপুর সদর সার্কেলে চার হাজার আবেদন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। জনবল সংকট সরকারি অন্য কাজ করতে গিয়ে এসব নথি অনুমোদন করতে দেরি হচ্ছে।

সরেজমিন নারায়ণগঞ্জ : নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ, আড়াইহাজার, সোনারগাঁও ও বন্দর উপজেলায় সার্ভার জটিলতার কারণে মানুষের দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে। অনলাইনে ভূমি নামজারি, খাজনা পরিশোধ ও অন্যান্য কার্যক্রমে আবেদন আটকে যাচ্ছে। সরকারি ফি ও খাজনা দিতে না পারায় ব্যবসা স্থবির হয়ে পড়েছে। দেখা গেছে দালালদের দৌরাত্ম্য।

কায়েতপাড়ার উত্তরপাড়ার মোতাহার হোসেন বলেন, খাজনা দিতে গিয়ে ২১ দিন ধরে সার্ভারের সমস্যার কারণে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। রূপগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) তরিকুল আলম জানালেন, সমস্যার মূল কারণ সার্ভারের নতুন ভার্সনে আপডেট, যার ফলে কিছুটা বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। দ্রুত সমাধানের চেষ্টা চলছে।

আড়াইহাজারে কল্যাণদি এলাকার ওদুদ মিয়া এবং বিশনন্দীর মাসুম মিয়া জানান, কর্মকর্তারা বলতে পারছেন না কখন সার্ভার সমস্যা সমাধান হবে। সোনারগাঁওয়ে দুই মাসে একটি নামজারি ডিসিআরও হয়নি। শম্ভুপুরার নজিবুল্লাহ হক বলেন, খারিজ ও ডিসিআর দিতে না পারায় হতাশ। বারদী ইউনিয়নের অমলেশ চন্দ্র সরকারও জমি বিক্রি করতে না পারায় বিদেশযাত্রা বিলম্বিত।

রূপগঞ্জের নবী হোসেন বলেন, তিন শতাংশ জমি বিক্রি করতে চেয়েও খারিজ পাচ্ছেন না। আড়াইহাজারের হালিম ভূঁইয়া জানান, খারিজে খতিয়ান ভুল আসায় ব্যবসা শুরু করতে পারছেন না।

আড়াইহাজারের লতব্দী এলাকার হালিম ভূঁইয়া জানান, ব্যবসা শুরু করার উদ্দেশ্যে জমি বিক্রি করার চেষ্টা করছেন। তবে সার্ভার সমস্যার কারণে তাঁর খারিজে খতিয়ান ভুল হয়েছে। এখনো তা ঠিক করতে পারেননি। ফলে জমি বিক্রি করতে পারছেন না।

রূপগঞ্জ ভূমি অফিসের অনলাইন আবেদনকারী শহীদুল ইসলাম বলেন, আগে এক শ থেকে দেড় শ অনলাইন হতো। সার্ভার সমস্যা হওয়ার পর থেকে ভোগান্তি বেড়েই চলছে। এমনও সময় যায় একটাও করা যায় না। সার্ভার ঠিক থাকলে বড়জোর ২০ থেকে ৩০টি করা যায়।

সরেজমিন নরসিংদী: নরসিংদী সদর উপজেলার মহিষাশূরা ইউনিয়নের মো. আলাউদ্দিন জানান, বাবার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সাত শতাংশ জমি সন্তানদের নামে নামজারি করতে ঘুরতে ঘুরতে হতাশ হয়েছেন। উপজেলা ভূমি অফিসের মতে, সার্ভার ডাউন থাকার কারণে অনলাইন আবেদন ব্যর্থ হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘সাত শতাংশ জমির মিউটেশন (নামজারি) করতে ইউনিয়ন ভূমি অফিসে গেছি বেশ কয়েকবার। অনলাইনে নাকি সার্ভার ডাউন থাকে। এক কাগজ পাওয়া গেলে আরেক কাগজ পাওয়া যায় না। সর্বশেষ অনেক চেষ্টার পর মামলা করেছি তিন মাস আগে। মাসে একটি করে তারিখ পড়ে। বলেছে এই মাসেই শেষ হবে। আমি অশিক্ষিত মানুষ, জমির কাগজপত্র তেমন বুঝি না। তাই মেয়ের জামাইকে নিয়ে এসেছি। সেই সব দৌড়াদৌড়ি করছে। ’

হাজিপুর ইউনিয়নের রবিন সূত্রধরও একই সমস্যার শিকার। নামজারি শেষ করতে সার্ভারের সমস্যা এবং ফাইল যাচাই-বাছাইতে বিলম্ব হচ্ছে। অনেক আবেদনকারী বারবার আবেদন জমা দিতে ব্যর্থ। কেউ টাকা কেটে নিয়েও নিশ্চিতকরণ মেসেজ পাচ্ছেন না।

খাজনা পরিশোধের জন্য অনলাইন নিবন্ধনে আবেদনকারীদের ১৫ শতাংশ বা তারও বেশিসংখ্যক মানুষ বিলম্ব বা আবেদন বাতিলের শিকার হচ্ছেন। হালনাগাদ মৌজাভিত্তিক তথ্য পেতে দেরি হওয়ায় ই-পরচা সেবাও ব্যাহত হচ্ছে। অনেক ভূমি অফিস কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই সার্ভার ডাউনের কারণে ‘স্মার্ট সেবা’ স্থগিত রাখছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

উপজেলা ভূমি অফিসের কর্মকর্তারা জানান, সেবা গ্রহীতাদের সব অভিযোগ সত্য নয়। ডিজিটালের সুবিধা মিলছে, তবে মাঝে মাঝে সমস্যা হচ্ছে। যার নিয়ন্ত্রণ তাঁদের হাতে নেই। নামজারির ফাইল সব কিছু প্রসেস হয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে আসতে বর্তমানে সর্বোচ্চ ২৮ কর্মদিবস লাগে।

সরেজমিন টাঙ্গাইল : কালিহাতী উপজেলার স্বপন চৌধুরী জরুরি প্রয়োজনে ২১ শতাংশ জমি বিক্রি করতে চেয়েও খারিজে ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন। সার্ভার বন্ধ ও আবেদন কপি হারিয়ে পড়ায় কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ বার ইউনিয়ন ও উপজেলা ভূমি অফিসে যেতে হয়েছে। অতিরিক্ত ১৫ হাজার টাকা খরচ হলেও ২০২৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি নতুন করে খারিজের জন্য আবেদন করতে সক্ষম হয়েছেন।

ইউনিয়ন ভূমি অফিসে গ্রাহকদের ভোগান্তি চরম আকারে পৌঁছেছে। সরকারি ফি ১১৭০ টাকা লাগলেও বেশির ভাগ স্থানেই এ টাকায় কাজ হয় না। অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে যার কাছে থেকে যেমন পারেন টাকা নেন।

নারান্দিয়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নাম খারিজের জন্য পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকার ওপরেও নেওয়া হয়। আবার আবেদন করে বছর ঘুরেও অনেকে পাচ্ছেন না অনুমোদন। দৌলতপুর গ্রামের কার্তিক মোদক, অনিল মোদকরা প্রত্যেকে ছয় হাজার করে টাকা দেন নাম খারিজের জন্য। পরে সাত মাস ঘুরিয়ে টাকা ফেরত দেন ইউনিয়ন ভূমি অফিসের উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা উম্মে মাসুমা দেওয়ান।

কালিহাতী উপজেলা ভূমি অফিসের পেশকার মনির হোসেন বলেন, ‘গত বছর ৫ আগস্টের পর কেন্দ্রীয়ভাবে আমাদের সার্ভারে দুই মাসের মতো কাজ করা যায়নি। পরে ঠিক হয়েছে। এখন মাঝে মধ্যে দু-এক ঘণ্টার জন্য সার্ভার ডাউন হয়।


সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ


 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।