সিলেটের ভোলাগঞ্জের সাদাপাথরে নজিরবিহীন লুটপাটের পর প্রশাসনের কঠোর অভিযানে উদ্ধার হচ্ছে লাখ লাখ ঘনফুট পাথর। যৌথবাহিনীর অভিযানে থেমে গেলেও অন্যদিকে জৈন্তাপুর, কানাইঘাটসহ সীমান্তবর্তী কোয়ারিগুলোয় প্রকাশ্যেই চলছে পাথর লুটের মহোৎসব।
জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, গত ১৩ আগস্ট থেকে যৌথবাহিনী সাদাপাথরে উদ্ধার অভিযানে নামে। ১৮ আগস্ট পর্যন্ত এ অভিযানে প্রায় সাড়ে ৬ লাখ ঘনফুট পাথর জব্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে দেড় লাখ ঘনফুট পাথর প্রতিস্থাপন করা হয়। উদ্ধারকৃত পাথরের মধ্যে ধোপাগুলের একটি ক্রাশার মিলে মাটিচাপা অবস্থায় ১১ হাজার ঘনফুট, গোয়াইনঘাটের বিন্নাকান্দি এলাকা থেকে ২ হাজার ৫০০ ঘনফুট, কোম্পানীগঞ্জ সদর ও কালাইরাগ থেকে প্রায় ৪৫ হাজার ঘনফুট এবং ধোপাগুলসহ বিভিন্ন বাড়ি থেকে আড়াই লাখ ঘনফুট পাথর উদ্ধার করা হয়।
এছাড়া ১৮ আগস্ট রাত ১১টা পর্যন্ত কোম্পানীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৮৫ হাজার ঘনফুট পাথর এবং জৈন্তাপুরের রাংপানি এলাকা থেকে ৯ হাজার ৫০০ ঘনফুট পাথর জব্দ করা হয়। পরদিন আরও ২০ হাজার ঘনফুট পাথর ও ২৮ হাজার ঘনফুট বালু জব্দ করা হয়।
যদিও ভোলাগঞ্জে যৌথবাহিনীর কঠোর নজরদারিতে লুট থেমে যায়, একই সময়ে জৈন্তাপুর উপজেলার রাংপানি পর্যটন কেন্দ্র ও কানাইঘাটের লোভাছড়ায় অব্যাহত থাকে পাথর লুটপাট। স্থানীয়দের অভিযোগ, শ্রীপুর রাংপানি নদীর অন্তত চারটি পয়েন্ট— শ্রীপুর, আদর্শগ্রাম, খড়মপুর ও বাংলাবাজার কোয়ারি থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার ঘনফুট পাথর উত্তোলন করছে চক্রগুলো।
জৈন্তাপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফারজানা আক্তার লাবনী বাংলানিউজকে বলেন, অভিযানে ৩৫ ট্রাক বালু জব্দ করে নিলামে ৯০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। এ সময় সাড়ে ৯ হাজার ঘনফুট পাথরও জব্দ করা হয়। তিনি জানান, সীমান্তবর্তী নোম্যান্স ল্যান্ড ও ভারতের ভেতর থেকেও পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে, যা যেকোনো সময় প্রাণঘাতী পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। এজন্য বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যদের কড়া নজরদারির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, কানাইঘাট উপজেলার সীমান্তবর্তী লোভা নদীতে নিলামের আড়ালে চলছে অবৈধ পাথর উত্তোলন। স্থানীয়রা জানান, সরকার ২০২০ সালে এ কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও নিলামে বিক্রি হওয়া পাথর সরানোর নামে নতুন করে নদী কেটে পাথর তোলা হচ্ছে। নদীর দুই তীরে সারি সারি বাল্কহেড, খননযন্ত্র ও ক্রাশার বসিয়ে প্রতিদিনই সহস্রাধিক শ্রমিক দিয়ে উত্তোলন করা হচ্ছে। এ কাজে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও তুলেছেন এলাকাবাসী।
কানাইঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানিয়া আক্তার বলেন, নিলামে লুন্ঠিত ৪৪ লাখ ঘনফুট পাথর কিনেছিল পিয়াস এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। তাদের সময়সীমা শেষ হয়ে গেলেও প্রতিষ্ঠানটি উচ্চ আদালতে রিট করে কিছুটা সময় বাড়ানোর চেষ্টা করেছিল। তবে মন্ত্রণালয় দ্বিতীয়বার সময় বাড়ানোর আবেদন নাকচ করে দিয়েছে। ফলে বর্তমানে আর কোনো বৈধ সুযোগ নেই। তবুও কিছু পাথর লুট হয়েছে বলে তিনি স্বীকার করেন।
প্রশাসনের তথ্যমতে, লুটপাটের ঘটনায় কোম্পানীগঞ্জ থানায় দুই হাজার অজ্ঞাত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এ মামলায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারদের মধ্যে রয়েছেন পশ্চিম ইসলামপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা আলমগীর আলম। এছাড়া কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি শাহাব উদ্দিনের পদও স্থগিত করা হয়েছে।
এদিকে, ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর লুট ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ায় সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদকে ইতিমধ্যে ওএসডি করা হয়েছে। বদলি করা হয়েছে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজিজুন্নাহারকেও।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকেই ভোলাগঞ্জের সাদাপাথরে ব্যাপক লুটপাট শুরু হয়। খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর এক সমীক্ষায় ওই এলাকায় প্রায় দেড় কোটি ঘনফুট পাথরের মজুদ ছিল বলে জানানো হয়।
স্থানীয়রা বলছেন, দিনরাত পাথর পাচারের কারণে শুধু খনিজ সম্পদই নয়, ধ্বংস হচ্ছে পর্যটনকেন্দ্রগুলোও। ভোলাগঞ্জের ঘটনার মুখে প্রশাসন দায়সারা অভিযান চালাচ্ছে বলে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
এনইউ/এমজে