সাউথ কোরিয়ার সঙ্গে ১২টি খাতে সহযোগিতা বাড়াতে চায় বাংলাদেশ। আগামী পাঁচ বছরের জন্য সিউলের সঙ্গে একটি কৌশলগত রোডম্যাপের খসড়া করতে আগ্রহী ঢাকা।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আগামী ২৬ আগস্ট সিউলে বাংলাদেশ ও সাউথ কোরিয়ার মধ্যে ফরেন অফিস কনসাল্টেশন্স (এফওসি) অনুষ্ঠিত হবে। এফওসি সামনে রেখে ঢাকায় গত ১২ আগস্ট এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সভায় সভাপতিত্ব করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (দ্বিপাক্ষিক- পূর্ব ও পশ্চিম) নজরুল ইসলাম। বৈঠকে কোরিয়া প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে ১২টি খাত চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ।
১. দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক সম্পর্ক বাড়াতে আগ্রহী বাংলাদেশ। এর মধ্যে রয়েছে উচ্চপর্যায়ে সফর, সম্ভাব্য সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি ও বিভিন্ন খাতে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই।
২. কোরিয়া প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে বাংলাদেশ বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম বাড়াতে চায়। এর মধ্যে রয়েছে— পোশাক, চামড়া, ওষুধ, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রভৃতি খাতে রপ্তানি বৈচিত্র্য ও মূল্য সংযোজন। বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল ও রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলে কোরিয়ান বিনিয়োগ উৎসাহিত করা।
দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় বাণিজ্য কাঠামোর মাধ্যমে সহযোগিতা বাড়ানো। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর মাধ্যমে কোরিয়ান বিনিয়োগ সহজতর করা।
আরও রয়েছে, দক্ষিণ কোরিয়ার ইলেকট্রনিক্স, অটোমোবাইল, সেমিকন্ডাক্টর, জাহাজ শিল্প, ইস্পাত, তেল পরিশোধনাগার প্রভৃতি ক্ষেত্রে সহযোগিতা সম্প্রসারিত করা। বাংলাদেশ থেকে পোশাক, ওষুধ, চামড়াজাত পণ্য, সিরামিক রপ্তানি বাড়ানো।
৩. শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে কোইকা ও অন্যান্য জি-টু-জি প্রোগ্রামের আওতায় শিক্ষা বিনিময় সম্প্রসারণ করা। এ ছাড়াও রয়েছে কোরিয়ান শিল্পের চাহিদা অনুযায়ী বাংলাদেশের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা উন্নয়ন ও শিল্পের সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ স্থাপন করা এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে দ্বিপাক্ষিক অংশীদারিত্ব ও স্টেম শিক্ষা আধুনিকীকরণ।
৪. শ্রম ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর লক্ষ্যে ইপিএসের (এমপ্লয়মেন্ট পারমিট সিস্টেম) মাধ্যমে নিরাপদ অভিবাসন জোরদার ও দক্ষতার স্বীকৃতি ও শ্রম গন্তব্যে দক্ষ কর্মী পাঠানো। শ্রমিকদের অধিকার ও কল্যাণে প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা করা।
৫. জ্বালানি, অবকাঠামো ও সবুজ রূপান্তরের লক্ষ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি (সূর্য, বায়ু, হাইড্রোজেন প্রভৃতি) খাতে বিনিয়োগ করা। কোরিয়ান অর্থায়ন ও কারিগরি সহায়তায় অবকাঠামো উন্নয়ন (সড়ক, রেল, বন্দর, স্মার্ট সিটি প্রভৃতি) বৃদ্ধি করা। শিল্প ও পরিবহন খাতে সবুজ রূপান্তর কৌশলে সহযোগিতা, বর্জ্য হতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। বাংলাদেশে বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া।
৬. বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খাতে সহযোগিতার লক্ষ্যে সেমিকন্ডাক্টর, এআই, বিগ ডেটা ও উদীয়মান প্রযুক্তিতে যৌথ গবেষণা ও উদ্ভাবন। কোরিয়ান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় প্রযুক্তি হস্তান্তর। এআই নীতি ও নৈতিক ব্যবহার সংক্রান্ত দক্ষতা উন্নয়ন করা।
৭. স্বাস্থ্য ও মহামারি প্রস্তুতি খাতে সহযোগিতার লক্ষ্যে ই-হেলথ, মেডিকেল প্রযুক্তি ও জনস্বাস্থ্যে সহযোগিতা বাড়ানো এবং ওষুধ শিল্পে উৎপাদন ক্ষমতা ও রপ্তানি সক্ষমতা বাড়ানো। টিকা ও জরুরি স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে কৌশলগত অংশীদারত্ব।
৮. কৃষি, প্রাণিসম্পদ ও খাদ্য নিরাপত্তা খাতে সহযোগিতার লক্ষ্যে কৃষি যন্ত্রায়ন ও আধুনিক কৃষির উন্নয়নে যৌথ উদ্যোগ নেওয়া । প্রাণিসম্পদ জেনেটিক্স, খাদ্য উৎপাদন ও রোগ নিয়ন্ত্রণে কোরিয়ান বিনিয়োগ বাড়ানো।
৯. সুনীল অর্থনীতি ও সামুদ্রিক সম্পদ খাতে সহযোগিতার লক্ষ্যে টেকসই মৎস্য, সামুদ্রিক প্রাণিসম্পদ ও সামুদ্রিক প্রযুক্তিতে যৌথ উদ্যোগ নেওয়া। উপকূল ও সামুদ্রিক দূষণ নিয়ন্ত্রণে কোরিয়ান সহায়তা নেওয়া। জাহাজ নির্মাণ ও বন্দর আধুনিকায়নে সহযোগিতা নেওয়া।
১০. প্রতিরক্ষা ও কৌশলগত সহযোগিতার লক্ষ্যে প্রতিরক্ষা সংলাপ ও প্রশিক্ষণ বিনিময় কর্মসূচি বিস্তৃতকরণ। প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয় ও প্রযুক্তি স্থানান্তর। শান্তিরক্ষা ও সামুদ্রিক নিরাপত্তা খাতে সহযোগিতা। সাউথ কোরিয়ার সঙ্গে এয়ার সার্ভিস সংক্রান্ত সম্ভাব্য সংযোগিতা বাড়ানো।
১১. রোহিঙ্গা সংকট ও প্রত্যাবাসনে কোরিয়ার সহযোগিতা নেবে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা বাড়ানো এবং আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ কোরিয়ার অব্যাহত সমর্থন দক্ষতা উন্নয়ন ও স্বেচ্ছামূলক প্রত্যাবাসনের কৌশলে কোরিয়ান সম্পৃক্ততা চায়।
১২. আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে কোরিয়া প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে চায় বাংলাদেশ।
এ লক্ষ্যে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে শান্তি ও নিরাপত্তায় কৌশলগত সহযোগিতা বাড়ানো, জলবায়ু কূটনীতি ও বৈশ্বিক ফোরামে যৌথ কার্যক্রম পরিচালনা, জলবায়ু পরিবর্তনজনিক সমস্যা মোকাবিলা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হ্রাস ও অভিযোজনে কারিগরি ও আর্থিক সহযোগিতা প্রদান, টেকসই ও জলবায়ু সহনশীল কৃষি প্রযুক্তি স্থানান্তর, শান্তিরক্ষা ও মানবিক কার্যক্রমে অংশীদারত্ব।
কৌশলগত রোডম্যাপ
কোরিয়া প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে বাংলাদেশ ২০২৫-২০৩০ সময়কালের জন্য একটি কৌশলগত রোডম্যাপ খসড়া করতে আগ্রহী। এ ছাড়া বাংলাদেশ-কোরিয়া যৌথ কমিশন বা উচ্চপর্যায়ের সংলাপের জন্য প্রস্তাবিত উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করতে চায়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ ও কোরিয়া প্রজতন্ত্রের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক একটি দীর্ঘ ও গতিশীল অংশীদারত্বের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত, যা পারস্পরিক শ্রদ্ধা, উন্নয়নের প্রতি অভিন্ন আকাঙ্ক্ষা এবং ক্রমবর্ধমান সম্পৃক্তির মাধ্যমে শক্তিশালী হয়েছে।
১৯৭৩ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা ধারাবাহিকভাবে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা, সংস্কৃতি ও মানবসম্পদ উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রসারিত হয়েছে। আগামী ২৬ আগস্ট সিউলে চতুর্থ এফওসি আয়োজনের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ ও কোরিয়া প্রজাতন্ত্রের মধ্যে অংশীদারত্ব বাড়তে পারে।
বাংলাদেশে নিযুক্ত সাউথ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত পার্ক ইয়ং সিক বলেন, ১৯৭৩ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর থেকে বাংলাদেশ ও কোরিয়া সম্পর্ক উন্নয়নে একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। সাউথ কোরিয়া বাংলাদেশের সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চায়। দুই দেশের মধ্যে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব রয়েছে, যা উন্নয়ন সহায়তার বাইরেও বিস্তৃত।
টিআর/এনডি