ঢাকা, শনিবার, ১ ভাদ্র ১৪৩২, ১৬ আগস্ট ২০২৫, ২১ সফর ১৪৪৭

জাতীয়

জুলাই-আগস্টে রায়েরবাজারে ১১৪ লাশ দাফন

নামফলকহীন কবরের পাশে আজো অশ্রু ঝরে নীরবে

জি এম মুজিবুর, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০:১৮, আগস্ট ১৬, ২০২৫
নামফলকহীন কবরের পাশে আজো অশ্রু ঝরে নীরবে জুলাই-আগস্টে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন হওয়া ব্যক্তিদের কবর। ছবি: জিএম মুজিবুর

ঢাকা: সূর্য ডুবিডুবি করছে। ঢাকার রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ সংলগ্ন কবরস্থানে তখন নেমে এসেছে ঘোর নিস্তব্ধতা।

হয়তো খানিক আগেই এই কবরের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন কেউ। জিয়ারতের জন্য এসে নীরবে ঝরিয়েছেন অশ্রুও। শুধু আপনজনকে হারিয়ে ফেলার বেদনায় নয়, তার কবরটিও চিনতে না পারার আফসোসে হয়তো ডুকরে কেঁদে উঠেছেন।

এই গোরস্থানের ৪ নম্বর ব্লকে ৩৭ নম্বর লাইনে সবচেয়ে বড় গণকবর। এখানে গত বছরের জুলাই-আগস্টে দাফন হয়েছে ১১৪টি বেওয়ারিশ লাশ। কোনোটির সামনেই মৃত ব্যক্তির নামফলক নেই। ছোট করে লেখা আছে শুধু গণনার জন্য সংখ্যা।  

পূর্বপাশে একটি নীল সাইনবোর্ডে সাদা অক্ষরে লেখা, ‘এই কবরগুলোতে যারা চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন, তাদের সবার পিতৃপরিচয় ছিল, ছিল তাদের পরিবার। কিন্তু স্বৈরাচারী সরকারের কারণে তারা আজ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হলো। তারা তো বেওয়ারিশ ছিল না!!!’

স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে চব্বিশের জুলাইয়ে যখন গণঅভ্যুত্থান ঘটে, তখন রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন স্থান থেকে এসব বেওয়ারিশ লাশ এসেছিল রায়েরবাজারে। এর মধ্যে জুলাইতে আসে ৮০টি, আর আগস্টে আসে ৩৪টি।

জনহিতৈষী সংস্থা ‘আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম’র স্বেচ্ছাসেবীরা প্রতিদিন এসব লাশ এখানে আনলে দাফন করতেন গোরস্থানটিতে দায়িত্বপ্রাপ্তরা।

ওই সময় পরিচয়হীন লাশগুলো এলে প্রথমে কোনো স্বজন খোঁজ পেতেন না। তবে পরে কেউ কেউ হাসপাতাল বা বিভিন্ন সূত্রে খবর পেয়ে এখানে এলে ভাগ্যক্রমে পেয়ে যেতেন আপনজনের নিথর দেহ। অন্তত লাশ ধরে কাঁদবারও সুযোগ হতো তাদের। কিন্তু যেসব লাশের জন্য কেউই আসতো না, তাদের শেষ ঠিকানা হয়ে যেত এই গণকবরে।

রায়েরবাজার কবরস্থানের মসজিদের ইমাম জহিরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম থেকে বেওয়ারিশ লাশ পাঠায় এখানে, তারা গোসল করিয়েই পাঠায়। আমরা এখানে শুধু জানাজা দিয়ে দাফন করি। মুখও খোলা হয় না। ’

তিনি বলেন, ‘কবর দেওয়ার সময় কোনো আপনজন থাকারও ভাগ্য হয় না এসব লাশের। এখন মাঝেমধ্যে দু-একজন এসে ওই কবরগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে দোয়া করেন। কান্নাকাটি করেন। কিন্তু তারাও জানেন না—তাদের আপনজন কোন কবরে শুয়ে আছেন। ’

আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের এক কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে বলেন, ‘গত বছর জুলাইতে ৮০টি ও আগস্টে ৩৪টি লাশ আমরা বেওয়ারিশ হিসেবে রায়েরবাজার কবরস্থানে দাফন করেছিলাম। ’

রায়েরবাজার গোরস্থানের দেখভালের দায়িত্বে থাকা মাওলানা ফেরদৌস জানান, বেওয়ারিশ লাশগুলো গোরস্থানের চার নম্বর ব্লকের ৩৭ নম্বর লাইনে দাফন করা হয়। অন্যান্য ব্লকের কবরগুলো তাদের স্বজনরা দেখাশোনা করেন। ফলে কবরের পাশে নামফলক থাকে। সেগুলোর মধ্যে স্বজনরা কেউ গাছ লাগান, কেউ দামি ঘাসও লাগান। তবে বেওয়ারিশ লাশের ক্ষেত্রে সেটি হয় না। এ ক্ষেত্রে কবরের ওপর থাকে শুধুই কালো মাটি।

রায়েরবাজার কবরস্থানের গোরখোদক ইনচার্জ মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী বাংলানিউজকে বলেন, ‘৩৭ নম্বর লাইনের কবরগুলো বেওয়ারিশ লাশের। আমার টিমকে সঙ্গে নিয়ে ওই সময় আমি নিজ হাতে দাফন করেছি। কোনো আপনজন ছিল না। এখন মাঝেমধ্যে দেখি দুই-একজন এসে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কবর জিয়ারত করেন। কান্নাকাটি করেন, দোয়া করে চলে যান। তারা ধরে নিয়েছেন—তাদের আপনজন এই বেওয়ারিশ লাশের মধ্যে হয়তো থাকতে পারে। ’

১১৪ লাশ উত্তোলনের নির্দেশ
জুলাই গণঅভ্যুত্থান যখন তীব্র আকার ধারণ করে, তা দমনে রাষ্ট্রীয় শক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে তখনকার স্বৈরাচার সরকার। জাতিসংঘের হিসাব মতে, সেসময় প্রায় ১৪শ ছাত্র-জনতা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। এর মধ্যে বেশিরভাগই পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলি এবং আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন।  

সেসময় গুলিতে বা জখম হয়ে নিহত পর ব্যক্তিদের লাশগুলো কীভাবে কোথায় যাচ্ছে বা কোথায় দাফন হচ্ছে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য সংরক্ষণ করা হয়নি পুলিশ, হাসপাতাল বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে। এমনকি কিছুক্ষেত্রে তথ্য গোপনেরও অভিযোগ ওঠে সেসময়। প্রাণহানি বা ক্ষয়ক্ষতি কম দেখাতে তাড়াহুড়ো করে লাশ নিয়ে দাফনেরও অভিযোগ মেলে কিছুক্ষেত্রে।

৫ আগস্ট হাসিনার সরকারের পতনের পর যাদের আপনজন বাড়ি ফেরেনি তারা তাদের খোঁজ করতে থাকেন। এর মধ্যে গুটিকয় পরিবার আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের দাফন করা বেওয়ারিশ লাশের নথি থেকে ছবি দেখে তাদের স্বজনদের শনাক্ত করে লাশ নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু ওই সময় দাফন করা ১১৪টি লাশই থেকে যায় বেওয়ারিশ।

অবশ্য পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৪ আগস্ট ঢাকার আদালত ১১৪ লাশ উত্তোলন করে তাদের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানের নির্দেশ দিয়েছেন।

জিএমএম/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।