ঢাকা, রবিবার, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৫ জুন ২০২৫, ১৮ জিলহজ ১৪৪৬

জাতীয়

সরকারি অর্থে হজে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মালি, চালক, গানম্যান ও পিয়ন

নির্দেশনা না মেনে সফরসঙ্গী উপদেষ্টার স্ত্রী ও দুই বোন

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০:৪৯, জুন ১৪, ২০২৫
নির্দেশনা না মেনে সফরসঙ্গী উপদেষ্টার স্ত্রী ও দুই বোন

অন্যান্য বছরের মতো এবারও হাজিদের সেবা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে পাঁচটি টিম সৌদি আরবে গেছে। এসব টিমের অধীনে ২৯৩ জন অবস্থান করছেন দেশটিতে।

এবারের হজ টিমে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মালি, গাড়িচালক, গানম্যান, অফিস সহায়ক বা পিয়ন, সচিবদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা, কম্পিউটার অপারেটর, সাঁট মুদ্রাক্ষরিক, কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারীরা যুক্ত হয়েছেন। মন্ত্রণালয় বলছে, হাজিদের সেবা দেওয়ার জন্য নীতিমালা মেনেই এসব কর্মচারীকে টিম মেম্বার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

এদিকে, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে জারি করা বিদেশ ভ্রমণসংক্রান্ত নির্দেশনা না মেনে ধর্ম উপদেষ্টার সফরসঙ্গী হয়েছেন তার স্ত্রী ও দুই বোন। এক অতিরিক্ত সচিবের সঙ্গে গেছেন তার স্ত্রী।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেসব কারণে মন্ত্রণালয়ের খরচে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হজ টিমের সদস্য করা হয়, সৌদি সরকার সে সেবাগুলো দিয়ে থাকে। এজন্য সরকার আলাদা চার্জও নেয়। এ অবস্থায় নতুন করে অপ্রয়োজনীয় লোক নেয়া অন্যায় চর্চা বলে মনে করেন তারা। তাদের মতে, হাজিদের সেবার মান ও হজ মন্ত্রণালয়ের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে এ ধরনের টিম শুধু আর্থিক বোঝাই বড় করে, সেবার মানে গুণগত কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। এখনো হজ ব্যবস্থাপনার সিংহভাগই বেসরকারি তদারকির ওপর নির্ভরশীল। তাছাড়া ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হজ টিমে যুক্ত হওয়ার জন্য সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তদবিরের বিষয় নিয়েও দীর্ঘদিনের অভিযোগের কথা জানিয়েছেন তারা।

এ বছর বাংলাদেশ থেকে ৮৭ হাজার ১০০ জন হজে গেছেন। তাদের মধ্যে সরকারিভাবে গেছেন ৫ হাজার ২০০ জন। সরকারিভাবে যারা হজে যান তাদের সেবার মান বরবারই সন্তোষজনক নয়। আবার যারা বেসরকারিভাবে হজে যান, তাদের সেবার দেখভাল সংশ্লিষ্ট এজেন্সিই করে থাকে। এ প্রসঙ্গে হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) দুজন সাবেক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ দুজন জানান, নতুন সরকারের নতুন ধর্ম উপদেষ্টার কাছে আমাদের প্রত্যাশা ছিল ভালো কিছু হবে। কিন্তু তিনি পুরনো আমলের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনারই চর্চা করে যাচ্ছেন। সরকারিভাবে হজে যাওয়ার ক্ষেত্রে হজযাত্রীরা বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হন। এজেন্সিগুলো যেভাবে হাজিদের যত্ন নেয়, ধর্ম মন্ত্রণালয় সেটা করে না। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের টিমে যারা থাকেন তারা বড় কর্মকর্তা নয়তো কর্মচারী। হাজিদের সেবা দেয়ার বিষয়ে তাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই, আন্তরিকতাও থাকে না। তারা সৌদি যাওয়া-আসাকে কেবল অফিস রুটিন হিসেবে নিয়ে থাকেন।

হাবের ওই দুই নেতা জানান, সরকারিভাবে যারা হজে যান তাদের যে গাইড থাকেন তার সঙ্গে দেখা হয় বিমানে ওঠার পর। ওই গাইড এমনও হন যে জীবনে প্রথম হজ করতে যাচ্ছেন। এছাড়া যারা সরকারি অর্থে হজে যান তাদের খাওয়া-দাওয়ার নিদারুণ কষ্ট হয়। এজেন্সির মাধ্যমে যারা হজে যান তাদের রান্নাসহ দেখভাল এজেন্সির পক্ষ থেকেই করা হয়।

হাবের ওই দুই নেতাসহ হজ এজেন্সির কয়েকজন মালিক জানান, ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে অপ্রয়োজনীয় লোকজনকে হজের বিভিন্ন কমিটিতে যুক্ত করাটা পুরোটাই সরকারি অর্থের অপচয়। এভাবে হজ কমিটির নামে মন্ত্রণালয়ের কর্মীদের ভ্রমণবিলাস বন্ধ হওয়া উচিত। এসব বিষয় নিয়ে এজেন্সির মালিকরা কথা বলতে গেলে মন্ত্রণালয় থেকে ওই এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দিয়ে থামিয়ে দেয়া হয়।

ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে ২৯৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও চিকিৎসক কয়েকটি হজ টিমের সদস্য হিসেবে সৌদি আরব গেছেন। তাদের মধ্যে হজ প্রতিনিধি-মনিটরিং দলে ৬, প্রশাসনিক টিমে ৫৮, সমন্বিত চিকিৎসক টিমে ১৬৫, কারিগরি টিমে ২০ এবং হজ সহায়তাকারী টিমে ৪৪ জন সদস্য রয়েছেন।

হজ প্রতিনিধি-মনিটরিং দলের সদস্য হিসেবে বর্তমানে সৌদি আরবে অবস্থান করছেন ছয়জন। তারা হলেন ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন, ধর্ম সচিব একেএম আফতাব হোসেন প্রামাণিক, অতিরিক্ত সচিব মো. মতিউল ইসলাম, তোফাজ্জল হোসেন, মো. ফজলুর রহমান ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক আ. ছালাম খান। এ ছয়জনের সঙ্গে সফরসঙ্গী হিসেবে আরো চারজন হজ পালনের জন্য গেছেন। তারা হলেন ধর্ম উপদেষ্টার স্ত্রী কামরুন্নেসা হাসিনা এবং উপদেষ্টার দুই বোন খন্দকার উম্মে সালমা ও আরিফা মাহবুবা। এছাড়া অতিরিক্ত সচিব ফজলুর রহমানের স্ত্রী মোরশেদা পারভীনও হজ মনিটরিং দলের সফরসঙ্গী হিসেবে যুক্ত হয়েছেন। যদিও সফরসঙ্গীরা নিজেদের অর্থে হজে গেছেন বলে জানিয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। কিন্তু গত ২৩ মার্চ প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে জারি করা বিদেশ ভ্রমণসংক্রান্ত নির্দেশনায় বলা হয়েছে, সরকারিভাবে বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের স্ত্রী/স্বামী/সন্তানদের সফরসঙ্গী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। হজ মনিটরিং দলের সফরসঙ্গী হিসেবে উপদেষ্টার স্ত্রী ও দুই বোন এবং অতিরিক্ত সচিবের স্ত্রীকে যুক্ত করা এ নির্দেশনার পরিপন্থী।

এবার ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে কারিগরি টিমে ২০ জন এবং হজ সহায়তাকারী টিমে ৪৪ জন সৌদি আরব গেছেন। যাদের বেশির ভাগই তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রণালয়ের গাড়িচালক আক্তারুজ্জামান সরকার, টিটু মিয়া ব্যাপারী, মো. বাকিউল আলম, নুর মোহাম্মদ, মো. জাহাঙ্গীর আলম, আবদুর রহিম, মো. আলমগীর হোসেন, শামীম হোসেন, মো. সালাহউদ্দিন; অফিস সহায়ক মনিরুল ইসলাম, মো. আশরাফুল ইসলাম, মো. আরমান, তানিয়া আক্তার, আনোয়ার হোসেন, মো. সোহাগ, ইমন মিয়া, সারোয়ার মাহমুদ; কম্পিউটার অপারেটর শাহাদাত হোসেন; অফিস সহকারী সুরাইয়া খাতুন; সাঁট মুদ্রাক্ষরিক মধুমালা, আমিনুল ইসলাম, ফারজানা সুলতানা, মমিনুল ইসলাম; গানম্যান সাইফুল হক, শাহ আলম; হজ অফিসের মালি বেগম সুমা আক্তার এবং জাতীয় মসজিদ বাইতুল মোকাররমের খাদেম মো. আবদুল মান্নান।

কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত সফরসঙ্গী না করার নির্দেশ থাকার পরও হজের বিভিন্ন টিমে তাদের যুক্ত করা হয়েছে। তারা হলেন মাজহারুল ইসলাম, জাফর ইকবাল, রেক্সোনা আক্তার, ইকবাল হোসেন, শরিফুল ইসলাম, ইকরামুল হক, মো. আবদুল জব্বার।

মন্ত্রণালয় থেকে গঠিত টিমের সদস্য হওয়ার জন্য এক ধরনের চেষ্টা-তদবির সবসময়ই থাকে। এখানে অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ ও ক্ষমতার অপব্যবহারও হয়ে থাকে। এর পরও যারা টিমে যুক্ত হন তাদের বিষয়টি স্বচ্ছতার সঙ্গে হওয়া প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।

তিনি বলেন, ‘সৌদি সরকারের হজের প্যাকেজের মধ্যেই হাজিদের সব ধরনের সেবা দেয়ার প্রতিশ্রুতি থাকে। তাদের চিকিৎসা, হারিয়ে গেলে ঠিকানা খুঁজে দেয়াসহ সবকিছুই সৌদি সরকারের হজের প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত থাকে। বাংলাদেশ কখনই এ সুবিধা নেয়নি। উল্টো দেশ থেকে বিশাল এক বাহিনী নিয়ে যাওয়া হয়। এক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাব, রাজনৈতিক বিবেচনা ইত্যাদি অপচর্চা আগে থেকেই চলে আসছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময় এ চর্চা বন্ধ হবে—এটাই আমাদের প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু এখন দেখছি আগে যেভাবে চলেছে এখনো সেভাবেই চলছে। বাস্তবিকই যদি মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা বা গাড়িচালক বা মালির হজ টিমে যুক্ত হওয়ার প্রয়োজন হয়, সেটা স্বচ্ছতার সঙ্গে মন্ত্রণালয়কে ব্যাখ্যা করতে হবে। প্রয়োজনে অন্য মন্ত্রণালয় থেকেও তারা লোক নিতে পারে। কিন্তু সৌদি সরকারের সেবা গ্রহণ করলে তো এটা প্রয়োজন ছিল না। অতীতের অপচর্চা অব্যাহত রয়েছে, সে জন্যই সরকারি টাকায় মন্ত্রণালয়ের বিশাল বহর হজ টিমে যুক্ত হয়েছে বলে মনে করি। ’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেন, ‘কারিগরি ও প্রশাসনিক সহায়তাকারী দলে এ শ্রেণীর কর্মচারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কম্পিউটারের জ্ঞান আছে এমন কম্পিউটার অপারেটরদের/সাঁট মুদ্রাক্ষরিকদের আইটি দলে এবং বাকিদের প্রশাসনিক সহায়তা দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে। হজ মৌসুমে মক্কা, মদিনা ও জেদ্দায় তিনটি অফিস চালু করার প্রয়োজন হয়। এখানে কম্পিউটার অপারেটর, অফিস সহকারী ও অফিস সহায়ক প্রয়োজন। সরকারি হাজিরা যেসব হোটেলে অবস্থান করেন, সেখানে সকাল ৭টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত দুই শিফটে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমন্বয়ে তিন-চারজনকে দায়িত্বে রাখা হয়। হাজিদের রুমের কোনো সমস্যা বা প্রয়োজন, তাদের মেডিকেল সেন্টারে পৌঁছে দেয়া, হারানো হাজিকে খুঁজে বের করা, অসুস্থ হাজির হজ পালনে সহায়তা প্রভৃতি কাজের দায়িত্ব এ শ্রেণীর কর্মচারীরা পালন করে থাকেন। ’

ধর্ম উপদেষ্টা আরো বলেন, ‘‌হাজিদের লাগেজ হারিয়ে গেলে তা খুঁজে বের করে হোটেলে পৌঁছে দেওয়া, কোনো হাজি অসুস্থ হলে তাকে মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যাওয়া, পথ হারিয়ে ফেললে তাকে সংশ্লিষ্ট হোটেলে পৌঁছার ব্যবস্থা করা, কেউ মারা গেলে তার দাফনসহ অন্যান্য বিষয় তদারকি করা, বেসরকারি এজেন্সির হাজিদের আবাসন ও অন্যান্য বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া, কোনো হাজি যদি কোনো অভিযোগ করেন সেটা খতিয়ে দেখা, কোনো হাজি কখন মিনা-আরাফা-মুজদালিফায় যাবেন, কখন মদিনায় জিয়ারায় যাবেন, কখন দেশে ফিরবেন সেটা দেখভাল করার কাজ প্রশাসনিক দল ও প্রশাসনিক সহায়তাকারী দল করে থাকে। সুষ্ঠু ও সাবলীল হজ ব্যবস্থাপনার জন্য এসব দলের প্রয়োজন রয়েছে। গত বছর বিভিন্ন দলের সদস্য ছিল ৩৬৬ জন। এ বছর সেটা ২৯৩ জনে নামিয়ে আনা হয়েছে। ’

সূত্র: বণিক বার্তা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।