শত শত গরিব মানুষের জমি দখল করতে করতে আকার বড় করছিলেন নিজ রাজ্যের। রাজ্য বড় করতে দখল করেছিলেন নদী।
গত আওয়ামী লীগ আমলে টানা ১৫ বছর কেরানীগঞ্জ নিয়ন্ত্রণ করেছেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী থেকেই। সন্ত্রাসী, লাঠিয়াল, মাদকাসক্তদের দিয়ে বিভিন্ন চক্র তৈরি করে দখল করে নিয়েছিলেন আর রাজ্যের পরিধি বাড়াচ্ছিলেন। লোকে জানত বিপু শীর্ষ ভূমিদস্যু। তারা ভয়ে মুখ খুলত না।
ভূমি নিবন্ধন বন্ধ রেখে জমি কেড়ে নিতেন বিপু। স্থানীয় সূত্র জানায়, জমি দখলে ক্যাডারদের পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন বিপুর ঘনিষ্ঠ ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ নেতা জসিম মাহমুদ, হাজি ফিরোজ আলমের মেয়েরজামাই নজরুল ইসলাম নজু ও হামিদুর রহমান হামিদ। বিপুর নিষেধে টানা ১০ বছর শুধু রাজেন্দ্রপুর রেজিস্ট্রি অফিসে জমি নিবন্ধন করতে পারেননি সাধারণ মানুষ।
ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট মৌজাগুলোর ভূমি নিবন্ধন করতে গেলেই সরকারি কর্মকর্তারা লোকজনকে ফিরিয়ে দিতেন। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এর আগ পর্যন্ত টানা চারবার এমপি ছিলেন বিপু। বৈধ-অবৈধ উপায়ে কামিয়েছেন বিপুল অর্থ। তাঁর ওপর কেরানীগঞ্জে রাজ্য বাড়াতে তাঁর নজর ছিল বেশি।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে বিপুর প্রিয় প্রাঙ্গণ হাউজিংয়ে জমির মূল মালিকরা হামলা চালান। এ ছাড়া ভাঙচুর করেন খামারবাড়ি, বাগানবাড়ি, বাংলোবাড়িতে। নিপীড়িত মানুষের ক্ষোভের চিহ্ন এখনো সেসব স্থানে রয়ে গেছে।
গত ২৬ এপ্রিল রাজেন্দ্রপুরে প্রিয় প্রাঙ্গণ আবাসিক প্রকল্প-১ এলাকায় গেলে নিরাপত্তাকর্মী পাণ্ডব সরকার জানান, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অনেকে নিজের জায়গা নির্ধারণ করে সাইনবোর্ড টানিয়েছেন। প্রকল্প দেখভাল করেন ‘লিংকন’ নামের একজন। জানা গেল, কমপক্ষে আট মামলার আসামি এই লিংকন।
প্রকল্পের প্রকৌশলী নুর মোহাম্মদ জানান, গত ৫ আগস্টের পর বহু লোক হাউজিংয়ের ভেতর ঢুকে ভাঙচুর চালিয়েছে। বলেন, ‘আমরা কারোর জমি জোর করে নেইনি। তবে দু-একটা জমির দলিল করা হয়নি।
শুভাঢ্যা সাবান ফ্যাক্টরি এলাকার ভুক্তভোগী বলেন, ‘বিপু আবাসন প্রকল্প করার আগেই সাত শতাংশ জমি কিনেছিলাম। বিদেশ থেকে ফিরে এসে দেখি, বিপুর লোকজন বালু দিয়ে আমার জমি ভরাট করেছে। কাগজপত্র নিয়ে প্রকল্প ব্যবস্থাপক ভূমিদস্যু জসিম মাহমুদের কাছে গিয়েছিলাম। কাগজপত্র দেখছে বলে চার বছর পার করেছে। জমি ফিরে পাইনি। এভাবে শত শত মানুষের জমি নিজের করে নিয়েছে বিপু। ’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘আমরা এখন সরকারের কাছে বিচার চাইছি। বাঘৈরের ওয়াসিম বলেন, বিপুর হাউজিংয়ে আমার পৈতৃক জমি ঢুকিয়ে দিয়েছিল। তা বিক্রি করে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে দেখি জমির রেজিস্ট্রি বন্ধ। আমার জমির দাম ছিল দুই কোটি টাকা। পরে আমি বাধ্য হয়ে মেয়ের বিয়ের জন্য সেই জমি খুব কম দামে দলিল করে দিই। ’
তিনি জানান, প্রিয় প্রাঙ্গণ আবাসন প্রকল্পে এলাকার কেউই স্বেচ্ছায় জমি বিক্রি করেননি। তাদের বিক্রি করতে বাধ্য করা হয়েছিল।
রাজেন্দ্রপুর সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে বাঘৈর মৌজার যেসব দাগ ও খতিয়ান ‘প্রিয় প্রাঙ্গণ’-এর আশপাশে রয়েছে সেগুলোর কেনাবেচা ক্ষমতার জোরে বন্ধ করে রেখেছিলেন বিপু। শুধু ‘প্রিয় প্রাঙ্গণে’ ‘বিক্রি’ করলেই দলিল রেজিস্ট্রি করা যেত। নামমাত্র দামে কিনে কয়েক গুণ চড়া দামে জমি বিক্রি করতেন শুধু বিপু। জমি বিক্রি করতে রাজি না হলে তাতে বালু ভরাট করে দিত বিপুর সন্ত্রাসীরা।
বাঘৈরের সুবল সরকার বলেন, প্রিয় প্রাঙ্গণ হাউজিংয়ে জমি দখলের দায়িত্ব ছিল ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ নেতা জসিম মাহমুদ, হাজি ফিরোজ আলমের মেয়েরজামাই নজরুল ইসলাম নজু ও হামিদুর রহমান হামিদের।
কেরানীগঞ্জের ভাওয়াভিটিতে প্রিয় প্রাঙ্গণ-২ প্রকল্প। সেখানেও ক্ষুব্ধ এলাকাবাসীর ভাঙচুরের চিহ্ন চোখে পড়ে। ভাওয়াভিটির গাজী মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, প্রিয় প্রঙ্গণ-২ হাউজিং প্রকল্পে ৫০ বিঘা জমি নামমাত্র দামে কিনে আরো ২০০ বিঘা জবরদখল করে ভরাট করেছে বিপু বাহিনী।
এখন অবশ্য এখানে মূল মালিকরা যার যার জমি বুঝে নিচ্ছেন। ভাওয়াভিটির তোতা মিয়ার ২৬ শতাংশ জমি ছিল বিপুর এই হাউজিংয়ের অফিসের পাশে। সেখানে তোতার কলাবাগান ছিল। স্থানীয় এরশাদ ও রিয়াজুলের মাধ্যমে নিপীড়ন চালিয়ে সেই জমি দখল করেছিলেন বিপু।
মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, হাউজিংটি চরগোলগোলিয়া মৌজায়। মৌজায় আমার বাবার ২১ শতাংশ জমি ছিল। বাবার মৃত্যুর পর ভাই-বোনের নামে নামজারি করতে গেলে বিপু বাহিনী বাধা দিয়ে নামজারি বন্ধ রাখে। তারা আমাদের জমিতে বালু ভরাট করে। জমির দাবি জানালে তারা আমাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলহাজতে পাঠানোর ভয় দেখায়। পরে বিপু বাহিনী আমাদের নামে নামজারি ছাড়া জমির দলিল করে নেয়। আমাদের সেই জমির দাম ছিল তিন কোটি টাকা। তারা দিয়েছে ৪৬ লাখ টাকা।
এদিকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউক জানায়, বিপু গণপূর্ত ও গৃহসংস্থান বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও রিহ্যাব সভাপতি থাকাকালে ঝিলমিলের দ্বিতীয় পর্বের শত শত একর জমি দখল করে প্রিয় প্রাঙ্গণ প্রকল্পে তা যুক্ত করেন। এ জন্য ঝিলমিল প্রকল্পের নীতিমালা মন্ত্রণালয়ে আটকে রাখেন নিজের প্রভাবে। ঝিলমিল প্রকল্পের প্রথম পর্বের আবেদন সময়মতো আহবান করা যায়নি। একই সঙ্গে প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্ব নিয়েও দেখা দেয় অনিশ্চয়তা। ঝিলমিল প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্বের প্রস্তাবও মন্ত্রণালয়ে আটকে রাখেন বিপু।
পানগাঁওয়ের খামারবাড়িতে গেলে আব্দুর রহমান বলেন, প্রায় পাঁচ হাজার শতাংশ জমিতে বিপু খামার করেছেন। এখানেও বেশির ভাগ জমি জোর করে দখল করে বিপু বাহিনী। আগে সেখানে ইটভাটা ও বিভিন্ন ডকইয়ার্ড ছিল। কারোর পাঁচ লাখ টাকার জমি ৬০-৭০ হাজার টাকা দিয়ে জোরপূর্বক দলিল করে নিয়েছে বিপুর লোকজন।
ব্রাহ্মণগাঁওয়ের পীযূষ কর্মকার জানান, ব্রাহ্মণগাঁওয়ে বিপুর কিছু পৈতৃক সম্পত্তি আছে। কিছু মালিকানা জমি কিনে নিয়েছে। অনেকে টাকা পেয়েছে, অনেকে পায়নি। বুড়িগঙ্গা নদীর কাটুয়াইলে বিআইডব্লিউটিএর পিলার ভেঙে নদীর জমিও দখল করেছেন।
সুরুজ মিয়া বলেন, সোনাকান্দায় ধলেশ্বরী নদীর অনেক জায়গা ও সাধারণ মানুষের জায়গা নামমাত্র দাম ও জোরপূর্বক দখল করে নেয় বিপু বাহিনী।
জানতে চাইলে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের সাবরেজিস্ট্রার ইমরুল খোরশেদ বলেন, আমি এখানে আসার পর কোনো মৌজার জায়গা রেজিস্ট্রি বন্ধ ছিল না। আমার এখানে যে দলিল এসেছে আমি সেগুলো রেজিস্ট্রি করে দিয়েছি। তার আগের অবস্থা আমি জানি না।
উল্লেখ্য, বহু মামলার আসামি বিপু পালিয়ে রয়েছেন। তিনি ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ছাড়া কারোর ফোন ধরেন না বলে জানা গেছে। এ কারণে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন