ঢাকা: ‘বাবাকে ছাড়া আর থাকতে পারছি না। ৫ আগস্টের পর আমাদের এভাবে দাঁড়ানোর কথা ছিল না।
রোববার (২০ এপ্রিল) সকালে রাজধানীর হাইকোর্টের মাজার গেইটের সামনে ‘মায়ের ডাক’ নামে একটি সংগঠন আয়োজিত অবস্থান কর্মসূচিতে কাঁদতে কাঁদতে এসব কথা বলছিল গুমের শিকার বংশাল থানা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক পারভেজ হোসেনের মেয়ে আদিবা ইসলাম হৃদি।
২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর রাজধানীর শাহবাগ থেকে যখন পারভেজ হোসেন নিখোঁজ হন, তখন তার মেয়ে হৃদির বয়স ছিল মাত্র দুই বছর। ছোট্ট সেই শিশুর বয়স এখন প্রায় ১৪ বছর। কিন্তু এখনো বাবাকে খুঁজে পায়নি সে। পায়নি বিচারও। তাইতো গুম সংক্রান্ত কোনো অনুষ্ঠান হলেই বাবার ছবি হাতে সেখানে ছুটে যায় হৃদি।
অবস্থান কর্মসূচিতে হৃদি বলছিল, ‘আমরা বিচার চাই। আমার ভাইটা তো বাবাকে দেখেইনি। আমি শুধু আমার বাবাকে ফেরত চাই। ’
‘বলপূর্বক গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন বাহিনীর অভিযুক্ত কর্মকর্তা এবং ফ্যাসিস্ট আওয়ামী খুনিদের গ্রেপ্তার ও বিচারের’ দাবিতে এই অবস্থান কর্মসূচির আয়োজন করে ‘মায়ের ডাক’। অবস্থান কর্মসূচিতে গুম-খুনের শিকার ব্যক্তিদের পরিবার ও গুম থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
এমনই একজন লক্ষ্মীপুরে গুমের শিকার ওমর ফারুকের ছেলে ইমন। তিনি বলেন, ২০১৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে আমার বাবাকে র্যাব তুলে নিয়ে যায়। অন্তর্বর্তী সরকার আট মাস অতিবাহিত করলেও আমাদের স্বজনদের সন্ধান দিতে পারেনি। আমাদের একটাই দাবি, যেসব কর্মকর্তারা গুম-খুনের অপরাধে অভিযুক্ত, তাদের দ্রুত অপসারণ করতে হবে। যদি তাদের চাকরিচ্যুত করা না হয়, তাহলে আমরা নিরাপদ নই, আমাদের পরিবার নিরাপদ নয়। আমরা চাই যেসব কর্মকর্তারা গুম-খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত তাদের আইনের আওতায় আনা হোক। তাদের বিচার করা হোক। বিচারের সময় এখনই।
২০১৩ সালের ডিসেম্বরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয় বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনকে। এরপর থেকে আর তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তার বোন আফরোজা ইসলাম আঁখি বলেন, গত ১৩ বছর ধরে আমরা রাস্তায় আছি। কিন্তু খুবই বিস্ময় ও আশ্চর্যের ব্যাপার আজকেও আমাদের দাবি আদায়ে রাস্তায় দাঁড়াতে হচ্ছে। এর থেকে লজ্জার কথা আর কিছু হতে পারে না।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না নিজেও গুমের শিকার হয়েছেন বলে জানান। তিনি বলেন, আমাদের দাবি একটাই; এতদিন ধরে হওয়া অত্যাচার, নির্যাতনের বিচার যেনো আমরা পাই। যদি এসব অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতনের বিহিত না হয়, তাহলে দেশে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা হবে না, একটি সুন্দর দেশ হবে না, যে নতুন বাংলাদেশ গড়তে চাইছি, সেই বাংলাদেশ গড়ে উঠবে না।
শুধু গুম-খুনের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারই নয়, ‘মায়ের ডাক’র এই অবস্থান কর্মসূচিতে সংহতি জানাতে আসেন বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মী ও সংগঠনের সদস্যরাও।
বাংলাদেশে যেসব গুম, খুন হয়েছে, সেগুলো ভারতের নির্দেশনায় হয়েছে অভিযোগ করে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান বলেন, ভিন্নমতকে দমন ও হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার সব চেষ্টা ভারত করেছে। সেই চেষ্টার অংশ হিসেবে প্রতিবাদী, বিপ্লবীদের গুম, খুন করা হয়েছে। কাউকে কাউকে দুই-তিন বছর গুম রেখে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে আয়নাঘর ছিল। সেনাবাহিনী কি সেটা জানতো না? আমরা সেনাবাহিনী, ডিজিএফআইয়ের সেসব সদস্যের বিচার চাই, যারা গুম ও খুনের সঙ্গে জড়িত ছিল। পুলিশের যারা গুম, খুন করেছে, তাদের গ্রেপ্তার করে বিচার করতে হবে। বিচার নিয়ে টালবাহানা আমরা মানবো না।
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার শাহাদাৎ টুটুল বলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ফিরিয়ে আনতে হলে গুম-খুনের সঙ্গে জড়িত সব ব্যক্তিকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। প্রশাসনের যারা এসবের সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে নিক্ষেপ করতে হবে। আমরা প্রশাসনকে বলবো, বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মানুষের ভালোবাসা নিয়ে টিকে থাকতে চায়। সন্ত্রাস গুম, খুন, ভারতের তাঁবেদারি নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ বাঁচবে না। বাংলাদেশের মানুষ বাঁচবে শুধু নিজের স্বাধীনতা
নিয়ে, নিজের মতামতের ভিত্তিতে।
‘মায়ের ডাক’র সমন্বয়কারী সানজিদা ইসলাম তুলি বলেন, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে হাজারো ভাইয়ের গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হওয়ার পেছনে অনেক ম্যাকানিজম ছিল, অনেক বড় একটি হাত ছিল, অনেক মানুষের সম্পৃক্ততা ছিল। বিভিন্ন বাহিনীর কর্মকর্তারা অভিযুক্ত ছিলেন। আজকে অর্ন্তবর্তী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের আট মাস পরেও অভিযুক্ত কয়জনকে গ্রেপ্তার হতে দেখেছেন? যুদ্ধ যদি চব্বিশে একবার হয়, যুদ্ধ প্রয়োজনে আরেকবার হবে। যারাই গুম-খুনের সঙ্গে জড়িত ছিল, যতজনই ছিল তাদের প্রত্যেককে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
‘মায়ের ডাক’র আরেক সমন্বয়ক মো. মজুর হোসেন ঈসার সঞ্চালনায় অবস্থান কর্মসূচিতে আরও বক্তব্য রাখেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি ইব্রাহিম কবির মিঠু, হিউম্যান রাইটস সোসাইটির সদস্য সাইফুল ইসলাম, জাতীয় মানবাধিকার উন্নয়ন কেন্দ্রের মহাসচিব মাহবুব প্রমুখ।
অবস্থান কর্মসূচি শেষে হাইকোর্টের মাজার গেইটে চিফ প্রসিকিউটরের প্রতিনিধিদের হাতে তিন দফা দাবির স্মারকলিপি তুলে দেয় ‘মায়ের ডাক’।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০২৫
এসসি/এইচএ/