ঢাকা, বুধবার, ১৮ ভাদ্র ১৪৩২, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

আইন ও আদালত

জুলাই হত্যাকাণ্ড: দায় স্বীকার করে যা বললেন সাবেক আইজিপি মামুন

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:৩৮, সেপ্টেম্বর ২, ২০২৫
জুলাই হত্যাকাণ্ড: দায় স্বীকার করে যা বললেন সাবেক আইজিপি মামুন

জুলাই-আগস্টের আন্দোলন দমনে পরিকল্পনা ও নৃশংসতাসহ বিগত বছরগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন বেআইনি কর্মকাণ্ড এবং নির্বাচনে জালিয়াতির বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া জবানবন্দিতে তুলে ধরেছেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। যিনি আসামি থেকে এখন রাজসাক্ষী (অ্যাপ্রুভার) হয়েছেন।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রসিকিউশনের ৩৬তম সাক্ষী হিসেবে মঙ্গলবার (০২ সেপ্টেম্বর) তিনি বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১-এ জবানবন্দি দেন।

আদালতে প্রসিকিউশনের পক্ষে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম, গাজী এমএইচ তামীম, বিএম সুলতান মাহমুদ, তারেক আবদুল্লাহ, আবদুস সাত্তার পালোয়ান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

পরে সাবেক আইজিপি মামুনকে জেরা শুরু করেন পলাতক আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। তার এই জেরা অব্যাহত রয়েছে।

পুলিশে রাজনৈতিক মেরুকরণ

পুলিশ বাহিনীতে ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক মেরুকরণের বর্ণনা দিয়ে জবানবন্দিতে চৌধুরী মামুন বলেন, ‘২০১৪ সালের নির্বাচনের পর (জাতীয় নির্বাচন) বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক মেরুকরণ ও গোপালগঞ্জ কেন্দ্রীক বিভিন্ন বলয় তৈরি হয়। রাজনৈতিক বিষয় ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা জড়িয়ে পরেন। সিনিয়র অফিসার হিসেবে আমার মতো পুলিশ কর্মকর্তাদের বাহিনীকে কন্ট্রোল করার সুযোগ সীমিত ছিল। রাজনৈতিক যোগাযোগ থাকায় বিতর্কিত পুলিশ অফিসারগণ স্বাভাবকি আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যাপক তৎপর ছিল। ’

২০১৮ সালের নির্বাচনে রাতের ভোট

২০১৮ সালের নির্বাচনের রাতে ভোটের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘গত ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় আমি ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হিসেবে কর্মরত ছিলাম। তৎকালীন আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী রাতের বেলায় ব্যালট বক্সে প্রায় ৫০ শতাংশ ব্যালট রাখার পরামর্শ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেন মর্মে শুনেছি। মাঠ পর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে রাতে ব্যালট বক্স ভরে রাখার নির্দেশনা প্রদান করা হয়। ’ 

পুলিশে মনিরুল-হাবিব দ্বন্দ্ব

জবানবন্দিতে চৌধুরী মামুন বলেন, ‘২০১৮ সালের নির্বাচনের পর পুলিশ বাহিনীতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও প্রভাব বেশি বৃদ্ধি পায়। কতিপয় পুলিশ অফিসার প্রভাবশালী পুলিশ অফিসার হিসেবে স্বীকৃতি পান। তাদেরকে নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তারাও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখতেন না। তিনি আরও বলেন, পুলিশের মধ্যে অতিরিক্ত আইজি এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম ও ডিএমপির কমিশনার হাবিবের মধ্যে দ্বন্দ ছিল। তারা আলাদাভাবে তাদের লোকজনকে মেনটেইন করতেন। পুলিশ বাহিনীর ইমেজ রক্ষা ও নেতৃত্বের দ্বন্দকে প্রশমিত করার লক্ষ্যে আমাকে আইজপি হিসেবে নিয়োগ ও পরবর্তী দুই বার চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ করা হয়। ’

গোপন বন্দিশালা

টিএফআই সেলের বিষয়ে জবানবন্দিতে সাবেক আইজিপি বলেন, ‘২০২০ সালের ২৪ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমি র‌্যাবের মহাপরিচালক ছিলাম। র‌্যাবের মহাপরিচালক হওয়ার কারণে আমি জানি টিএফআই সেল র‌্যাবের সদর দফতরের অধীনে পরিচালিত হতো। এ ছাড়াও র‌্যাবের বিভিন্ন ইউনিটগুলোর অধীনে আলাদা আলাদা সেল ও বন্দিশালা ছিল। ওইগুলো সংশ্লিষ্ট ইউনিট প্রধানদের অধীনে পরিচালিত হতো। র‌্যাব কর্তৃক রাজনৈতিক ভিন্নমত মতালম্বী এবং সরকারের জন্য হুমকি হয়ে ওঠা কোনো ব্যক্তিকে তুলে আনা, জিজ্ঞাসাবাদ, নির্যাতন এবং গোপন বন্দিশালায় আটক রাখার বিষয়টি র‌্যাবের ভেতরে একটি কালচার হিসেবে বিবেচিত হতো। তবে এই কাজগুলো প্রধানত র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবস) এবং র‌্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালকরা সমন্বয় করতেন। ’

তিনি বলেন, ‘র‌্যাব কর্তৃক কোনো ব্যক্তিকে উঠিয়ে আনার বা গুম করার নির্দেশনা বা ক্রসফায়ারে হত্যার করার মতো সিরিয়াস নির্দেশনাগুলো সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে আসতো বলে শুনেছি। আমার সময়ে আমি এই ধরনের আদেশ পাইনি। কিছু কিছু নির্দেশনা নিরাপত্তা ও সামরিক উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকীর পক্ষ থেকে আসতো বলে জানতে পেরেছি। র‌্যাব যদিও পুলিশের আইজিপির অধীনে ছিল কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চেইন অব কমান্ড মানা হতো না। আমি যতদিন র‌্যাব মহাপরিচালক ছিলাম, চেষ্টা করেছি সিরিয়াস বিষয়গুলো আইজিপিকে অবহিত করতে। ’

ব্যারিস্টার আরমানের বন্দি থাকার বিষয়ে জানতাম

জবানবন্দিতে সাবেক আইজিপি বলেন, ‘টিএফআই সেলে কতজন বন্দি আসতো বা কারাবন্দি আছে এসব বিষয়ে আমাকে জানানো হতো না। এ বিষয়গুলো র‌্যাবের ডিরেক্টর (ইন্টেল) দেখভাল করতেন। ব্যারিস্টার আরমান (জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলীর ছেলে) টিএফআই সেলে বন্দি আছেন, সে বিষয়টি আমি জানতাম। তবে তাকে আমার সময় তুলে আনা হয়নি। অনেক আগে তুলে আনা হয়। আমার পূর্ববর্তী ডিজি বেনজীর আহমেদ দায়িত্ব হস্তান্তরকালে ব্যারিস্টার আরমান যে টিএফআই সেলে আটক আছেন, তা আমাকে অবহিত করেন। ’

জুলাই আন্দোলন দমনে কোর কমিটি

গত বছর জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের বিষয়ে চৌধুরী মামুন বলেন, ‘জুলাই আন্দোলন শুরু হওয়ার পর দেশব্যাপী সেনা মোতায়েন হয়। এরপর ১৯ জুলাই থেকে প্রায় প্রতি রাতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ধানমন্ডির সরকারি বাসায় কোর কমিটির মিটিং হতো। সেখানে আন্দোলন দমনের বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ জানানো হতো এবং নির্দেশনা দেওয়া হতো। কোর কমিটির সদস্য হিসেবে আমি ছাড়াও সচিব, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান ও গোয়ন্দা সংস্থার প্রধানরা উপস্থিত থাকতেন। ’

হারুণকে জিন বলে ডাকতেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

ডিজিএফআই সমন্বয়কদের আটকের প্রস্তাব দেয় জানিয়ে চৌধুরী মামুন বলেন, ‘কোর কমিটির একটি বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের আটক করার সিদ্ধান্ত হয়। ডিজিএফআই এই প্রস্তাব দেয়। আমি বিরোধিতা করেছিলাম। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নির্দেশ দিলে আমি রাজি হই। ডিবিপ্রধান হারুন অর রশিদকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়। ডিজিএফআই এবং ডিবি যৌথভাবে তাদের আটক করে ডিবিতে নিয়ে আসে। ডিবি হেফাজতে নিয়ে আন্দোলনের বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আপস করার বিষয়ে চাপ দেওয়া হয়। তাদের আত্মীয় স্বজনদেরও ডিবিতে নিয়ে আসা হয়। আন্দোলন প্রত্যাহার করে টেলিভিশনে বিবৃতি দিতেও সমন্বয়কদের বাধ্য করা হয়। এ বিষয়ে ডিবিপ্রধান হারুন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ডিবিপ্রধান হারুনকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জিন বলে ডাকতেন। কারণ হারুন সরকারের নির্দেশনা পালনে পারদর্শী ছিলেন। ’

মারণাস্ত্রের ব্যবহারে অতি উৎসাহী ছিলেন হাবিব-হারুণ

আন্দোলনে হেলিকপ্টার ও ড্রোন ব্যবহারের বিষয়ে জবানবন্দিতে সাবেক আইজিপি বলেন, ‘আন্দোলনের এক পর্যায়ে হেলিকপ্টার এবং ড্রোন ব্যবহারের মাধ্যমে নজরদারি এবং গুলি করে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করা হয়। হেলিকপ্টার ও ড্রোন ব্যবহার ছিল সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এই পরামর্শ দিয়েছিলেন র‌্যাবের তৎকালীন ডিজি ব্যারিস্টার হারুন অর রশিদ। পরবর্তীতে আন্দোলন দমনে সরকার লেথাল উইপেন (মারণাস্ত্র) ব্যবহার করে এবং আন্দোলন প্রবণ এলাকাগুলো ভাগ করে ব্লক রেইড করার সিদ্ধান্ত হয়। ’

তিনি বলেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামাসন খান কামাল আমাকে ফোন করে জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলন দমনে লেথাল উইপেন ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। যখন ফোন করেছিলেন, আমি তখন পুলিশ হেডকোয়াটর্সে আমার অফিসে ছিলাম। আমার সামনে তখন অতিরিক্ত আইজিপি প্রলয় জোয়াদ্দার উপস্থিত ছিলেন। আমি প্রলয় জোয়াদ্দারকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা জানালে সে রুম থেকে বের হয়ে ডিএমপিসহ সারা দেশে এই নির্দেশনা পৌঁছে দেয়। ১৮ জুলাই এই নির্দেশনা দেওয়ার পর থেকেই লেথাল উইপেন ব্যবহার শুরু হয়। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান হাবিব তার অধীনস্থ কর্মকর্তাদের লেথাল উইপেন ব্যবহারের নির্দেশনা দেন। লেথাল উইপেন ব্যবহারের বিষয়ে অতি উৎসাহী ছিলেন ডিএমপি কমিশনার হাবিব ও ডিবিপ্রধান হারুন। ’

আন্দোলন দমনে যারা প্ররোচিত করেছেন

সাবেক আইজিপি বলেন, ‘সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপস, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, জাহাঙ্গীর কবির নানাক, সাবেক তথ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত, মির্জা আজম, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, প্রধানমন্ত্রীকে মারণাস্ত্র ব্যবহারে প্ররোচিত করেন। ড্রোন, হেলিকপ্টার, লেথাল উইপেন ব্যবহার করে অসংখ্য ছাত্র-জনতাকে আহত ও নিহত করা হয়। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ক্যাডার বাহিনী ছাড়াও সরকারকে আন্দোলন দমনে উৎসাহিত করে আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিককর্মীরা।  

৪ আগস্ট যা ঘটেছিল

জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘আগস্ট মাসের ৪ তারিখে সকাল ১১টার দিকে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নিরাপত্তা সমন্বয় কমিটির বৈঠক হয়। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিন বাহিনী প্রধান, এসবি প্রধান, ডিজিএফআই প্রধান ও এনএসআই প্রধানসহ ২৭ জন উপস্থিত ছিলেন। এই বৈঠকে আন্দোলন দমন ও নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পরিস্থিতি বিষয়ে রিপোর্ট পেশ করছিলেন। ইতিমধ্যে চারদিকে পরিবেশ পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি হওয়ার খবর আসলে বৈঠকটি মুলতবি করা হয়। ’

সাবেক আইজিপি আরও বলেন, ‘ওই দিন রাতে আবার গণভবনে আমাদের ডাকা হয়। সেখানে আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিন বাহিনী প্রধান, র‌্যাবের ডিজি এবং লে. জেনারেল মুজিব উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার বোন শেখ রেহানা উপস্থিত ছিলেন। ডিজিএফআই প্রধান ও এসবি প্রধান বাইরে অপেক্ষমান ছিল। ওই বৈঠকে ৫ আগস্ট মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ঠেকানোর পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় পুলিশ ও সেনাবাহিনী যৌথভাবে দায়িত্ব পালন করবে। পরে আমরা আর্মি অপারেশন কন্ট্রোল রুমে যাই। আর্মি অপারেশন কন্ট্রোল রুমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, তিন বাহিনী প্রধান উপস্থিত ছিলেন। সেখানে ঢাকা শহরের প্রবেশমুখ গুলোতে ফোর্স মোতায়েন করে কঠোর অবস্থান নেওয়ার। সিদ্ধান্ত হয় মিটিং শেষে আমরা আর্মি অপারেশন কন্ট্রোল রুম থেকে চলে আসি। ’

৫ আগস্টে যা ঘটেছিল

৫ আগস্টের বর্ণনা দিয়ে চৌধুরী মামুন বলেন, ‘সকাল থেকে আমি পুলিশে হেড কোয়াটার্সে আমার দফতরে অবস্থান করছিলাম। ইতিমধ্যে উত্তরা-যাত্রাবাড়ী এবং বিভিন্ন পথ দিয়ে স্রোতের মতো ছাত্র-জনতা ঢাকা শহরে প্রবেশ করতে শুরু করে। দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ১টার দিকে খবর পাই প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন। ক্ষমতা ছেড়ে তিনি কোথায় যাবেন, সে বিষয়ে আমরা জানতাম না। এরপর বিকেলে আর্মি হেলিকপ্টার এসে আমাদের পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে প্রথমে তেজগাঁও বিমানবন্দরের হেলিপ্যাডে এবং পরে সেখান থেকে ক্যান্টনমেন্টের অফিসার্স মেসে নিয়ে যায়। হেলিকপ্টারে আমার সঙ্গে এসবি প্রধান মনিরুল, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান হাবিব এবং ডিআইজি আমেনা ছিলেন। পরের শিফটে অতিরিক্ত আইজিপি প্রলয়, লুৎফুল কবিরসহ অন্যান্যদের উদ্ধার করে সেখানে নিয়ে আসা হয়। ’

তিনি বলেন, ‘৬ আগস্ট আইজিপি হিসেবে আমার নিয়োগ চুক্তি বাতিল করা হয় এবং ক্যান্টনমেন্টে থাকা অবস্থায় ৩ সেপ্টেম্বর আমি গ্রেপ্তার হাই। ’

লজ্জিত, অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী

নিজের দোষ স্বীকার করে সাবেক আইজিপি বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে সরকারের আদেশে আন্দোলনকারীদের ওপর অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করে তাদের আহত ও নিহত করায় আমি সাবেক পুলিশ প্রধান হিসেবে লজ্জিত, অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী। জুলাই আন্দোলনে যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, এই জন্য অপরাধবোধ এবং বিবেকের তারণায় আমি অ্যাপ্রুভার (রাজসাক্ষী) হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ট্রাইব্যুনালে এসে স্বজন হারানোদের কান্না-আহাজারি আমি শুনেছি। ভিডিওতে যে নৃশংসতা দেখেছি, এতে মনে হয়েছে অ্যাপ্রুভার হওয়ার সিদ্ধান্ত যৌক্তিক। হত্যাকাণ্ডের পর লাশগুলো আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার বিভৎসতা আমাকে ভীষণভাবে মর্মাহত ও স্তম্ভিত করেছে। ’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি সাড়ে ৩৬ বছর পুলিশে চাকরি করেছি। পুলিশের চাকরি খুবই ট্রিকি চাকরি। সব সময় পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে। আমার এই চাকরিজীবনে আমার বিরুদ্ধে কখনো কোনো অভিযোগ আসেনি। আমি সব সময় যথেষ্ট মানবিকতা ও সচেতনতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছি। চাকরিজীবনের শেষ পর্যায়ে এসে এত বড় গণহত্যা আমার দায়িত্বকালীন সময়ে সংঘটিত হয়েছে, তার দায় আমি স্বীকার করছি। ’

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের নির্দেশে এসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।

তিনি বলেন, ‘আমি গণহত্যার শিকার প্রত্যেকের পরিবার, আহত ব্যক্তিবর্গ, দেশবাসী এবং ট্রাইব্যুনালের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আমাকে দয়া করে ক্ষমা করে দেবেন। আমার এই সত্য ও পূর্ণ বর্ণনার মাধ্যমে সত্য উদঘাটিত হলে আল্লাহ যদি আমাকে আরও হায়াত দান করেন, বাকিটা জীবন কিছুটা হলেও অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাব। ’

ইএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।