ঢাকা, রবিবার, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৭ জুলাই ২০২৫, ০১ সফর ১৪৪৭

ইসলাম

কোরআনের মর্ম অনুধাবনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার

মুফতি মাহমুদ হাসান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১:৩৯, জুলাই ২৭, ২০২৫
কোরআনের মর্ম অনুধাবনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার প্রতীকী ছবি

কোরআন মজিদ আল্লাহ তাআলার পবিত্র বাণী, যা কিয়ামত পর্যন্ত আগত মানব ও জিন জাতির হেদায়েতের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর ওহির মাধ্যমে নাজিল হয়েছে। কোরআনের মর্ম সেটিই গ্রহণযোগ্য, যা রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম (রা.) বুঝেছেন।

কোরআনের তাফসিরের কাজ অত্যন্ত সতর্কতা ও গভীর জ্ঞানের দাবি রাখে। এটি এমন কোনো বিষয় নয়, যেকোনো ব্যক্তি শুধু অনুবাদ পড়ে নিজস্ব বুদ্ধির ওপর ভিত্তি করে কোরআনের ব্যাখ্যা করতে বসে যাবে।

আজকাল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence বা এআই) নিয়ে খুব আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে এবং এটি সাধারণ মানুষের মধ্যে এমনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, যেন এসব সিস্টেম মানুষের প্রকৃত বুদ্ধিমত্তাকেও ছাড়িয়ে গেছে। এখন এআই ব্যবহার করে ইসলাম ও ইসলামী জ্ঞানকোষের ভিত্তিকে আঘাত করার একটি সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা চলছে। কোরআনের অনুবাদ ও ব্যাখ্যার একটি ‘আধুনিক’ ধারা তৈরির নামে, এআইর সাহায্যে কোরআনের ব্যাখ্যা প্রচারের পরিকল্পনা চলছে। দুঃখজনকভাবে দেখা যাচ্ছে, মুসলমানদের মধ্য থেকেই কিছু ব্যক্তি অজান্তে হলেও এই ভ্রান্ত চিন্তার সহযোগী হয়ে যাচ্ছেন।

তাঁরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে কোরআনের ব্যাখ্যার কাজ করছেন। মূলত এই ব্যক্তিরা আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সূক্ষ্মতা ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রাখেন না। সম্ভবত এ কারণেই তাঁরা না বুঝে এই ভুল প্রচেষ্টাকে উৎসাহ দিচ্ছেন।
এখানে আমরা কোরআনের মর্মবাণী ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব:

১. কোরআনের জ্ঞানসমূহে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বলতে কী বোঝায়?

২. কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাস্তব সক্ষমতা আসলে কতটুকু?

৩. কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে কি কোরআনের সঠিক মর্মবাণী বোঝা সম্ভব? এবং তা কি মুসলমানদের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য হবে?

এই প্রশ্নগুলোর আলোকে ইনশাআল্লাহ আমরা বর্তমান বাস্তবতা, প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা এবং কোরআনের বিশুদ্ধতা রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করব।

কোরআনীয় জ্ঞানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের বাস্তবতা
প্রশ্ন জাগতে পারে, কম্পিউটার তো মানুষের জন্য অনেক সুবিধা এনে দিয়েছে এবং এর মাধ্যমে কোরআনীয় জ্ঞান ও গবেষণায় অনেক উপকার হয়েছে। যেমন—কোরআন মজিদের ছাপার কাজে কম্পিউটার বিপুল সুবিধা এনে দিয়েছে। এখন কম্পিউটারের মাধ্যমে নির্দিষ্ট আয়াত, বিষয়বস্তু বা শব্দ খুব সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। ল্যাপটপ বা মোবাইল ফোনে কোরআনের অ্যাপ খুললেই মুহূর্তের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত আয়াতে পৌঁছা যায়। কম্পিউটারের সহায়তায় বিভিন্ন কারির কিরাত শোনা যায়।

এমন সফটওয়্যারও তৈরি হয়েছে, যাতে কেউ কোরআন তিলাওয়াত করলে সঙ্গে সঙ্গে স্ক্রিনে সেই আয়াত ভেসে ওঠে। এমনকি এআই এখন কোরআন সম্পর্কিত বিভিন্ন ব্যাখ্যা ও মতামত মুহূর্তেই সামনে নিয়ে আসে; এগুলোর বিশ্লেষণও উপস্থাপন করে। এ রকম চমকপ্রদ সক্ষমতা দেখে অনেকেই দাবি করছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে আমরা পৃথিবীর সব ভাষায় কোরআনের অনুবাদ করতে পারব এবং কোরআনের এমন সব দিক বুঝতে পারব, যা আগে অজানা ছিল।

এখন কথা হলো, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কি সত্যিই কোরআনের জ্ঞান ও ব্যাখ্যার কাজে ব্যবহার করা উচিত? এর উত্তর হলো, এআইর কাজ হচ্ছে নিজে নিজে তথ্য বা লেখা তৈরি করা। কিন্তু নিজ থেকে লেখা তৈরি মানে এই নয় যে এআই সফটওয়্যারে মানুষের মতো কোনো সৃষ্টিশীলতা বা সত্যিকারের জ্ঞানবুদ্ধি আছে। বরং বাস্তবতা হলো, বিশেষ করে লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলের কাজ হচ্ছে পরবর্তী শব্দ বা বাক্য কোনটি হতে পারে, তার পূর্বাভাস বা অনুমান দেওয়া। অর্থাৎ এগুলো শুধু পরবর্তী শব্দ কী হতে পারে, সেটা আন্দাজ করে চলে। তাই এর কার্যপদ্ধতি কোনোভাবেই মানুষের চিন্তাশক্তি বা উপলব্ধির সমতুল্য নয়। যখন এআই সফটওয়্যার দিয়ে কোরআনের অনুবাদ বা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তৈরি করা হয়, তখন সেটি আসলে পরবর্তী শব্দের সম্ভাব্যতা বা ভবিষ্যদ্বাণীর ভিত্তিতে তৈরি হয়। এতে একজন সাধারণ পাঠক মনে করতে পারেন, এই সফটওয়্যার বুঝি নিজে থেকেই গভীর ও জ্ঞানগর্ভ ব্যাখ্যা তৈরি করছে, যা প্রকৃতপক্ষে এক ধরনের বিভ্রম।

হ্যাঁ, এটি হতে পারে যে কোরআনের মৌলিক তাফসির গ্রন্থগুলোর তথ্যগুলো কম্পিউটারে দিয়ে দেওয়া হলো, অতঃপর কেউ কোনো আয়াতের ব্যাখ্যা জানতে চাইলে তখন কম্পিউটার কেবল সরবরাহকৃত ওই তথ্যগুলো রেফারেন্সসহ সামনে এনে দেখায়, তাহলে সেটা গ্রহণযোগ্য ও বৈধ উপায়ে কোরআনীয় জ্ঞানে কম্পিউটার ও এআইর ব্যবহার বলে গণ্য হবে। কিন্তু যদি এআই নিজে থেকেই তাফসির গ্রন্থগুলো থেকে শুধু ধারণা নিয়ে তারপর লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলের ওপর ভিত্তি করে নিজস্ব ব্যাখ্যা বা অনুবাদ তৈরি করে, তাহলে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সীমাবদ্ধতা কেন অনস্বীকার্য
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অন্যতম পথপ্রদর্শক বিজ্ঞানী অধ্যাপক ইয়ান লেকুন, যাঁকে এআইর জনকও বলা হয়, বর্তমানে ফেসবুকের মূল কম্পানি মেটায় Chief AI Scientist হিসেবে কাজ করছেন, তিনি বলেন, “এআই মডেলগুলো আমাদের যতই ‘বুদ্ধিমান’ মনে হোক, বাস্তবিক অর্থে তা একটি বিড়ালের বুদ্ধির সমপর্যায়েও এখনো পৌঁছতে পারেনি। ” কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একটি যান্ত্রিক অনুমানকারী ব্যবস্থা, যা শুধু সংখ্যা, তথ্য ও ভাষার প্যাটার্ন ধরে চলে। সত্যিকার অর্থে তার নিজস্ব উপলব্ধি, বোধশক্তি ও বিচারক্ষমতার শক্তি নেই। তা শুধু ট্রেনিং ডেটা থেকে শেখা তথ্য নতুনভাবে সাজিয়ে আমাদের সামনে উপস্থাপন করে।

শুধু ভাষা বা অক্ষরজ্ঞানের মধ্যেই জ্ঞান সীমাবদ্ধ নয়। ধরুন, আমাদের কাছে ইংরেজি ভাষার সবচেয়ে বড় অভিধান রয়েছে, যেখানে ইংরেজি ভাষার সব শব্দ ও বর্ণ রয়েছে। এখন কথা হলো, আজ পর্যন্ত ইংরেজি ভাষায় যত কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, গবেষণাপত্র, পাঠ্যবই ইত্যাদি লেখা হয়েছে, তা তো অভিধানের শব্দগুলোর নির্দিষ্ট ক্রম, ব্যাকরণ ও বিন্যাসের মাধ্যমেই লেখা হয়েছে। এখন এই লেখাগুলোকে কি আমরা শুধু বর্ণের বিবেচনায়ই মূল্যায়ন করব? লেখকদের ব্যক্তিত্ব, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ইত্যাদি নিয়ে ভাবব না? যদি কেউ বলে বসে, অস্কার ওয়াইল্ডের লেখায় এমন কী আছে? ওইতো ডিকশনারির শব্দগুলোর বিন্যাস! এই কাজগুলো তো চ্যাটজিপিটি দিয়ে অনায়াসে করিয়ে নেওয়া সম্ভব, শুধু স্টাইলটা শিখিয়ে দিলেই চলবে। তাহলে কোনো জ্ঞানী ব্যক্তি কি এটা মেনে নেবে? চিন্তা করুন, এই ধারণা কতটা বাস্তবতাবিবর্জিত ও বিপজ্জনক!

উপরোক্ত ভুল ধারণার চরম পরিণতি হলো, কেউ যদি কোরআন সম্পর্কেও বলে বসে যে এটা তো শুধু শব্দসমূহের সংকলন, আরবি অভিধানেরই তো শব্দ, তাহলে তার ভুলটা কত মারাত্মক। বাস্তবতা হলো, কোরআন কোনো সাধারণ গ্রন্থ নয়, এটা মহান আল্লাহর কালাম। এটা শুধু শব্দের বিন্যাস নয়, বরং আসমানি ওহির কণ্ঠস্বর, যা কেয়ামত পর্যন্ত মানব ও জিন জাতির হেদায়েতের জন্য প্রেরিত হয়েছে। কোরআনের প্রতিটি শব্দের মর্যাদা ও মাহাত্ম্য রয়েছে।

আজকের রাষ্ট্রীয় আইনব্যবস্থার কথাই ধরুন—আমেরিকা, ব্রিটেন বা কানাডার সংবিধান তো ইংরেজি শব্দের মাধ্যমেই লেখা হয়েছে। তাহলে কি কেউ বলতে পারে, এসব সংবিধান মূল্যহীন, কারণ এগুলো তো কেবল অভিধানের শব্দসমগ্র! তেমনি আদালতের রায় যদি এআই লেখে এবং ভাষাগত দিক থেকে আরো নিখুঁত হয়, তবু সেই লেখার কোনো আইনগত মূল্য নেই। কারণ এআইর কোনো আইনি কর্তৃত্ব নেই, নৈতিক অবস্থান নেই, মানবিক প্রেক্ষাপট নেই। তেমনি কোরআন, হাদিস, ফিকহ ও অন্যান্য ইসলামী জ্ঞানের যথার্থতা, বিশুদ্ধতা, মর্যাদা ও মানদণ্ড শুধু শব্দগত নয়, বরং ঈমান, ওহি, তাকওয়া, আমানতদারি, উম্মতের ইজমা—এসবের ওপর প্রতিষ্ঠিত।

যাঁরা এআই দ্বারা অতিমাত্রায় প্রভাবিত, তাঁরা নিজেদের বাস্তব জীবনে কি এআইর ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরতা দেখিয়েছেন? তাঁরা কি সার্জনের কাছে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন? আদালতে মামলা-মোকদ্দমা পরিচালনার জন্য উকিল বাদ দিয়েছেন? সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো বন্ধ করেছেন? যদি না করে থাকেন, তাহলে কেন শুধু ধর্মীয় জ্ঞান, কোরআন, হাদিস, তাফসির ইত্যাদিকে তাঁরা এআইর প্রয়োগের ক্ষেত্র বানাতে চান?

সারকথা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উপকারী অংশ শরিয়তের সীমারেখায় ব্যবহার করাকে যুগে যুগে উলামায়ে কেরাম বৈধতা দিয়েছেন, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষ উৎসাহিতও করেছেন। তবে এগুলোর এমন অবাধ ব্যবহার, যা দ্বিনের জন্য ক্ষতিকর, তা অবশ্যই নিন্দনীয়। তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নির্দিষ্ট সীমারেখায় ব্যবহার বৈধ এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রশংসনীয়ও বটে, কিন্তু এর অবাধ ও অযৌক্তিক ব্যবহারে বিশ্বাসী হওয়া অবশ্যই বর্জনীয়। কেউ যদি দাবি করে, এআইর এমন ক্ষমতা আছে যে কোনো আয়াতের ব্যাখ্যা দিতে পারে, অথবা শরিয়তের মাসআলা নির্ধারণ করতে পারে, তাহলে তা সম্পূর্ণ ভুল। কারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একটি যন্ত্র, এটি সাহাবা-তাবেঈনের মতো অনুভব, অভিজ্ঞতা, ঈমান, তাকওয়া ও সহবত পায়নি। এ কারণে কোরআন-হাদিসের গভীর জ্ঞান অর্জন, শেখানো ও প্রচারের জন্য এআইর ওপর নির্ভরশীল হওয়া উচিত নয়। বরং দ্বিনি জ্ঞানের প্রচার ও শিক্ষা সেই পদ্ধতিতে হওয়া উচিত, যা ‘খাইরুল কুরুন’ (সর্বশ্রেষ্ঠ যুগ) থেকে মুখে মুখে ও লিখিতভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে জ্ঞানের হস্তান্তর এবং নির্ভরযোগ্য সনদ বা অনুমোদনপ্রাপ্ত শুদ্ধ শৃঙ্খলা অনুসরণ করে পৌঁছেছে। এককথায় আমাদের দায়িত্ব হলো এআইকে তার উপযোগী কাজেই সীমাবদ্ধ রাখা; এর গণ্ডির বাইরে কাজে না লাগানো।

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।