ঢাকা, রবিবার, ২৭ আশ্বিন ১৪৩২, ১২ অক্টোবর ২০২৫, ১৯ রবিউস সানি ১৪৪৭

আন্তর্জাতিক

ন্যাটো, মেরকেল, ব্রেক্সিট, মস্কো: সবই গুলিয়ে ফেলছেন ট্রাম্প!

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩:৪১, জানুয়ারি ১৬, ২০১৭
ন্যাটো, মেরকেল, ব্রেক্সিট, মস্কো: সবই গুলিয়ে ফেলছেন ট্রাম্প! ওবামা বিরোধিতা- নাকি নীতি ঢেলে সাজানোর ইঙ্গিত, ট্রাম্প নিজেই কি তা বুঝছেন? ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: ন্যাটো অচল হয়ে গেছে। শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে আঙ্গেলা মেরকেল ‘সর্বনাশা ভুল’ করেছেন। ব্রেক্সিট (ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের সরে আসা) দারুণ হয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে ‍যুক্তরাষ্ট্র হাত বাড়াবে।

ওপরের চারটি বাক্য বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ‘স্বীকৃত মিত্রদের বিরুদ্ধে এবং শত্রুদের পক্ষে’ তার এ মন্তব্যগুলো মার্কিন মুলুক ছাড়িয়ে পুরো বিশ্ব রাজনীতিতে দমকা হাওয়া ছেড়েছে।

 

সর্বত্র একই আলোচনা, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণার সময় যা-তা বলেছেন, তা না হয় সেসময়ের বিবেচনায় পাশ কাটানো গেল। কিন্তু তিনি তো এখন বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রেসিডেন্ট পদে আসীন, এখন কেন দেশের স্বীকৃত শত্রু-মিত্রদের নিয়ে এমন আবোল-তাবোল মন্তব্য করছেন? তবে কি সব গুলিয়ে ফেলছেন ট্রাম্প?

দিন পাঁচেক পরই ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট পদে শপথ নেবেন। আনুষ্ঠানিকভাবে উঠবেন বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রাসাদ ‘হোয়াইট হাউসে’। তার আগে ব্রিটেনের দৈনিক ‘দ্য টাইমস’ এবং জার্মানির ট্যাবলয়েড ‘বিল্ড’র সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এই ‘গুলিয়ে ফেলা’ কথাগুলো বলে ফেলেন ট্রাম্প।

রাশিয়া মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে
পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা, সাইবার হামলা, হ্যাকিং ইত্যাদি ইস্যুতে বরাবরই রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সমানে সমান দ্বৈরথ চললেও সাক্ষাৎকারে দেশটির সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার ইঙ্গিত দেন ট্রাম্প।

তিনি মস্কোর প্রতি হাত বাড়িয়ে দেওয়ার কথা জানিয়ে দ্য টাইমসকে বলেন, “দেখা যাক, আমরা রাশিয়ার সঙ্গে কিছু ভালো চুক্তি করতে পারি কিনা। ” চুক্তি হলে দু’পক্ষের পারমাণবিক বোমার প্রতিযোগিতা কমবে এবং মস্কোর ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল হবে বলেও ইঙ্গিত দেন ট্রাম্প

ইউক্রেনের গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ ও ক্রিমিয়া দখল, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে সরকারি বাহিনীর পক্ষে অবস্থান নিয়ে ‘বেসামরিক নাগরিক’দের ওপর হামলা এবং নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সাইবার হামলা চালিয়ে তথ্য চুরির অভিযোগে মস্কোর ওপর ওয়াশিংটনের নিষেধাজ্ঞা চলছে। উত্তরসূরী প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সেই নিষেধাজ্ঞাকে উঠিয়ে দিয়ে উল্টো তার বিপরীতে হেঁটে মস্কোর সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন ট্রাম্প।

নির্বাচনের আগে ও পরে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ট্রাম্প বলেন, “নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া এখন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু আমি মনে করি এমন কিছু হতে পারে যাতে জনগণ উপকৃত হবে। ”

ওয়াশিংটন এবং তাদের মিত্রগুলো ২০১৪ সালে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। গত ডিসেম্বরেই সে নিষেধাজ্ঞা নবায়ন করা হয়। কিন্তু ট্রাম্প পুরোপুরি প্রেসিডেন্টের গদিতে বসলে যে সে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে তা তার সাক্ষাৎকারেই প্রকাশ পাচ্ছে।

অচল হয়ে গেছে ন্যাটো
চীন-রাশিয়ার সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সবসময়ই চলে এসেছে। এই লড়াই থেকে আটলান্টিক মহাসাগরের উত্তর উপকূলের দেশগুলোর সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য যুক্তরাষ্ট্র গড়ে তোলে ন্যাটো। এতোদিন সেই ন্যাটোকে নিয়ে রাশিয়া-চীনের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে এলেও এবার ট্রাম্প বলছেন, ন্যাটো আসলে অচল হয়ে গেছে।

সাক্ষাৎকারে ইউক্রেন ইস্যুতে মস্কোর নাক গলানিতে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর উদ্বেগের বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলেই ট্রাম্প এ মন্তব্যটি করেন। তিনি বলেন, “ ‘ন্যাটো অচল হয়ে গেছে। আমি আসলে অনেক আগেই বলেছিলাম, ন্যাটোর ঝামেলা আছে। ”

পুরো বিশ্ব দাপিয়ে বেড়াতে ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক মিত্রতা অক্ষুণ্ন রাখতে ন্যাটোই প্রধান ভরসা হলেও ট্রাম্পের কাছে কেন এটিকে অচল মনে হচ্ছে? সে প্রশ্ন করলে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বলেন, “এটা অনেক অনেক আগে গঠিত হয়েছে। তাছাড়া এই জোটের সদস্যভুক্ত দেশগুলোর যে সহযোগিতা করার কথা, তারা তা করছে না। ”

ট্রাম্প স্পষ্ট করে বলে দেন, “ন্যাটো সদস্যভুক্ত দেশগুলোকে সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে তিনি অন্তত দু’বার ভাববেন, তারা আসলে সহযোগিতার ঋণটা ঠিকমতো ঠিকসময়ে শোধ করতে পারবে কিনা। ”

ট্রাম্পের জয়ের আগে ন্যাটো মহাসচিব জেন্স স্টলেনবার্গ ‘বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায়’ জোটটির উপযোগিতা আরও বেড়েছে বলে দাবি করলেও এর ব্যয়ভার নিয়ে ২৮টি সদস্য দেশের মধ্যেই কিছুটা মন কষাকষি চলে আসছে। এই ‘হিসাব না মেলা ক্ষণে’ই ন্যাটোতে যুক্তরাষ্ট্রের থাকার যৌক্তিকতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেন ট্রাম্প।

ব্রেক্সিট দারুণ হয়েছে, আরও অনেকে ইইউ ছাড়বে
ইউরোপের দেশগুলোর অর্থনীতির ভিত হিসেবে একসময় ইউরোপীয় ইউনিয়নকে (ইইউ) দেখা হতো। কিন্তু ২০০৯ সালের পর ২০১৫ সালে গ্রিসসহ ইউরোপে অর্থনৈতিক মন্দা জোটের বোঝাপড়াকে নড়বড়ে করে দেয়। এই বোঝাপড়া আরও নড়বড়ে হয়ে গেলো ব্রিটেন ইইউ ছাড়ার (ব্রেক্সিট) পর। ব্রিটিশরা অনেক সিদ্ধান্তই ইইউ’র সঙ্গে থাকায় নিতে পারছিলো না বলে জোটটি থেকে বেরিয়ে আসে। সেসময় উত্তরসূরী ওবামাসহ বিশ্ব নেতারা ব্রিটিশ জনগণকে ঐক্যের স্বার্থে ইইউতে থাকার আহ্বান জানালেও এখন ট্রাম্প বলছেন, বিষয়টি আসলে বেশ ভালো হয়েছে।
 
নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বলেন, “এটা আসলে দারুণ একটা ব্যাপার। ব্রেক্সিটের ফলাফলও দৃশ্যমান হচ্ছে। আমি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়ে আসা ব্রিটেনের সঙ্গে একটি চুক্তিকে স্বাগতও জানিয়েছি। এটা দু’পক্ষের জন্যই উপকারী। ”

ব্রেক্সিটকে আরও কার্যকর করতে ট্রাম্প নিজে কাজ করার আগ্রহের কথাও জানান। জানান ২০ জানুয়ারির শপথের পর শিগগির ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে’র সঙ্গে দেখা করার কথাও। বলেন, “আমরা এটাকে (ব্রেক্সিট প্রক্রিয়া) সঠিকভাবে দ্রুত শেষ করতে কঠোর পরিশ্রম শুরু করছি। ”

ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার কারণে ব্রিটেনকে অনেক সিদ্ধান্ত নিতে সংস্থাটির ওপর নির্ভর করতে হতো উল্লেখ করে ট্রাম্প ভবিষ্যদ্বাণী করেন, “ভবিষ্যতে অন্য দেশগুলোও ইইউ ছেড়ে যাবে। ”

আঙ্গেলা মেরকেল সর্বনাশা ভুল করেছেন
২০১৫ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে যখন লাশের পর লাশ পড়ে যাচ্ছিল, তখন দেশ ছাড়তে থাকে হাজার-লাখো শরণার্থী। এই শরণার্থীরা বেশিরভাগই পাড়ি জমাতে থাকে ইউরোপের দিকে। কিন্তু সেসময় ইতালি-গ্রিস-হাঙ্গেরিসহ ইউরোপের প্রবেশদ্বার দেশগুলোর সীমান্তে কড়াকড়ি থাকায় হাজারো শরণার্থীর সলিল সমাধি হতে থাকে।  

এই মানবিক বিপর্যয়ের প্রেক্ষিতে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেরই প্রেসিডেন্ট সমাধানে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান ইউরোপসহ বিশ্বনেতাদের প্রতি। এই আহ্বানে উদার হয়ে এগিয়ে আসেন আঙ্গেলা মেরকেল। সেসময় তার দেশের জনগণ কিছুটা প্রতিক্রিয়া দেখালেও বিশ্বজুড়ে ধন্য ধন্য পড়ে যায়। এমনকি শান্তিতে নোবেল বিজয়ের জন্য মনোনীতদের সংক্ষিপ্ত তালিকায়ও চলে আসেন মেরকেল।

অথচ এই মেরকেলের সেই সিদ্ধান্তই নাকি ‘সর্বনাশা ভুল’ ছিল। এটা মনে করেন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তিনি বলেন, “অনিবন্ধিত শরণার্থীদের ঢুকতে দেওয়ায় জার্মানি নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ে গেছে। ”

মেরকেলের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি মনে করি তিনি অনেক বড় সর্বনাশা ভুল করেছেন, এভাবে সব‍াইকে জার্মানিতে ঢুকতে দিয়ে... তারা যেখান থেকে পারছে ঢুকছে... কেউ জানে না ওরা কোথা থেকে আসছে। ”

মার্কিন সংবাদমাধ্যম বলছে, ট্রাম্পের এই ধরনের বক্তব্য এখন কোন পর্যায়ে বিবেচনা কর‍া হবে তা নিয়েই বিপাকে পড়ে গেছে যেন সবাই। এটা কি ওবামা বিরোধিতা, নাকি নীতি ঢেলে সাজানোর ইঙ্গিত। ট্রাম্প নিজেই কি তা বুঝছেন?

বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৭, ২০১৭
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।