ঢাকা, শুক্রবার, ৭ ভাদ্র ১৪৩২, ২২ আগস্ট ২০২৫, ২৭ সফর ১৪৪৭

আন্তর্জাতিক

যেভাবে সিকিমকে ভারতের অঙ্গরাজ্য বানিয়ে দেন লেন্দুপ দর্জি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:৩৫, আগস্ট ২২, ২০২৫
যেভাবে সিকিমকে ভারতের অঙ্গরাজ্য বানিয়ে দেন লেন্দুপ দর্জি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে অভিবাদন জানাচ্ছেন সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী লেন্দুপ দর্জি

নিউ ইয়র্কের প্রাণকেন্দ্র, মিডটাউন ম্যানহাটনের ফিফথ অ্যাভিনিউ। সেখানকার অভিজাত ডিপার্টমেন্ট স্টোর বার্গডফ গুডম্যান যেন ১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বর এক রাতের জন্য রূপ নিয়েছিল হিমালয়ের ছোট্ট রাজ্য সিকিমে।

রাজা পালডেন থোন্ডুপ নামগিয়াল ও তার মার্কিন স্ত্রী, রানি হোপ কুকের সম্মানে আয়োজিত হয়েছিল চমকপ্রদ ফ্যাশন শো আর নৈশভোজ।

শহরের নামকরা সেলেব্রিটিরা সেদিন অতিথি হয়ে হাজির ছিলেন। প্রবেশদ্বারে তাদের বরণ করা হয় সিকিমি ঐতিহ্য মেনে পশমি স্কার্ফ দিয়ে। ভেতরে বাজছিল সিকিমের গান-বাজনা, হাতে ছিল শ্যাম্পেনের গ্লাস। আর বাইরে—ম্যানহাটনের রাস্তাজুড়ে উড়ছিল সিকিমের পতাকা।

সেটাই শেষ নয়। পরের দুদিনও নিউ ইয়র্কের কলোনি ক্লাব আর ওয়ালডর্ফ অ্যাস্টোরিয়া হোটেল ভরেছিল রাজকীয় আয়োজনে। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছিল, রানি হোপ কুক আসলে ফ্যাশনকে হাতিয়ার করছেন—বিশ্বের নজর কাড়তে, সিকিমের অস্তিত্ব বোঝাতে।

কথাটা একেবারেই অমূলক ছিল না। কারণ চোগিয়াল তখনই আঁচ করেছিলেন, দিল্লি তাদের পুরোনো নীতি বদলে ফেলছে, আর সিকিমকে ভারতের সঙ্গে একীভূত করার পথে এগোচ্ছে। তাই কিছুদিন আগে তিনি ও রানি কমিশন করে দিয়েছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়কে—সিকিম নিয়ে তথ্যচিত্র বানানোর জন্য। উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট— বিশ্বকে জানানো যে হিমালয়ের কোলে সিকিম একটি স্বতন্ত্র ভূখণ্ড। তবে সেই তথ্যচিত্র বহু বছর সাধারণ মানুষের চোখের আড়ালেই রয়ে যায়।

চোগিয়াল তখনো জানতেন না, নিউ ইয়র্কের সেই রাজসিক সফরের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই তার রাজত্বের অবসান ঘটবে। অবশেষে ১৯৭৫ সালের ১৬ মে সিকিম ভারতের ২২তম অঙ্গরাজ্য হয়ে যায়।

এই ঐতিহাসিক ঘটনার ৫০ বছর পূর্ণ হলো সম্প্রতি—আর আজকের সিকিম তা উদযাপন করেছে মহাধুমধামে।

কিন্তু এই পরিবর্তনের পেছনে শুধু দিল্লির রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বা গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর গোপন ভূমিকাই কাজ করেনি। সমসাময়িক পর্যবেক্ষকরা মানেন, সিকিমের ভেতর থেকে একজন শক্তিশালী নেতার সমর্থন না থাকলে এই সংযুক্তি এত সহজে সম্ভব হতো না।

তিনি ছিলেন কাজী লেন্দুপ দর্জি—সংক্ষেপে এলডি কাজী। আজও দক্ষিণ এশিয়ার নানা আলোচনায় যখন ভারতীয় আধিপত্যবাদ কিংবা সিকিমকে ভারতের কাছে ‘বিক্রি’ করার প্রসঙ্গ ওঠে, সবার আগে উচ্চারিত হয় তার নাম। তিনি ছিলেন স্বাধীন সিকিমের শেষ প্রধানমন্ত্রী এবং ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা সিকিমের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী।

চোগিয়ালের সঙ্গে তার আজন্ম দ্বন্দ্ব, দুজনের বিদেশিনী স্ত্রীর ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা, পরে ভারতীয় গোয়েন্দাদের প্রকাশ্য সহায়তা ও ইন্দিরা গান্ধীর আশীর্বাদে রাজতন্ত্রকে মুছে দিয়ে সিকিমকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করা—সব মিলিয়ে লেন্দুপ দর্জির জীবন একেবারেই এক রাজনৈতিক থ্রিলার।

লেন্দুপ দর্জি আর চোগিয়ালের সাপে–নেউলে সম্পর্ক

সপ্তদশ শতকে প্রথম চোগিয়াল যখন সিকিমের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন, তখন শাসন পরিচালনার সুবিধার্থে তিনি পুরো রাজ্যকে ভাগ করেছিলেন ১২টি ইউনিটে। প্রতিটি ইউনিটকে বলা হতো ‘জং’, আর এগুলোর দায়িত্বে থাকতেন একজন করে ‘কাজী’। মুঘল আমলের ‘জায়গির’ আর ‘জায়গিরদার’-এর মতোই সিকিমি প্রতিশব্দ ছিল ‘জং’ আর ‘কাজী’।

এই কাজীদের মধ্যে বিশেষভাবে প্রভাবশালী ছিলেন দক্ষিণ সিকিমের চুকাং জং-এর কাজীরা—যারা খাংসারপা নামের এক প্রাচীন লেপচা পরিবারভুক্ত। কাজী লেন্দুপ দর্জি (১৯০৪–২০০৭) ছিলেন এই পরিবারের সন্তান।

চুকাং কাজীদের প্রভাব এতই প্রবল ছিল যে তরুণ বয়সেই লেন্দুপ দর্জিকে সিকিমের সবচেয়ে বড় ও বিখ্যাত তিব্বতি মঠ রুমটেকের প্রধান করা হয়েছিল। তবে সেটি ছিল সাময়িক। যুবরাজ পালডেন থোন্ডুপ নামগিয়াল (১৯২৩–১৯৮২) তখনও নাবালক ছিলেন। মাত্র ১০ বছর বয়স পূর্ণ হতেই ১৯৩৩ সালে লেন্দুপকে সরিয়ে যুবরাজকেই রুমটেক মঠের প্রধান ঘোষণা করা হয়।

তরুণ লেন্দুপ এতে গভীরভাবে অপমানিত হয়েছিলেন—যদিও প্রকাশ্যে তা কখনও স্বীকার করেননি। সেই ক্ষোভই ধীরে ধীরে তাকে চোগিয়ালের স্থায়ী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ করে তোলে।

এখানে সিকিমের জাতিগত প্রেক্ষাপটও গুরুত্বপূর্ণ। শাসন ছিল লেপচা ও ভুটিয়াদের হাতে, অথচ জনসংখ্যার তিন-চতুর্থাংশই ছিলেন নেপাল থেকে আসা অভিবাসী। লেপচা ও ভুটিয়ারা অভিজাত ও ভূস্বামী শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করলেও নেপালি অভিবাসীরা ছিল প্রান্তিক ও দরিদ্র।

চোগিয়ালরা নেপালিদের তেমন পছন্দ করতেন না। কিন্তু চুকাংয়ের কাজীরা বরাবরই তাদের জমিতে বসতি স্থাপন ও চাষাবাদে উৎসাহ দিতেন। এই কারণে নেপালিদের মধ্যে লেন্দুপ দর্জির জনপ্রিয়তা দ্রুত বাড়তে থাকে। তাদের সমর্থন নিয়েই তিনি ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন সিকিমের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং সরাসরি রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন।

লেন্দুপ দর্জি রাজনীতিতে সক্রিয় হন ১৯৪০-এর দশক থেকে। ১৯৪৫ সালে গঠন করেন সিকিম প্রজা মণ্ডল। ১৯৫৩ সালে সেটি হয় সিকিম স্টেট কংগ্রেস, আর ১৯৬২ সালে আত্মপ্রকাশ করে সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস নামে। রাজপরিবারের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন চালাতে থাকে এই দল।

১৯৭৫ সালে সিকিমের ভারতভুক্তির আগে তিন দশক জুড়ে লেন্দুপ দর্জিই ছিলেন রাজ্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী রাজনীতিক। তবে তাকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে চোগিয়ালও সবরকম চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।

ভারতের প্রিন্সলি স্টেটগুলো নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করা অক্ষয় চভনের ভাষায়— এক কথায় বলতে গেলে সিকিমের রাজার ব্যক্তিগতভাবে কাজীর প্রতি ছিল এক ধরনের ‘প্যাথলজিকাল হেট্রেড’ বা চরম বিদ্বেষ, যা বারবার নানা ঘটনায় প্রকাশ পেয়েছে। তবে এটাও সত্যি—এই বিদ্বেষ কিন্তু একতরফা ছিল না, বরং ছিল পারস্পরিক।

ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশ আর ‘র’-এর গোপন অপারেশন

সিকিমে লেন্দুপ দর্জি যতই জনপ্রিয় হোন না কেন, দীর্ঘদিন তিনি চোগিয়ালের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বড় কোনো সাফল্য পাননি। এর মূল কারণ ছিল ভারতের নীতি—যেখানে দিল্লি প্রকাশ্যে রাজতন্ত্রের প্রতি সমর্থন জানাত। স্বাধীনতার পর ভারতের অধিকাংশ প্রিন্সলি স্টেট ‘ইন্সট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশন’-এর মাধ্যমে যুক্ত হলেও সিকিমকে সেই প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা হয়েছিল।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেল চেয়েছিলেন সিকিমকেও ভারতের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু তাতে সায় দেননি। বরং ১৯৫০ সালে সিকিমের রাজার সঙ্গে একটি চুক্তি করে দিল্লি তাদের প্রোটেক্টোরেট মর্যাদা দেয়। অর্থাৎ, সিকিমের প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক, মুদ্রা, যোগাযোগ ও ডাক বিভাগের দায়িত্ব নেয় ভারত, তবে সিকিমের আলাদা পরিচয় বহাল থাকে।

সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার লিখেছেন, ১৯৬০ সালে নেহরু তাকে বলেছিলেন— “সিকিমকে জোর করে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করতে চাই না। সেটা হবে মশা মারতে কামান দাগার মতো। ”

কিন্তু ১৯৭১ সালের পর ছবিটা পাল্টে যায়। তখন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিলেন, সিকিমকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করতেই হবে।

বাংলাদেশ যুদ্ধ তখন সদ্য শেষ। কিন্তু যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানের পাশে দাঁড়িয়ে চীনের সেনারা সিকিম সীমান্তের উত্তরের চুম্বি ভ্যালি পর্যন্ত চলে এসেছিল বলে রিপোর্ট মেলে। এর পাশাপাশি আরেকটি ঘটনা দিল্লিকে অস্বস্তিতে ফেলে—১৯৬৮ সালে ভুটান জাতিসংঘের সদস্যপদ পায় এবং স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ইন্দিরা চাননি ভুটানের দেখাদেখি সিকিমও একই পথে হাঁটুক।

এরপরই পর্দার আড়ালের খেলা শুরু হয়। সাবেক ‘র’ প্রধান জিবিএস সিধু তার বই Sikkim: Dawn of Democracy-তে লিখেছেন, ১৯৭২ সালের শেষ দিকে ইন্দিরা গান্ধী ‘র’-এর প্রধান আর এন কাও এবং প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি পি এন হাকসারকে ডেকে পাঠান। তিনি তাদের দেখান সিকিমের চোগিয়ালের একটি চিঠি, যেখানে রাজা নিজেকে ‘হিজ ম্যাজেস্টি’ বলে সম্বোধন করেছেন—একটি উপাধি যা কেবলমাত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রপ্রধানরা ব্যবহার করে থাকেন।

চিঠি দেখিয়ে ইন্দিরা গান্ধী সরাসরি প্রশ্ন করেন, এ ব্যাপারে কিছু করা যায় কি?

আর এন কাও সময় চান দুই সপ্তাহ, কিন্তু মাত্র দশ দিন পরই ফিরে এসে জানান— হ্যাঁ, সম্ভব।

এরপরই শুরু হয় অপারেশন সিকিম। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশ ছিল একেবারে পরিষ্কার—এই মিশনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে সিকিমকে ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত করা।

দর্জির সঙ্গে হাত মেলাল ভারতীয় গোয়েন্দারা

গোপনে শুরু হলো সিকিমের গণতন্ত্রপন্থী শক্তিগুলোকে একত্র করার চেষ্টা। তাদের বুঝিয়ে বলা হলো—ভারত আর চোগিয়ালকে সমর্থন করবে না। সেই সময় থেকেই কাজী লেন্দুপ দর্জির সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস ভারতের আর্থিক ও রাজনৈতিক সহায়তা পেতে শুরু করে।

অন্যদিকে চোগিয়ালকে রাখা হয় এক ধরনের ভ্রান্ত ধারণার মধ্যে—যেন নির্বাচন হলেও এখনো সমঝোতার সুযোগ আছে। ভারত শেষ পর্যন্ত সংযুক্তিই চাইছে, সেটা তিনি ঘুণাক্ষরেও টের পাননি।

সাবেক ‘র’ প্রধান জিবিএস সিধু লিখেছেন: “আমার নির্দিষ্ট দায়িত্ব ছিল কাজীর দলকে ভোটের জন্য প্রস্তুত করা এবং তারা যাতে অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিশ্চিত করতে পারে, সেটি দেখা। ”

অবশেষে ১৯৭৪ সালের ১৫ এপ্রিল ভারতের নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে সিকিমে ভোট হয়। তাতে লেন্দুপ দর্জির দল ৩২টির মধ্যে ৩১ আসনে জয়ী হয়। নির্বাচিত ‘প্রধানমন্ত্রী’ হয়ে দর্জির সরকার মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে ভারতের সঙ্গে ‘অধিকতর সহযোগিতা’ চেয়ে বিল আনে—যার তীব্র বিরোধিতা করেন চোগিয়াল।

এরপর ভারতের সঙ্গে সিকিমের সংযুক্তি ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। ১৯৭৫ সালের ১০ এপ্রিল দর্জির নেতৃত্বে আইনসভা দুটি প্রস্তাব পাস করে—একটি ভারতের সঙ্গে পূর্ণ সংযুক্তির দাবি, আরেকটি চোগিয়ালের অপসারণ। ১৪ এপ্রিল গণভোটে এই দুটি প্রস্তাব ৯৭.৫৫ শতাংশ মানুষের সমর্থনে গৃহীত হয়। সবশেষে ১৬ মে ১৯৭৫, সিকিম আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের ২২তম অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়।

অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, লেন্দুপ দর্জির নামের সঙ্গে ‘ভারতীয় এজেন্ট’ তকমা জড়িয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ ছিল তার প্রকাশ্যেই ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের সাহায্য নেওয়া।

চোগিয়ালের তৎকালীন এডিসি ক্যাপ্টেন সোনাম ইয়ংডা পরে দাবি করেন, রাজপ্রাসাদের সামনে যে বিক্ষোভ হতো, তাতে ভারতীয় সেনারা সিভিল পোশাক পরে অংশ নিতেন। তার অভিযোগ, গণভোটের ফলও ভারতের কারসাজিতেই ব্যাপকভাবে ‘রিগড’ হয়েছিল।

তবে এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই—লেন্দুপ দর্জির পেছনে সিকিমের জনসংখ্যার গরিষ্ঠ অংশ, বিশেষ করে নেপালি বংশোদ্ভূতদের বিপুল সমর্থন ছিল। চোগিয়ালের শাসনে তারা নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিলেন।

এই কারণেই দর্জির সমর্থকরা আজও বলেন—তিনি সিকিমকে রাজতন্ত্রের নিপীড়ন থেকে মুক্ত করেছিলেন এবং সব নাগরিকের সমানাধিকার নিশ্চিত করেছিলেন। তাদের মতে, ভারতের সঙ্গে সংযুক্তি ছিল এই প্রক্রিয়ারই স্বাভাবিক পরিণতি—যদিও সেটি দর্জির আন্দোলনের ঘোষিত লক্ষ্য কখনো ছিল না।

রাজা ও রাজনীতিবিদের দুই বিদেশিনী স্ত্রী

কাজী লেন্দুপের স্ত্রী ছিলেন বেলজিয়ান অ্যারিস্টোক্র্যাট এলাইজা-মারিয়া ল্যাংফোর্ড রাই, যিনি কাজীর স্ত্রী হিসেবে সিকিমে 'কাজীনী এলাইজা মারিয়া' নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন।

এডিনবরা ইউনিভার্সিটির আইনের স্নাতক এলাইজা মারিয়া বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে বার্মায় চলে এসেছিলেন, তার প্রথম স্বামী ছিলেন স্কটিশ। পরবর্তী জীবনে বিখ্যাত লেখক জর্জ অরওয়েল বার্মায় থাকাকালীন এই বিদুষী নারীর প্রেমে পড়েছিলেন, যদিও সেই সম্পর্ক পরিণতি পায়নি।

এলাইজা মারিয়ার বিবাহ বিচ্ছেদের পর কাজীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়, দুজনে দিল্লিতে বিয়ে করেন ১৯৫৭ সালে। অক্ষয় চভন জানান, বিয়ের পর থেকেই কাজীনীর স্বপ্ন ছিল তিনি একদিন সিকিমের 'ফার্স্ট লেডি' হবেন।

কাজীনী থাকতেন সিকিম সীমান্তের ঠিক বাইরে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার কালিম্পংয়ে, আর সেখানে বসেই চোগিয়াল, যুবরাজ আর সিকিমের রাজদরবারকে ক্ষুরধার ভাষায় আক্রমণ করে বিভিন্ন খবরের কাগজ ও আন্তর্জাতিক জার্নালে লেখালেখি করতেন।

সিকিমের রাজপরিবারের বিরুদ্ধে ভারতে জনমত তৈরিতে কাজীনী এলাইজা মারিয়ার একটা বড় ভূমিকা ছিল। স্বামীর রাজনৈতিক দলকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে ও তাদের আন্দোলন সংহত করার জন্যও তিনি দারুণ দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতেন।

কাজীর সঙ্গে বিয়ের ছ'বছর পর কাজীনী আক্রমণ করার জন্য চোগিয়ালের পাশাপাশি এক নতুন প্রতিপক্ষকে পেলেন – তিনি আমেরিকান সোশ্যালাইট হোপ কুক!

নিউ ইয়র্কের এক অত্যন্ত ধনাঢ্য পরিবারের মেয়ে হোপ কুক হিমালয় নিয়ে গবেষণা করতে ভারতে একটি স্টাডি ট্রিপে এসেছিলেন ১৯৫৯ সালে। তখন তার বয়স মাত্র ১৯।

সে সময় দার্জিলিংয়ের হিমালয়ান হোটেলে সিকিমের যুবরাজ থোন্ডুপের (যিনি পরে চোগিয়াল হবেন) সঙ্গে তার আলাপ হয়। যুবরাজের প্রথম স্ত্রী তার বছরদুয়েক আগেই মারা গেছেন, অতঃপর সেই পরিচয় প্রণয়ে রূপ নিল।

এরপর ১৯৬৩ সালে জওহরলাল নেহরুর সম্মতি নিয়ে যুবরাজ থোন্ডুপ ২২ বছরের তরুণী হোপ কুককে বিয়ে করলেন। মার্কিন সোশ্যালাইট প্রবেশ করলেন তার হিমালয়ান সাংগ্রিলায়।

সেই বিয়ের অল্প কয়েকদিন পরেই থোন্ডুপের পিতা তাশি নামগিয়াল প্রয়াত হলেন, ফলে নতুন চোগিয়াল হিসেবে সিংহাসনে অভিষেক হলো থোন্ডুপের, আর তার স্ত্রী হোপ কুক হলেন নতুন 'গিয়ালমো' (রানি)।

আমেরিকান এই গিয়ালমো মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র চর কি না, তা নিয়ে যথারীতি ভারতে প্রবল গুঞ্জন আর জল্পনা শুরু হয়ে গেল।

পরে ভারতের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তাদের বইতে অনেকেই লিখেছেন হোপ কুকের সঙ্গে সিআইএর সংশ্লিষ্টতার কোনো প্রমাণই মেলেনি, কিন্তু সেই শীতল যুদ্ধের যুগে ভারতের আমজনতা তখন কিন্তু তা আদৌ বিশ্বাস করেনি।

চোগিয়াল ও তার নতুন রানি মাঝে মাঝেই বিশ্ব পরিক্রমায় বেরোতেন – যে সফরগুলোর প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল একটি স্বাধীন সিকিমের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনসংযোগ। প্রতিবেদনের শুরুতেই নিউ ইয়র্কে যে ফ্যাশন শো-র কথা উল্লেখ করা হলো, সেটাও ছিল এরকমই একটি 'পি আর এক্সারসাইজ'।

এর মাঝে ১৯৬৬ সালে 'বুলেটিন অব টিবেটোলজি'তে একটি নিবন্ধ লিখে গিয়ালমো হোপ কুক দাবি জানালেন, ভারতের উচিত দার্জিলিংকে আবার সিকিমের হাতে ফেরত দেওয়া – যে বক্তব্য নিয়ে ভারতের পার্লামেন্টেও তোলপাড় পড়ে গেল।

পরের বছর স্ত্রীর অনুপ্রেরণায় চোগিয়াল সিকিমের বাছাই করা বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদদের নিয়ে 'স্টাডি ফোরাম' নামে একটি কমিটি তৈরি করলেন – যাদের কাজই ছিল স্বাধীন সিকিমের পক্ষে জনমত তৈরি করা। ভারত যথারীতি হোপ কুককে তখন থেকেই সন্দেহের চোখে দেখছিল।

দিল্লির ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলো যখন ১৯৬৮তে ভারতের স্বাধীনতা দিবসে গ্যাংটকের রাস্তায় 'ভারতীয়রা সিকিম ছাড়ো' প্ল্যাকার্ড নিয়ে স্কুলের বাচ্চারা মিছিল করল। গোয়েন্দারা রিপোর্ট দিলেন, এই মিছিলের পরিকল্পনা হোপ কুকেরই মস্তিষ্কপ্রসূত।

ফলে কাজীনী যখন স্বামীর পথে সামিল হয়ে সিকিমকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করার পথে এগোচ্ছেন, সিকিমের বিদেশিনী গিয়ালমো কিন্তু তার সাংগ্রিলার স্বাধীনতার জন্যই লড়াই চালাচ্ছিলেন।

ইতিহাস বলে এই লড়াইতে শেষ হাসি কাজীনীই হেসেছেন। তবে সিকিমের ভারতভুক্তির প্রায় বছর দেড়েক আগেই রানি হোপ কুক নিজের সন্তানদের নিয়ে চিরতরে আমেরিকায় ফিরে যান – এরপর আর কখনো তিনি সিকিমে পা রাখেননি।

ভারতীয় সেনা তার প্রিয় রাজপ্রাসাদে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের অস্ত্র কেড়ে নিচ্ছে, এ দৃশ্যও তাকে দেখতে হয়নি।

অন্য দিকে কাজীনী এলাইজা মারিয়া জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত লেন্দুপ দর্জির পাশেই ছিলেন। নিঃসন্তান এই দম্পতি শেষ জীবনে থাকতেন কালিম্পংয়ে, সেখানেই ১৯৯০ সালে কাজীনী প্রয়াত হন।

শেষ জীবনে কি অনুশোচনার গ্রাসে ছিলেন লেন্দুপ দর্জি?

সিকিমের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হলেও কাজী লেন্দুপ দর্জির সেই ক্ষমতার আসন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে তার দল সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস (এসএনসি) একটি আসনও পায়নি। ক্ষমতায় আসেন নেপালি জনজাতি থেকে উঠে আসা নতুন নেতা নরবাহাদুর ভান্ডারি। কার্যত সেখানেই দর্জির সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনের সমাপ্তি ঘটে।

কিছুদিন পর তিনি মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়ে দেখেন—ভোটার তালিকায় তার নিজের নামই নেই! তখন তিনি স্ত্রীকে নিয়ে সরে গেছেন কালিম্পংয়ে, যেখানে পুরোনো জমিদারির স্মৃতিবাহী নামে তৈরি হয়েছিল তাদের বাড়ি—‘চুকাং হাউজ’।

১৯৯০ সালে স্ত্রীর মৃত্যু হলে জীবনের শেষ ১৭ বছর কাটে দর্জির একাকীত্বে। কোনো আত্মীয়-স্বজন ছিল না পাশে, আর তিনি নিজেও সিকিমের সঙ্গে সব সম্পর্ক প্রায় ছিন্ন করে ফেলেছিলেন।

তবে জীবনের অন্তিম সময়ে কিছু স্বীকৃতি পেয়েছিলেন তিনি। ভারত সরকার তাকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব ‘পদ্মবিভূষণ’ (২০০২) প্রদান করে। ২০০৪ সালে সিকিম রাজ্য সরকার দেয় ‘সিকিম রত্ন’ সম্মান। তবু শেষ বয়সে দিল্লির মনোভাব নিয়ে তিনি ব্যথিত ছিলেন, তা গোপন করেননি।

১৯৯৬ সালের নভেম্বরে নেপালের কান্তিপুর টাইমস–এর সম্পাদক সুধীর শর্মাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি ক্ষোভ উগরে দিয়ে বলেন, আগে দিল্লি গেলে লাল কার্পেট বিছিয়ে অভ্যর্থনা হতো, প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করতাম। আর আজকাল দ্বিতীয় সারির নেতা-মন্ত্রীদের সঙ্গে দেখা করতেও দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়! 

নিজের বিরুদ্ধে দেশ ‘বিক্রি’ করার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি জানি অনেকে বলে আমি বিশ্বাসঘাতক, আমি সিকিমকে বেচে দিয়েছি। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই অভিযোগটা সত্যি, তাহলেও কি সিকিমের আজকের অবস্থার জন্য আমি একাই দায়ী? 

এখানে তার ইঙ্গিত স্পষ্ট ছিল—চিরশত্রু চোগিয়ালের ‘অপশাসনের’ দিকেই।

অদ্ভুত সমাপতন, সিকিমের শেষ চোগিয়াল পালডেন থোন্ডুপ নামগিয়ালের জীবনও শেষ হয়েছিল বেদনায়। স্ত্রী হোপ কুক আগেই দেশ ছাড়েন, রাজ্যপাট হারানোর তিন বছরের মধ্যে প্রথম পক্ষের ছেলে, কেমব্রিজ-শিক্ষিত যুবরাজ তেনজিং নামগিয়াল সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। মাত্র ৫৮ বছর বয়সে চোগিয়াল নিজেও নিউইয়র্কে ক্যানসারে প্রাণ হারান। আর তারও আড়াই বছর পর দিল্লিতে নিহত হন ইন্দিরা গান্ধী—নিজ দেহরক্ষীর গুলিতে।

লেন্দুপ দর্জি অবশ্য দীর্ঘায়ু ছিলেন। কালিম্পংয়ের বাসভবনে ২০০৭ সালের ২৮ জুলাই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, বয়স হয়েছিল ১০৩ বছর। মৃত্যুর পর তাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী পবন চামলিং বলেন, “কাজীসাহেবকে দেখেই আমি রাজনীতিতে এসেছি। ” মৃত্যুর এক সপ্তাহ পর তার অন্ত্যেষ্টি সম্পন্ন হয় রুমটেক মঠে—যে মঠের প্রধানের পদ থেকে তাকে একসময় সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—আজকের সিকিম কি মনে রাখে তার সেই প্রথম মুখ্যমন্ত্রীকে, যার হাত ধরে রাজ্যটি ভারতের অঙ্গরাজ্য হয়েছিল? গ্যাংটকের প্রবীণ অধ্যাপক বিধুবিনোদ ভান্ডারীর মতে, আজকের প্রজন্মের অনেকে হয়তো কাজী লেন্দুপ দর্জির নামই শোনেনি।

তবুও অন্তত একটি কারণে সিকিমের আজও তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। তার উদ্যোগেই ভারত সরকার সিকিমবাসীদের জন্য বিশেষ সুবিধা দিয়ে আয়কর থেকে রেহাই দিয়েছিল। আজও গোটা ভারতের মধ্যে একমাত্র সিকিমের অধিবাসীরাই তাদের উপার্জনের ওপর আয়কর দিতে হয় না—যার পেছনে দর্জির বড় অবদান ছিল।

যে মানুষ সারা জীবন শুনেছেন মাতৃভূমিকে বিদেশি শক্তির কাছে ‘বিক্রি’ করার অভিযোগ, তার প্রাপ্তির ঘরে এই স্বীকৃতি—এটুকুই বা কি কম!

আরএইচ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।