হাজারো ঘরবাড়ি এখন কেবল ধ্বংসস্তূপ। স্কুল, হাসপাতাল, মসজিদসহ সবকিছু গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী।
স্যাটেলাইট চিত্রে ধরা পড়েছে ধ্বংসস্তূপের রাজ্য, যেখানে আগে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি পরিবার বসবাস করত। ইসরায়েল শুধু ক্ষতিগ্রস্ত ভবন নয়, অনেক অক্ষত বাড়িঘরও ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) বলছে, তারা গাজার বিভিন্ন এলাকায় তাদের সেনারা ‘অপারেশনাল নিয়ন্ত্রণে’ রয়েছে।
পরিকল্পিতভাবে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন এলাকা
রাফাহ শহরের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা তেল আল-সুলতান। সেখানেই ছিল শহরের একমাত্র মাতৃসদন হাসপাতাল ও এতিম শিশুদের জন্য একটি সেবাকেন্দ্র। কয়েক মাস আগেও যেখানে মানুষ থাকত, এখন সেখানে ধ্বংসস্তূপ আর ধুলো উড়ছে।
১৩ জুলাইয়ের মধ্যে পুরো পাড়া যেন মুছে ফেলা হয়েছে। একমাত্র হাসপাতাল ভবনটি কোনোমতে টিকে আছে।
রাফাহর পাশের সৌদি পাড়ার অবস্থাও একই। শহরের বড় মসজিদ ও অনেকগুলো স্কুল ছিল এখানে। এখন চলছে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার কাজ। যাচাই করা একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, রাস্তায় ইসরায়েলি ট্যাংকের পাশে ভেকু কাজ করছে।
সীমান্ত ছাড়িয়ে গাজার গভীরেও ধ্বংস
ইসরায়েল গাজা সীমান্তে একের পর এক ‘নিরাপত্তা করিডর’ তৈরি করছে। এসব করিডরের আশপাশে যেসব ভবন আছে, তা একে একে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি গাজার গভীরের গ্রামেও চলছে একই ধ্বংসযজ্ঞ। যেমন— খুজাহ। গাজা-ইসরায়েল সীমান্ত থেকে ১.৫ কিলোমিটার দূরে এই গ্রাম একসময় টমেটো, জলপাই আর গমের জন্য বিখ্যাত ছিল। এখন আইডিএফ বলছে, তারা এখানে ১২০০টি ভবন ধ্বংস করেছে।
পাশের শহর আবাসান আল-কাবিরার চিত্রও একই। সেখানেও কয়েক সপ্তাহের মধ্যে গোটা শহর ধ্বংস হয়ে গেছে।
ইসরায়েলি বাহিনী বলছে, তারা কেবল সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি ধ্বংস করছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র বলছে অন্য কথা— অন্য অনেক ভবনও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যেগুলোর কোনো সামরিক সংযোগ ছিল না।
যুদ্ধাপরাধের আশঙ্কা, আইডিএফের কোনো ব্যাখ্যা নেই
বিবিসি ভেরিফাই এইসব ধ্বংস নিয়ে আইডিএফের কাছে ব্যাখ্যা চাইলেও তারা বিস্তারিত কিছু জানায়নি। শুধু বলেছে— তারা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কাজ করছে। আইডিএফের এক মুখপাত্র বলেছেন, হামাস বেসামরিক এলাকায় ‘সামরিক সরঞ্জাম’ লুকিয়ে রাখে। তাই শুধুমাত্র সামরিক প্রয়োজনেই গাজার সব ধরনের ভবন ধ্বংস করা হচ্ছে।
তবে আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসরায়েল সম্ভবত জেনেভা কনভেনশনের অধীনে যুদ্ধাপরাধ করেছে। কারণ, দখলদার শক্তির মাধ্যমে অবকাঠামো ধ্বংস করাকে সেখানে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
জেরুজালেমভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ‘ডায়াকোনিয়া’র আইনজীবী ইতান ডায়মন্ড বলেন, কোনো ভবিষ্যৎ আশঙ্কা বা সন্দেহের ভিত্তিতে ঘরবাড়ি ধ্বংস করা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জানিনা ডিল বলেন, দখলদার শক্তি হিসেবে ইসরায়েলের উচিত ওই এলাকার মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, কিন্তু সবকিছু গুঁড়িয়ে দেওয়া নয়।
‘মানবিক শহর’ নয়, বন্দিশিবির!
গত জুলাই মানে রাফাহ শহরের ধ্বংসস্তূপে ‘মানবিক শহর’ গড়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ। সেখানে অন্তত ৬ লাখ ফিলিস্তিনিকে আবদ্ধ করে রাখা হবে বলে জানানো হয়েছে।
এই পরিকল্পনাকে ‘বন্দিশিবির’ বলে মন্তব্য করেন ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইহুদ ওলমার্ত।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধ্বংসযজ্ঞ শুধু যুদ্ধ নয়— বরং গাজাকে একপ্রকার বসবাসের অযোগ্য করে তুলতে পরিকল্পিত চেষ্টা চলছে।
ইসরায়েলি গণমাধ্যম জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে নতুন করে বড় বড় বুলডোজার এনেছে আইডিএফ। গাজায় বাড়ি ভাঙার কাজের জন্য ইসরায়েলি ফেসবুক গ্রুপগুলোয় ঠিকাদার খোঁজা হচ্ছে। ঠিকাদারদের কেউ কেউ সাংবাদিকদের সঙ্গে খারাপ ভাষায় কথা বলেছেন।
কিছুই আর অবশিষ্ট নেই
তেল আল-সুলতানের বাসিন্দা মোয়াতাজ ইউসুফ আহমেদ আল-আবসি বলছিলেন, যুদ্ধ শুরুর এক বছর আগে আমি যে ঘর বানিয়েছিলাম, এখন তা সম্পূর্ণ ধ্বংস। স্বপ্ন ছিল, আশা ছিল। এখন কিছুই নেই। বাড়ি নেই, ভবিষ্যৎ নেই।
যুদ্ধের শুরু থেকেই বিশ্লেষকরা বলছিলেন, ইসরায়েল সীমান্তবর্তী ভবন ধ্বংস করে গভীর ‘বাফার জোন’ তৈরির চেষ্টা করছে। সম্প্রতি যেসব এলাকা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সেগুলোর অনেকগুলোই গাজার গভীরে।
জেরুজালেমভিত্তিক ‘ডায়াকোনিয়া ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যানিটারিয়ান ল’ সেন্টারের জ্যেষ্ঠ আইন বিশেষজ্ঞ ইতান ডায়মন্ড বলছেন, গাজার এই ধ্বংসযজ্ঞ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বৈধ নয়। যুদ্ধ চলার সময় বেসামরিক মানুষের ঘরবাড়ি, হাসপাতাল বা স্কুল— এগুলো শুধুমাত্র তখনই ধ্বংস করা যায়, যখন তাৎক্ষণিকভাবে সেগুলো কোনো সামরিক হামলায় ব্যবহার হচ্ছে এবং ধ্বংস করা ছাড়া উপায় নেই। ভবিষ্যতে কোনো জায়গা হামাস ব্যবহার করতে পারে— এই আশঙ্কার ভিত্তিতে ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া আন্তর্জাতিক নিয়মের বাইরে পড়ে।
অক্সফোর্ড ইনস্টিটিউট ফর এথিকস, ল’ অ্যান্ড আর্মড কনফ্লিক্টের সহ-পরিচালক অধ্যাপক জানিনা ডিল বলেন, কোনো দখলদার শক্তির দায়িত্ব হচ্ছে— সেই অঞ্চলের মানুষের নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত করা। কিন্তু গাজায় যা হচ্ছে, তা ঠিক এর উল্টো। একটি এলাকা বাসযোগ্য করে তোলার বদলে সেখানে সবকিছু ধ্বংস করে দেওয়া— এই কৌশল আন্তর্জাতিক নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত।
এদিকে, কয়েকদিন আগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু তার সংসদ সদস্যদের এক গোপন বৈঠকে বলেছেন, আরও বেশি বাড়িঘর ধ্বংস করা হচ্ছে, যাতে ফিলিস্তিনিরা আর ফিরে আসতে না পারে।
কিছু বিশ্লেষক আবার এই অভিযানকে সমর্থন করারও চেষ্টা করেছেন। তারা বলছেন, আইডিএফ যেসব ভবন ধ্বংস করেছে সেগুলোর অনেকগুলোই যুদ্ধের সময় গোলাবর্ষণ ও বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তাই সেগুলোয় ফিলিস্তিনিদের ফেরা সহজ নয়।
ইসরায়েলের বেসা সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক ইতান শামির বিবিসি ভেরিফাইকে বলেন, ধ্বংস হওয়া এই ভবনগুলো স্থানীয় মানুষের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে শীতকালে বৃষ্টির সময়, এগুলো ধসে পড়ার আশঙ্কা থাকে। তার মতে, এ ধ্বংসের পেছনে কৌশলগত কারণও রয়েছে। এই জায়গাগুলো এখন যুদ্ধক্ষেত্র। আইডিএফ কোনো ভবন দখল নেওয়ার পর বেরিয়ে গেলে, সন্ত্রাসীরা আবার ফিরে এসে সেখানে বোমা পুঁতে রাখে বা লুকিয়ে থেকে হামলা চালায়।
রাটগার্স ল’ স্কুলের একজন বিশ্লেষক আদিল হক বলেন, আইডিএফের এসব ধ্বংসযজ্ঞের উদ্দেশ্য হতে পারে একটি ‘নিরাপত্তা অঞ্চল তৈরি করা’ যেটা তারা ‘স্থায়ীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে। ’ আরও কয়েকজন বিশ্লেষক আবার মনে করেন, ইসরায়েল গাজার রাফাহ এলাকায় যেসব ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, তার পেছনে অন্য এক উদ্দেশ্য রয়েছে। হতে পারে সেখানে একটি ‘মানবিক শহর’ তৈরি করা হবে।
কিন্তু জেরুজালেম ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড সিকিউরিটির প্রেসিডেন্ট এফ্রাইম ইনবার বলেছেন, সবকিছু ধ্বংস করে ইসরায়েল এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছে, যাতে ফিলিস্তিনিরা গাজা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়।
এমজে