ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধ উভয় পক্ষের জন্যই একটি অস্তিত্বের যুদ্ধ বলে মনে হচ্ছে। আমেরিকার হামলার আলোকে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করার ইসরায়েলের উচ্চাকাঙ্ক্ষা অপূর্ণই রয়ে গেছে।
সময় ইসরায়েলের পক্ষে নেই। প্রকৃতপক্ষে বর্তমানে ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় উচ্চাশা—বছরের পর বছর ধরে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে বাধাগ্রস্ত করা, এটিকে নির্মূল করা নয়। তাছাড়া ভৌগোলিক পরিবেশ এই যুদ্ধের জন্য মানানসই নয়। এখানকার ভৌগোলিক পরিবেশ পাকিস্তান থেকে ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত। তাই এই প্রেক্ষাপটে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উত্থিত হয়েছে-
- এই যুদ্ধটা আসলে কী?
- এর পরিণতিইবা কী?
- এতে কি সত্যিকারের কেউ বিজয়ী হয়েছে?
বাস্তবে, এই যুদ্ধে আসল বিজয়ী দেশ রাশিয়া। তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে তারা উপকৃত হয়, যা তাদের বৃহত্তম রপ্তানি বাড়ায়। আর এই যুদ্ধ ইউক্রেন যুদ্ধে তাদের হিসেব-নিকেশ আরও শক্তিশালী করে।
অন্যদিকে বিবাদমান দুইপক্ষ ইরান ও ইসরায়েল, এমন একটি যুদ্ধ শুরু করেছে যার সঠিক হিসাব তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরেও বিস্তৃত। আর এইখানটাতে যুদ্ধের অবসান ঘটাতে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করছে।
ছবির শক্তি
ইসরায়েলের প্রথম আক্রমণ ছিল মূলত ইরানের ভাবমূর্তি ও জনসাধারণের ওপর এর প্রভাবের লক্ষ্যে। ঘটনার দৃশ্যায়নে আরব অঞ্চলে মানসিক পরাজয় ও হতাশা দেখা দেয়। ইরানে ধ্বংসের দৃশ্য, তার বিজ্ঞানীদের মৃত্যু এবং ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর কার্যকারিতা ও নির্ভুলতার ওপর মনোযোগ—একটি বড় ধাক্কা দেয় ইরান ও এই অঞ্চলে। যা ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা পুরনো কথাটিকে ফের জোরদার করে: ইসরায়েলি সেনাবাহিনী অজেয়।
পরবর্তীতে ইরানের প্রতিক্রিয়া ছিল মারাত্মক। সীমিত ইসরায়েলি ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও, তেল আবিব ও হাইফায় ধ্বংসযজ্ঞের ছবি ইরানের জন্য একটি নৈতিক বিজয়ের প্রতীক। প্রকৃতপক্ষে আরব সোশ্যাল মিডিয়া দ্রুত ইসরায়েলের ধ্বংসযজ্ঞের ছবি দিয়ে আলোকিত হয়ে ওঠে। সুতরাং এই যুদ্ধে ইসরায়েল এমন কিছু হারিয়েছে যা—তারা এখনো উপলব্ধি করতে পারেনি এবং এখন এটা আশা করা যাচ্ছে, যুদ্ধোত্তর পর্যায়ে তারা বুঝতে শুরু করবে।
যা ঘটেছে তা অজেয় সামরিক শক্তি হিসেবে ইসরায়েলের ভাবমূর্তির উল্লেখযোগ্য অবনতি। এটা আরব অঞ্চলের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতের অবসান ঘটানোর উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে শক্তিশালী করার দরজা খুলে দিতে পারে, যা দীর্ঘকাল ধরে আরব জনগণের সম্মিলিত চেতনায় একটি কার্যকর ঐতিহাসিক প্রতিপক্ষ।
অস্ত্রের শক্তি
আরব অঞ্চলে ইসরায়েলের উচ্চতর প্রতিরোধমূলক এবং আক্রমণাত্মক শক্তি রয়েছে। তারা হিজবুল্লাহকে দমন করতে ও তারপর গাজায় হামাসের ক্ষমতাকে দুর্বল করতে সফল হয়েছে। বিমান বাহিনী দিয়ে এই শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরা হয়েছে, এবং এখানে বিমান প্রতিরক্ষায় আরব ও ইরানের সক্ষমতা তাৎক্ষণিকভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই অবস্থায় আমরা দেখতে পাই যে, মিশর বাদে বেশিরভাগ আরব দেশ ও ইরান এই ইসরায়েলি শ্রেষ্ঠত্বের মুখোমুখি এবং প্রতিরোধ করার জন্য বিমান প্রতিরক্ষা বাহিনী তৈরি করেনি।
ভবিষ্যতে ইসরায়েলের বিমান বাহিনীকে নিরপেক্ষ করা হলো ইসরায়েলের সঙ্গে তার ক্ষমতা সীমিত করার যুক্তির ভিত্তিতে মোকাবিলার সূচনা, যা এই অঞ্চলে ইসরায়েলি অহংকারকে দমন করবে। ইরান এই শ্রেষ্ঠত্ব মোকাবিলায় তুলনামূলকভাবে সফল হয়েছে, তবে দ্বিতীয় হামলায়, যখন তারা একটি এফ-৩৫ গুলি করে ভূপাতিত করে, এটি ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর সঙ্গে মোকাবিলা করার ক্ষমতার একটি ভালো সূচক হিসেবে বিবেচিত হয়।
ইসরায়েলের কাছে বহুমুখী ড্রোন রয়েছে, অন্যদিকে ইরানের কাছে উন্নত ড্রোন রয়েছে। তবে, এই ইরানের ড্রোন ট্র্যাক করার ক্ষমতা ইসরায়েলের সামর্থ্যকে সীমিত করে। তথাপি ভবিষ্যৎ ইঙ্গিত দেয়—ইরান এবং আরবরা যদি তাদের ড্রোন ক্ষমতা বিকাশ করে, তাহলে ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ অংশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে আকাশ প্রথমবারের মতো হুমকির মুখে পড়বে, যাতে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষাতত্ত্ব এবং কৌশল ভূ-লুণ্ঠিত হবে। অধিকন্তু ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের অনুপ্রবেশ ইঙ্গিত দেয়—এই হামলাগুলি প্রতিহত করার ক্ষেত্রে ইসরায়েলের ভবিষ্যৎ এখন প্রশ্নবিদ্ধ।
ইরানের উল্লেখযোগ্য ক্ষতি প্রতীয়মান হচ্ছে—যদিও এখনো তা হিসাব করা হয়নি। মূলত তাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপ করবে। অন্যদিকে ইসরায়েল একটি অঘোষিত অর্থনৈতিক অবরোধের শিকার। যুদ্ধের ফলে বিমান পরিবহন বন্ধ হয়ে গেছে এবং একইভাবে ইসরায়েলি বন্দরে বন্ধ রয়েছে অনেক জাহাজ চলাচল। এর অর্থ হচ্ছে—যুদ্ধের ফলে ইসরায়েলের জন্য ভয়াবহ পরিণতি হবে।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে। তারা কি এই সংঘাতকে ছড়িয়ে পড়া ও অঞ্চলজুড়ে বৃহৎ আকারের যুদ্ধে পরিণত হওয়া রোধ করতে সক্ষম হবে?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল যা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে তা হচ্ছে— ইরানি জনগণের স্বভাব। ইরানিরা যেকোনো বিদেশি আক্রমণ বা হামলার বিরুদ্ধে একগুঁয়ে। এ ক্ষেত্রে যদি তাদের শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও যেতে হয় তবু তারা সেটাই করবে। এমন একটি উজ্জ্বল উদাহরণ সাদ্দামের সঙ্গে যুদ্ধ। সাদ্দাম হোসেন যখন ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, তখন তিনিও এটি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, ইসলামী বিপ্লবের পরে ইরান দুর্বল হয়ে পড়েছে। একই কথা প্রযোজ্য ইসরায়েলের বেলায়ও। তারা মনে করেছিল, লেবানন ও সিরিয়ায় ক্ষমতার ওপর ইরানের দখল যখন ছিন্ন করা গেছে, তখন নিশ্চয়ই তারা দুর্বল হয়ে পড়েছে।
তবে যদি ইরান আক্রান্ত হয় অথবা প্রকাশ্যে ইরান ভাঙার প্রচেষ্টা চলে, তাহলে সরাসরি মার্কিন স্বার্থে আঘাত করা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় থাকবে না। ইতোমধ্যে ক্ষমতাশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার পর তেহরান সেটা করার হুমকি দিয়েছে।
তবে পরিস্থিতির অবনতি ও ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুদ্ধের প্রভাব সম্পর্কে আমেরিকান উদ্বেগ, প্রথমবারের মতো নিরাপত্তার অভাব থাকা ইসরায়েলি নাগরিকদের বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে প্রতিনিধিত্ব করা, সেইসাথে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে এই ধরনের যুদ্ধ সহ্য করতে ইসরায়েলের অক্ষমতা— এসব কারণই যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়ার প্রকৃত কারণ।
অন্যদিকে, এই যুদ্ধ থেকে ইরানের বিজয়, অথবা পরাজয় বা জয়ের কোনো নমুনা নেই, যেটা ইসরায়েলের জন্য পরোক্ষভাবে একটি কৌশলগত ও মানসিক পরাজয়ের ইঙ্গিত। আর এর দীর্ঘমেয়াদী পরিণতি ইসরায়েল এবং এর অস্তিত্বের জন্য হবে ভয়াবহ। নেতানিয়াহু ভালোভাবেই জানেন—এই পরিস্থিতি তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের অবসান ঘটাবে এবং তাকে কারাগারে নিয়ে যাবে। এই অবস্থায় তিনি এমন একটি ফলাফলে পৌঁছানোর পর এই যুদ্ধের অবসান ঘটান—যা তার সমর্থকদের কাছে সন্তোষজনক হওয়ার আগে তার কাছে সন্তোষজনক ছিল।
তাছাড়া, ইসরায়েলের সরাসরি নির্দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ বন্ধ করতে হস্তক্ষেপ করে। তেল বাজারে ক্রমবর্ধমান মূল্য সহনীয় পর্যায়ে থাকবে না। মজুদ এবং তাদের পতন একটি বিশ্বব্যাপী সংকট তৈরি করবে। এসবকিছু চীন পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।
সুতরাং যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেছে সেই অনুযায়ী— যেভাবে একটি বাস্তব সাফল্য হিসেবে শেষ করা হয়েছে। এই অবস্থায় পরাজিত বা বিজয়ী না হওয়ার পরিস্থিতি দিয়ে এটি শেষ করাই হলো সেই সমাধান যা ইসরায়েল পেয়েছে, যেটি জয়ীও না, পরাজিতও না। আমরা নতুন প্রজন্মের দূরবর্তী যুদ্ধের মুখোমুখি, কিন্তু সেগুলো অমীমাংসিত যুদ্ধ। এই যুদ্ধে হেরে গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যারা রাশিয়া এবং চীনকে নতুন ক্ষেত্র অর্জন করতে দেখেছে, এখন তাদের বিনিয়োগ করতে হবে, অন্যথায় তারা সুবর্ণ সুযোগ হারাবে।
লেখক
মিশরের ইতিহাসবিদ ও শিক্ষক
(আল-জাজিরার আরবি ভার্সন থেকে নেওয়া)