তেহরানে প্রবেশের মহাসড়কগুলো আবারও ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। শহর মুখী গাড়িগুলোতে রয়েছে পরিবার, স্যুটকেস, আর সেই সতর্ক আশাবাদ, ‘হয়তো এবার ঘরটা আবার নিরাপদ হতে পারে’।
৩৩ বছর বয়সী নিকার মতো অনেকেই ঘরে ফিরে স্বস্তি অনুভব করলেও, যুদ্ধবিরতি কতটা স্থায়ী হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। সংঘর্ষটি শুরু হয়েছিল ১৩ জুন, যখন ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর প্রাথমিক হামলা চালায়। এরপর দুই অঞ্চলিক শক্তির মধ্যে নজিরবিহীন পাল্টা হামলা শুরু হয়, যা কয়েক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো যুদ্ধকে সরাসরি তেহরানের কেন্দ্রে নিয়ে আসে।
সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে শহর ছেড়ে পালিয়ে যান, তাদের জীবন ছেড়ে যাওয়ার মানসিক চাপ ছিল অত্যন্ত কষ্টদায়ক। ২৬ বছর বয়সী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সাবা বলেন, যুদ্ধের আগে তার জীবন ছিল ব্যস্ত ও গতিময়। তিনি পড়াশোনা করতেন, চাকরি করতেন এবং একা থাকতেন বলে নিজের সব কাজ নিজেই করতেন। যুদ্ধ শুরু হলে কিছুদিন তিনি চেষ্টা করেছিলেন স্বাভাবিক থাকার, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব থেমে যায়।
সাবা বলেন, প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা স্থগিত হলো, এরপর অফিস থেকে বলা হলো ঘরে বসে কাজ করতে, একে একে সব বন্ধুরাও তেহরান ছেড়ে গেল। তখন আমি প্রচণ্ড একাকীত্বে ভুগছিলাম। রাতে যখন বোমাবর্ষণ আর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার গর্জন শুরু হতো, তখন তিনি আর নিজেকে প্রবোধ দিতে পারতেন না।
একটি গাড়ি জোগাড় করতে না পেরে, তার বাবা উত্তর-পূর্ব ইরানের মাশহাদের কাছে কোচান শহর থেকে এসে তাকে পারিবারিক বাড়িতে নিয়ে যান, যেখানে তিনি যুদ্ধবিরতি পর্যন্ত আশ্রয় নেন।
এখন, নিকা ও সাবার মতো অনেকেই বাড়ি ফিরলেও মনে রয়ে গেছে উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা। তেহরানে ফিরে আসা অনেকের জন্য নিজের বিছানায় ঘুমানোর স্বস্তি মিশে আছে এক স্থায়ী আতঙ্কের সঙ্গে, যে কোনো মুহূর্তে আবার বোমাবর্ষণ শুরু হতে পারে।
ইরানের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইরান-ইসরায়েল ১২ দিনের যুদ্ধের সময় অন্তত ৬১০ জন নিহত এবং প্রায় ১,৫০০ জন আহত হয়েছে, যার মধ্যে ৯০ শতাংশেরও বেশি ছিলেন বেসামরিক নাগরিক।
তেহরানের এক ব্যবসায়ী কামরান বলেন, প্রথম দিকে তিনি শহরে থেকেই নিজের কোম্পানি চালু রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। দিনের বেলা জীবন কিছুটা সহনীয় ছিল, তবে ‘রাতগুলো ছিল অসহনীয়’ কারণ তখন চলত লাগাতার বোমাবর্ষণ ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার গর্জন।
যুদ্ধের শুরুর দিকেই বহু মানুষ শহর ছাড়তে বাধ্য হন, যদিও তাদের যাত্রা সহজ ছিল না। জ্বালানির জন্য ফুয়েল স্টেশন গুলোতে দীর্ঘ সারি আর প্রধান সড়কগুলোতে প্রচণ্ড যানজটে পড়ে যেতে হয়।
এখন, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর, অনেকেই আবার তেহরানে ফিরে আসছেন। যুদ্ধ চলাকালীন ১১ জনের সঙ্গে একত্রে আশ্রয় নিয়েছিলেন নিকা, তিনি বলেন, নিজের নিরিবিলি ঘরে ফিরে আসা ছিল ‘স্বর্গের মতো’ যদিও তার মনে সংশয় আছে এই যুদ্ধবিরতি কতদিন স্থায়ী হবে।
তবুও নিকা বলেন, যদি যুদ্ধ আবারও শুরু হয়, আমি আর আমার ঘর ছাড়তে চাই না।
যুদ্ধবিরতির পর তেহরানে ফিরে আসা সব ইরানিই অক্ষত ঘরে ফিরতে পারেননি। খ্যাতনামা সঙ্গীতশিল্পী কেইভান সাকেত জানতে পারেন, তার বাড়িতে ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে। একটি বোমা বিস্ফোরিত না হওয়ায় সম্পূর্ণ ধ্বংস এড়ানো গেলেও ক্ষয়ক্ষতি ছিল ভয়াবহ। দরজা-জানালা ভেঙে গেছে, ঘরের যন্ত্রপাতি যেমন ফ্রিজ ও ওয়াশিং মেশিন নষ্ট, লোহার গেট পর্যন্ত বিকৃত হয়ে গেছে। সাকেত যুদ্ধকে ‘মানবজাতির সবচেয়ে বিকৃত সৃষ্টি’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে ঘৃণা প্রকাশ করেন।
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও ইরান ও ইসরায়েল উভয়েই একে অপরের বিরুদ্ধে চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ করছে। উভয় পক্ষ থেকেই হামলার ঘটনা ঘটেছে তেহরানে ইসরায়েলি হামলা এবং ইসরায়েলে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা।
রাজনৈতিক বিজ্ঞান শিক্ষার্থী হামেদ কেরমান শহর থেকে ফিরে এলেও আবারও ঘর ছেড়ে পালাতে হতে পারে এই আশঙ্কায় ভুগছেন। তবুও, তেহরানে জীবন ধীরে ধীরে সচল হচ্ছে, সড়কে যান চলাচল বাড়ছে, ক্যাফে-রেস্তোরাঁ খুলছে, কোম্পানিগুলো রিমোট ওয়ার্ক বন্ধ করে কর্মীদের অফিসে ফিরতে বলছে।
তেহরানসহ আলবর্জ, পূর্ব আজারবাইজান, ইসফাহান, ফারস, কেরমানশাহ প্রদেশজুড়ে অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ইসরায়েল দাবি করেছে, ১২ দিনের যুদ্ধে তারা ইরানজুড়ে ১০০-র বেশি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে।
এই অনিশ্চয়তার মাঝেও সাবার মতো অনেকেই আশাবাদী— কারণ, ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবন ফিরছে, যদিও যুদ্ধবিরতির ওপর ঝুলে থাকা শঙ্কার ছায়া এখনও স্পষ্ট।
এমএম