ঢাকা, বুধবার, ১২ আষাঢ় ১৪৩২, ২৫ জুন ২০২৫, ২৮ জিলহজ ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

ইরানের যেসব আঘাত কখনো ভুলতে পারবে না ইসরায়েল

মিরকান মিশুক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:১২, জুন ২৪, ২০২৫
ইরানের যেসব আঘাত কখনো ভুলতে পারবে না ইসরায়েল ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে বিরশেভায় ধসে যাওয়া ভবন। ছবি সংগৃহীত

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে  ইরানের পরিচালিত ‘অপারেশন ট্রু প্রমিজ- থ্রি’ এর আওতায় ইসরায়েলের বেশ কিছু কৌশলগত স্থাপনায় একাধিক হামলা চালায়। এসব হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল তেল পরিশোধন কেন্দ্র, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, হাসপাতাল ও তেল আবিব স্টক এক্সচেঞ্জ।

অর্থাৎ এবারের হামলায় ইসরায়েলের শুধু সামরিক নয়, বরং অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোও আক্রান্ত হয়। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এক সাথে এত ক্ষয়ক্ষতি ইসরায়েলি কখনো দেখেনি। কিছু কিছু হামলা এমন সব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় চালানো হয়েছে যা ইসরায়েল কখনো ভুলতে পারবে না।

এমন সব স্থাপনার মধ্যে রয়েছে:     

কিরিয়া
তেল আবিবে অবস্থিত কিরিয়া, মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স স্কুল কমপ্লেক্স একটি বিশাল সামরিক কমপ্লেক্স যেটিকে ‘ইসরায়েলের পেন্টাগন’ বলা হয়। এখানে রয়েছে আইডিএফের আমান (মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স ডিরেক্টোরেট), মোসাদ (বৈদেশিক গোয়েন্দা শাখা) এবং শিন বেট (অভ্যন্তরীণ সিকিউরিটি)-এর মধ্যে সমন্বয়ের মূল কেন্দ্র।  

এখান থেকে গাজা, লেবানন (হিজবুল্লাহ), সিরিয়া ও ইরানি হুমকি মনিটরিংয়ের জন্য এআই-চালিত ওয়ার রুম পরিচালনা ও রিয়েল-টাইম ডেটা অ্যানালিসিস করা হয়।

কিরিয়ায় ইরানি ক্ষেপাণাস্ত্রের আঘাত।  ছবি সংগৃহীত

এখানে রয়েছে সাইবার ওয়ারফেয়ার একাডেমি যেখানে হ্যাকার বাহিনী ইউনিট ৮২০০-এর জন্য অ্যাডভান্সড ক্রিপ্টোগ্রাফি, ডার্ক ওয়েব ট্র্যাকিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। আরও রয়েছে সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স ট্রেনিং সেন্টার যেখানে ড্রোন, স্যাটেলাইট ও ইলেকট্রনিক ইভেসড্রপিং টেকনিক শেখানো হয়। হিউমিন্ট নামে এজেন্ট রিক্রুটমেন্ট, ডাবল এজেন্ট ম্যানেজমেন্টের কৌশলও এখানে শেখানো হয়।

গত ১৩ জুন তেল আবিব-ভিত্তিক এই সামরিক কমপ্লেক্স লক্ষ্য করে এক ঝাঁক ক্ষেপণাস্ত্রের ছুড়ে ইরান, যার কয়েকটি  সফল ভাবেই কিরিয়ায় আঘাত করে। এই আঘাত সাধারণ ইসরায়েলিদের হতভাগ করে দেয়। নিরাপত্তা দিক থেকে এই স্থাপনা যেখানে অভেদ্য হওয়ার কথা সেখানে ইরানি মিসাইলের আঘাত ইসরায়েলি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বড় দুর্বলতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

হাইফার বাজান তেল পরিশোধন কেন্দ্র  
হাইফা বন্দর এলাকার কাছে বাজান তেল পরিশোধন কেন্দ্র ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় তেল পরিশোধন কেন্দ্র। এখানে প্রতিদিন প্রায় ৯ মিলিয়ন লিটার জ্বালানি প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এখানে পেট্রল, ডিজেল, জেট ফুয়েল, এবং পেট্রোকেমিক্যাল তৈরি হয়। ইসরায়েলের মোট তেল পরিশোধন ক্ষমতার প্রায় ৬০% আসে এখান থেকে।  গত ১৪–১৫ জুন রাতে এই স্থাপনায় ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত করলে ইসরায়েল জুড়ে জ্বালানি সরবরাহ ব্যাহত হয়।

হাইফায় ইরানি ক্ষেপাণাস্ত্রের আঘাত।  ছবি সংগৃহীত

বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো জ্বালানির অভাবে পড়ে ফলে  হাইফা ও আশপাশের শহর যেমন আক্কো, নাজারেথ, কার্মিয়েল বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। নাগরিক সেবা, হাসপাতাল, সাইরেন সিস্টেম অচল হয়ে যায়। তাছাড়া একই এলাকায় পানি পরিশোধন কেন্দ্র আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ায় পরিবেশ দূষণ ও অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়।  

ভিজম্যান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স 
রেহোভটে ভিজম্যান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় বৈজ্ঞানিক গবেষণা কেন্দ্র, যেখানে পারমাণবিক পদার্থবিদ্যা, জেনেটিক্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং প্রতিরক্ষা-সম্পর্কিত গবেষণা চলে।

ইসরায়েলের নিরাপত্তা ও প্রযুক্তিগত আধিপত্য রক্ষায় এই ইনস্টিটিউট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গত ১৫ জুন ইরানের একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ভিজম্যান কমপ্লেক্সে আঘাত হানে, যার ফলে পরীক্ষাগার ও গবেষণা সরঞ্জামের ক্ষতি হয়। গবেষণা কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হয় এবং বিদেশি বিজ্ঞানী ও গবেষকদের সুরক্ষা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দেয়।

ভিজম্যান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সে ইরানি ক্ষেপাণাস্ত্রের আঘাতে ক্ষয়ক্ষতি।  ছবি সংগৃহীত

গাভ-ইয়াম নেগেভ অ্যাডভান্সড টেকনোলজি পার্ক
বিরশেভায় গাভ-ইয়াম নেগেভ অ্যাডভান্সড টেকনোলজিস ইসরায়েলের সাইবার নিরাপত্তা, সামরিক প্রযুক্তি ও উচ্চ-প্রযুক্তির প্রধান কেন্দ্রগুলোর একটি। এখানে আইডিএফের সাইবার ইউনিট, বেন গুরিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় এবং শীর্ষস্থানীয় টেক কোম্পানির গবেষণা শাখা অবস্থিত। রয়েছে মাইক্রোস্ফট এর অফিস। গত ২০ জুন ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র এখানে আঘাত করলে কয়েকটি ডেটা সার্ভার ও গবেষণাগারে উচ্চ-তথ্যভিত্তিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। সাইবার ইনফ্রাস্ট্রাকচারে নিরাপত্তা শঙ্কা তৈরি হয়।

তেল আবির স্টক অ্যাক্সচেঞ্জ
ইরানের সাম্প্রতিক হামলায় একটি ব্যালিস্টিক মিসাইল সরাসরি তেল আবিব স্টক অ্যাক্সচেঞ্জ ভবনে (টিএএসই) আঘাত হানে যাতে ব্যাপক ক্ষতি এবং আহতের ঘটনা ঘটে। এটি ইসরায়েলের অর্থনৈতিক হৃদয়ে সরাসরি আঘাত। গত ১৯ জুনের এই আঘাতে অন্তত ৩২ জন আহত হয়।  

সোরোকা মেডিকেল সেন্টার
বিরশেভায় অবস্থিত সোরোকা মেডিকেল সেন্টার দক্ষিণ ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল এবং ইসরায়েলের তৃতীয় বৃহত্তম চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান। এটি শুধু বিরশেভা নয়, গোটা নেগেভ অঞ্চলের জন্য প্রধান স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, বেসামরিক নাগরিক এবং বেদুইন সম্প্রদায়, সবার জন্যই এটি নির্ভরযোগ্য হাসপাতাল। ১৯ জুন ইরানি সিজ্জিল ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা আঘাত হানে সোরোকা হাসপাতালের হাসপাতাল ব্লককে, ফলে হাসপাতালে বড় ধরনের ক্ষতি ও রাসায়নিক লিকের সম্ভাবনা দেখা দেয়।

সোরোকা মেডিকেল সেন্টার ভবন ও সংলগ্ন তেল আবিব স্টক এক্সচেঞ্জ ভবনে ইরানে ক্ষেপনাস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন।  ছবি সংগৃহীত

রাফায়েলের অস্ত্র কারখানা 
ইরানি সংস্থা তাসনিম জানায় গত ১৫ জুন ইরান ইসরায়েলি কোম্পানি রাফায়েল পরিচালিত একটি অস্ত্র কারখানা লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েলের রাফায়েল অস্ত্র কারখানা (রাফায়েল অ্যাডভান্স ডিফেন্স সিস্টেম লি.) দেশটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের স্বাধীনতার পরপরই প্রতিষ্ঠিত রাফায়েল শুধুমাত্র একটি অস্ত্র কারখানা নয়, বরং ইসরায়েলের সামরিক শক্তির প্রধান প্রযুক্তিগত মেরুদণ্ড।

ইসরায়েল ইনস্টিটিউট ফর বায়োলজিক্যাল রিসার্চ
নেস জিওনা শহরে অবস্থিত ইসরায়েল ইনস্টিটিউট ফর বায়োলজিক্যাল রিসার্চ ১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি নেস জিওনা  বায়োলজিক্যাল রিসার্চ নামে বেশি পরিচিত। এই প্রতিষ্ঠানটি ইসরায়েলের গোপন সামরিক ইউনিট হেমেদ বেইতের ছায়ায় গড়ে ওঠে। বছরের পর বছর এখানে অ্যানথ্রাক্স, বটুলিনাম টক্সিন, রাইসিন এবং ভিএক্স নার্ভ গ্যাসের মতো মারাত্মক জৈব উপাদান নিয়ে গবেষণা চালানো হয়েছে। তবে এসব বিষয়ে ইসরায়েল সরকার কখনও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। বিশ্বব্যাপী এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম আলোচনায় আসে ১৯৯২ সালে যখন এল আল বিমান দুর্ঘটনায় ‘ডিএমএমপি’ নামে একটি রাসায়নিক বহনের তথ্য ফাঁস হয়, যা সরাসরি আইআইবিআরের গবেষণার সঙ্গে সম্পর্কিত বলে সন্দেহ করা হয়। এই গবেষণাকেন্দ্রটির মূল গুরুত্ব ছিল ভবিষ্যতের যুদ্ধ নীতিতে টার্গেটেড ভাইরাল স্ট্রাইক, জৈব অস্ত্র নির্মাণ এবং রাসায়নিক প্রতিরক্ষার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায়। এটি ছিল ইসরায়েলের একটি ‘অদৃশ্য সুরক্ষা বলয়’। গত ২২ জুন এখানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। সামাজিক যোগোযোগ মাধ্যমে এই খবর ও ভিডিও ছড়িয়ে পরলেও ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ চুপ থাকে।  

বেন গুরিয়ান বিমানবন্দর
বিমানবন্দর ও সামরিক/গবেষণা কেন্দ্র হচ্ছে ইসরায়েলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বেসামরিক এবং সামরিক বিমান চলাচল কেন্দ্র। এটি দেশটির বৈদেশিক যোগাযোগের মূল প্রবেশদ্বার। এখানে আধুনিক রাডার সিস্টেম, আঞ্চলিক বিমান নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফ্লাইট হ্যান্ডলিং সিস্টেম রয়েছে। ইরানের লক্ষ্যবস্তুগুলোর একটি ছিল এই বিমানবন্দর, যেখানে অন্তত দুটি ক্ষেপণাস্ত্র আগ  বলে জানা যায়। এতে রানওয়ে ও লজিস্টিক ভবনের আংশিক ক্ষতি হয় এবং বেশ কয়েক ঘণ্টা বিমানবন্দর সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

এছাড়াও তেল আবিব, হাইফা ও রামাত গানের মতো ইসরায়েলের ঘনবসতিপূর্ণ ও উন্নত নাগরিক অবকাঠামোর এসব শহরের আবাসিক ভবনগুলোতে একাধিকবার ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত করেছে। যার মধ্যে একটি সাততলা আবাসিক ভবনও রয়েছে। ওই ভবনের চতুর্থ তলায় আটকে পড়া বাসিন্দাদের উদ্ধারকর্মীরা বহু ঘণ্টা চেষ্টা করে ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করেন। ভবনটির নিচতলা পরে জরুরি ভিত্তিতে একটি অস্থায়ী চিকিৎসাকেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়—যেখানে আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয় এবং আশ্রয়হীনদের সাময়িকভাবে আশ্রয় দেওয়া হয়।

এইসব হামলা শুধু ভবন ধ্বংস নয়, বরং মানুষের জীবনে ভয়, নিরাপত্তাহীনতা এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতা বয়ে আনে। যা ইসরায়েলের নগরজীবনের স্থিতিশীলতাকে মারাত্মকভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে।

এমএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।